ব্যালেস্টিক মিসাইল কীভাবে কাজ করে?

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২৫, ২০: ৩৩

ব্যালেস্টিক মিসাইল শব্দটা শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিশাল এক ধাতব ক্ষেপণাস্ত্র, যেটা হুহু করে আকাশে উঠে পরে আবার ধেয়ে আসে পৃথিবীর মাটির দিকে, বিস্ফোরণ ঘটায় কোনো শহরে বা ঘাঁটিতে। কিন্তু এই ক্ষেপণাস্ত্র আসলে কাজ করে কীভাবে? কীভাবে এত দূর থেকে এত নিখুঁতভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে? আর কেনই বা এই প্রযুক্তি নিয়ে এত উত্তেজনা, এত উদ্বেগ, আর গবেষণা? এই ফিচারে আমরা সহজ ভাষায় সেই জটিল প্রযুক্তির দিকেই চোখ রাখব।

ব্যালেস্টিক মিসাইল হলো এমন এক ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র, যেটা আকাশে উঠে গিয়ে কিছুদূর বলের মতো ধনুকের তীরের মতো একধরনের বক্রপথে চলে। মাটির কাছ থেকে উৎক্ষেপণ করে তাকে এমনভাবে ছুড়ে দেওয়া হয়, যাতে সে নিজের গতি আর অভিকর্ষ বলের উপর নির্ভর করে লক্ষ্যে গিয়ে পড়ে। এই মিসাইল সাধারণত তিনটি ধাপে কাজ করে—প্রথমে উৎক্ষেপণ, এরপর মহাকাশে উড়ান, শেষে পৃথিবীতে ফিরে এসে আঘাত।

প্রথম ধাপটা শুরু হয় গ্রাউন্ড লঞ্চ প্যাড থেকে। বিশাল রকেট ইঞ্জিন এই মিসাইলটিকে ঠেলে দেয় ওপরে, মহাকাশের দিকেই। এই রকেট ইঞ্জিনে থাকে তরল বা কঠিন জ্বালানি। যখন একে উৎক্ষেপণ করা হয়, তখন এই ইঞ্জিন প্রচণ্ড গতি আর জ্বালানি শক্তি দিয়ে মিসাইলটিকে কয়েক হাজার কিলোমিটার উঁচুতে পৌঁছে দেয়। এই পর্যায়ে মিসাইলটির গতি হয় শব্দের গতির চেয়ে অনেক গুণ বেশি। এটা এত দ্রুত চলে যে সাধারণ কোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা একে থামাতে পারে না।

দ্বিতীয় ধাপ হলো "মিডকোর্স ফেজ" বা মধ্যবর্তী পথপর্ব। এই সময় মিসাইলটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ছাড়িয়ে মহাশূন্যের সীমানায় চলে যায়। তখন ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায় এবং ক্ষেপণাস্ত্রটা একধরনের মুক্ত গতিতে চলতে থাকে, একেবারে ধনুকের তীরের মতো বক্র পথে। একে বলে ব্যালেস্টিক ট্রাজেক্টরি। এই সময়েই মিসাইল তার ভেতরে থাকা ওয়ারহেডকে—অর্থাৎ বিস্ফোরক বহনকারী মাথাটাকে—লক্ষ্যের দিকে লক্ষ্য স্থির করে।

তৃতীয় ধাপে সেই ওয়ারহেড পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে এবং ভয়ংকর গতিতে আছড়ে পড়ে তার নির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুতে। এই ওয়ারহেডে যদি পারমাণবিক বোমা থাকে, তবে তা একেকটি শহর ধ্বংস করতে সক্ষম। আবার কোনো সময় একটার জায়গায় একাধিক ছোট ছোট ওয়ারহেড (যাদের বলে MIRV, অর্থাৎ Multiple Independently targetable Reentry Vehicle) ব্যবহৃত হয়, যেগুলো আলাদা আলাদা লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারে।

এই প্রযুক্তি এতটাই উন্নত যে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে থেকেও একেবারে নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছাতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের MIT বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনটিক্স বিভাগের গবেষক ড. লরা গ্রেগরি বলেন, “ব্যালেস্টিক মিসাইল আসলে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ। একে থামানো এতটাই কঠিন, যে এর বিপরীতে নিরাপত্তা বলয় গড়া বিশ্বের সব রাষ্ট্রের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ।”

তিনি আরও বলেন, “এর নিখুঁত নির্ভুলতা অর্জিত হয় এর মধ্যে থাকা গাইডেন্স সিস্টেমের মাধ্যমে। সাধারণত এতে থাকে ইনারশিয়াল ন্যাভিগেশন সিস্টেম, যেটা জিপিএস ছাড়াও মিসাইলটিকে গন্তব্যে পৌঁছাতে সক্ষম করে। এটি নিজে থেকেই নিজের অবস্থান বুঝে নেয় এবং বাতাসের গতি, পৃথিবীর বাঁক ইত্যাদি হিসাব করে নিজের গতিপথ ঠিক রাখে।”

