ইতিহাস

তাজমহলের শ্রমিকদের হাত কাটার গল্প: ইতিহাস নাকি মিথ

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২৫, ০০: ৩০
তাজমহলের শ্রমিকদের হাত কেটে দেওয়ার গল্প প্রচলিত আছে।


তাজমহল—শুধু একটি স্মৃতিস্তম্ভ নয়, ভালোবাসার এক অনন্ত নিদর্শন। মুঘল সম্রাট শাহজাহান তার প্রিয় স্ত্রী মমতাজ মহলের স্মরণে এই অপূর্ব সৌধ নির্মাণ করেন। তাজমহল শুধু ভারতের নয়, সারা বিশ্বের অন্যতম বিস্ময়কর স্থাপত্য হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা কিংবদন্তি ও গল্প, যেগুলোর অনেকটাই কাল্পনিক।

সবচেয়ে প্রচলিত এবং আলোচিত গল্প হলো—তাজমহলের মতো আর কেউ যেন না বানাতে পারে, তাই সম্রাট শাহজাহান নাকি এর নির্মাণকর্মীদের হাত বা আঙুল কেটে দিয়েছিলেন। গল্পটি রোমাঞ্চকর শোনালেও, বাস্তবের সঙ্গে এর সম্পর্ক কতটা সত্য—তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন অনেক ঐতিহাসিক ও গবেষক।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই গল্প কীভাবে ছড়াল?

তাজমহল নির্মাণে কাজ করেছিলেন প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক ও দক্ষ কারিগর। এই বিশাল কাজ সম্পন্ন করতে সময় লেগেছিল প্রায় ২২ বছর। এত বছর ধরে দিন-রাত কাজ করার পর নির্মাণ শেষ হলে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে যে সম্রাট নির্মাতাদের হাত কেটে দিয়েছেন, যাতে তারা জীবনে আর এমন কিছু তৈরি না করতে পারেন।

এই গল্প এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে অনেক ট্যুর গাইড বা সংবাদমাধ্যমেও এই কথা উঠে আসে। কেউ কেউ এটিকে ইতিহাস বলেও মেনে নেন। কিন্তু বাস্তবে কী বলছে ইতিহাস?

ভারতের রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণাপত্র অনুযায়ী, ‘শ্রমিকদের হাত কেটে ফেলার’ গল্পটিকে ‘শহুরে কিংবদন্তি’ বা একটি কল্পিত রূপকথা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই দাবি প্রমাণ করার মতো কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ বা ঐতিহাসিক নথি পাওয়া যায়নি।

তাজমহলের নির্মাণকালে যদি সত্যিই এমন ভয়ানক ঘটনা ঘটত, তাহলে তা কোনো না কোনোভাবে স্থাপত্যের সঙ্গে যুক্ত প্রাচীন বইপত্র, পর্যটকের বর্ণনা বা মুঘল আমলের রেকর্ডে উঠে আসত। কিন্তু এত বড় একটি ঘটনাকে ঘিরে নেই কোনো লিখিত ইতিহাস।

তাহলে সত্যিটা আসলে কী?

তাজমহলের কাছেই এক সময় শ্রমিকদের জন্য তৈরি হয়েছিল একটি বসতি, যার নাম ‘তাজগঞ্জ’। আজও সেখানে সেই শ্রমিকদের বংশধরেরা বাস করছেন। তাঁদের জীবনের ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে যে, শ্রমিকদের সঙ্গে কোনো অমানবিক আচরণ করা হয়নি।

এছাড়াও, তাজমহল নির্মাণের পর শাহজাহান দিল্লিতে শাহজাহানাবাদ নামে একটি নতুন শহরের কাজ শুরু করেন। সেই প্রকল্পেও একই শ্রমিক ও কারিগরের দল কাজ করেন। প্রশ্ন আসে—যদি তাঁদের হাত কাটা হতো, তবে তাঁরা এত বড় আরেকটি স্থাপনা কীভাবে গড়তেন?

ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী, তাজমহল নির্মাণে নিয়োজিত কারিগর ও শিল্পীদের সঙ্গে এক ধরনের চুক্তি হয়েছিল। এই চুক্তির মাধ্যমে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে, তাজমহলের মতো স্থাপনা তারা আর কোথাও তৈরি করবেন না। এখান থেকেই হয়তো গল্পের সূত্রপাত—এই ‘না করার’ চুক্তিকেই ধীরে ধীরে রঙচঙে গল্পে রূপ দিয়ে বলা হয়, তাঁদের হাত কেটে ফেলা হয়েছিল।

ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব এবং লেখক মনিমুগ্ধ শর্মাও এই গল্পটিকে সম্পূর্ণ কাল্পনিক বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের মতে, ষাটের দশকে এই গল্পটি বেশি জনপ্রিয় হয় এবং স্থানীয় পর্যটন গাইডদের মুখে মুখেই তা ছড়িয়ে পড়ে।

তাজমহল শুধু সুন্দর একটি ভবন নয়—এটি মুঘল শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন, ভালোবাসার প্রতীক, এবং এক অভাবনীয় নির্মাণ কৌশলের উদাহরণ। এই সৌধ নির্মাণে সহস্র শ্রমিকের নিষ্ঠা, দক্ষতা এবং শিল্পচেতনার ফল রয়েছে। কোনো ঐতিহাসিক তথ্য বা প্রমাণ ছাড়াই তাজমহলের সঙ্গে এমন নিষ্ঠুর গল্প জুড়ে দেওয়া শুধু এই কর্মীদের অবদানকে খাটো করা নয়, বরং ইতিহাসকে ভুল পথে চালিত করার মতো।

তাই আজ যখন আমরা তাজমহলের দিকে তাকাই, তখন তার গায়ে রূপকথার চেয়ে ইতিহাসের সত্যরঙই থাকা উচিত। শাহজাহানের তৈরি এই অপূর্ব সৌধ একদিকে যেমন প্রেমের নিদর্শন, অন্যদিকে শ্রমিকদের মেধা ও পরিশ্রমেরও এক চিরন্তন স্মারক।

সূত্র: ইনডিয়া টুডে

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্র

বাংলা সাহিত্যের ভিত্তিতে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে স্মরণীয় নাম হল সত্যজিৎ রায়। তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ অবলম্বনে ১৯৫৫ সালে যে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন, তা কেবল বাংলা বা ভারতীয় চলচ্চিত্রের নয়, বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়।

৩ দিন আগে

পলাশীর যুদ্ধ কেন হয়েছিল?

মীর জাফর, নবাবের সেনাপতি, ব্রিটিশদের সঙ্গে গোপনে চুক্তি করেন এবং যুদ্ধের সময় তার বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় রাখেন। এই বিশ্বাসঘাতকতা নবাবের পরাজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৩ দিন আগে

গ্যাস্ট্রিক দূর করবেন যেভাবে

গ্যাস্ট্রিকের মূল কারণ হলো পাকস্থলীতে অতিরিক্ত অ্যাসিড তৈরি হওয়া। এই অ্যাসিড আমাদের খাবার হজমে সাহায্য করে ঠিকই, কিন্তু যখন এটি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি তৈরি হয় বা পাকস্থলীর দেওয়াল দুর্বল হয়ে পড়ে, তখনই শুরু হয় সমস্যা।

৩ দিন আগে

প্রযুক্তির হাত ধরে ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রে পৌঁছাবে বাংলাদেশ?

নারীদের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের হার এখনও পুরুষদের তুলনায় অনেক কম, এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে তাঁদের সামাজিক প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে।

৩ দিন আগে