অন্যদিকে, ইউরোপিয়ান ডিফেন্স ইনস্টিটিউটের গবেষক রিচার্ড হেনরি মনে করেন, “ব্যালেস্টিক মিসাইল এখন শুধু যুদ্ধের জন্য নয়, কূটনীতির অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। একটি রাষ্ট্র যখন বলে তার হাতে এই ধরনের মিসাইল আছে, তখন অন্য রাষ্ট্রগুলো ভাবনায় পড়ে যায়, যার ফলে একটা ভারসাম্য তৈরি হয়।”

তবে এই ভারসাম্যের মধ্যেও আছে ভয়ঙ্কর উদ্বেগ। কারণ, যে কোনো সময় ভুল বোঝাবুঝি বা দুর্ঘটনার কারণে এই মিসাইল যদি ছোঁড়া হয়, তাহলে তার পরিণতি হতে পারে বিধ্বংসী। ইতিহাসে এমন ঘটনাও আছে, যখন রাডার ভুল সংকেত দিয়েছে আর মিসাইল ছোঁড়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাবেক কর্মকর্তা স্ট্যানিস্লাভ পেত্রভ একবার এমনই এক ভুল সংকেতকে সন্দেহ করে মিসাইল ছোঁড়ার নির্দেশ দেননি, যার ফলে বিশ্ব এক বড় বিপর্যয়ের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল।

আরও আশঙ্কার বিষয় হলো, এখন এমন কিছু ব্যালেস্টিক মিসাইল তৈরি হয়েছে, যেগুলোকে মাঝপথে থামানো প্রায় অসম্ভব। হাইপারসনিক ব্যালেস্টিক মিসাইল, যেগুলোর গতি শব্দের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি, তা এমন গতিতে চলে যে প্রচলিত কোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা একে লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছানোর আগে থামাতে পারে না। চীন, রাশিয়া, আর আমেরিকা এই প্রযুক্তিতে ব্যাপক গবেষণা করছে।

অবশ্য সব ব্যালেস্টিক মিসাইল যুদ্ধের জন্য নয়। কিছু ক্ষেপণাস্ত্র মহাকাশ গবেষণায় ব্যবহৃত হয়, যেমন উপগ্রহ উৎক্ষেপণ কিংবা মহাকাশযান পাঠানোর জন্য। তবে যেসব মিসাইল আক্রমণাত্মক উদ্দেশ্যে বানানো, তাদের ভয়াবহতা এবং রাজনৈতিক প্রভাব অনেক বেশি।

বাংলাদেশে যদিও এমন অস্ত্র নেই, তবে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তান দু’টি দেশই ব্যালেস্টিক মিসাইল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতের ‘অগ্নি’ সিরিজ আর পাকিস্তানের ‘গৌরি’ বা ‘শাহীন’ সিরিজের মিসাইলগুলো এই অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

সবশেষে বলা যায়, ব্যালেস্টিক মিসাইল এক রকম আধুনিক বিজ্ঞানের চূড়ান্ত সাফল্য হলেও, এর ব্যবহারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গভীর নৈতিক প্রশ্ন। কীভাবে প্রযুক্তি মানুষের জীবন রক্ষা না করে জীবন ধ্বংসে ব্যবহৃত হতে পারে, তার এক নির্মম উদাহরণ এই অস্ত্র।

যুদ্ধের বদলে শান্তির পথে চলার নামই তো সভ্যতা। আর তাই এমন অস্ত্র যতই নিখুঁত হোক, যতই প্রযুক্তিগত উন্নত হোক, আমরা চাই যেন তা শুধু প্রদর্শনেই সীমাবদ্ধ থাকে, ব্যবহারে নয়। বিজ্ঞান এগিয়ে যাক মানবতার দিকেই, ধ্বংসের দিকে নয়।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

দেশজুড়ে বজ্রবৃষ্টির আভাস

আজ সারা দেশে বৃষ্টি অথবা বজ্রবৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। সেই সঙ্গে কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী বৃষ্টিও হতে পারে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

৫ দিন আগে

তাপপ্রবাহ কমে বাড়তে পারে বৃষ্টি

দেশের চার বিভাগের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তাপপ্রবাহ আজ বুধবার কমতে পারে। একই সঙ্গে আগামী কয়েক দিনে দেশের অধিকাংশ স্থানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়তে পারে। কোথাও কোথাও ভারী বর্ষণের সম্ভাবনাও রয়েছে। তাই তাপমাত্রা কমে যেতে পারে।

৬ দিন আগে

মারা গেছেন চিত্রনায়িকা তানিন সুবহা

সোমবার (২ জুন) হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে এই অভিনেত্রীকে ধানমণ্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। তবে এই কয় দিনে তাঁর শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। বরং শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে।

৮ দিন আগে

ঈদের দিন যেসব স্থানে বৃাষ্টি হতে পারে

আগামীকাল মুসলিম সম্প্রদায়ের বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদ ঘিরে শেষ সময়ে চলছে প্রস্তুতি তবে বৈরী আবহাওয়া দুশ্চিন্তায় ফেলেছে মানুষকে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর কম সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে দুর্বল থেকে মাঝারি অবস্থায় রয়েছে। এর প্রভাবে ঈদের দিন তিন বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং পাঁচ বিভাগের

১০ দিন আগে