top ad image
top ad image
home iconarrow iconফিচার

আলোর গোলা

আলোর গোলা

আলোর গোলা
আালোকতড়িৎক্রিয়ার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আলোর কণার সন্ধান দিয়েছিলেন আইনস্টাইন।

আইনস্টাইন খুদে এক কামানের গোলার কথা বললেন ১৯০৫ সালে, যার জন্য তিনি পরে নোবেল পেয়েছিলেন। অথচ এর জন্য সে-সময়ের বিজ্ঞান মোটেও প্রস্তুত ছিল না।

আলোক তড়িৎক্রিয়া ব্যাখ্যা ছিল না তখনকার বিজ্ঞানে। এর সমস্যার সমাধান লুকিয়ে ছিল প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বে। কিন্তু প্ল্যাঙ্ক ব্যাপারটা নিয়ে ভাবেননি। ভেবেছিলেন সুইজ্যারল্যান্ডের বার্ন শহরে পেটেন্ট অফিসের সেই কেরানিটি, যিঁনি কাজের ফাঁকে লুকিয়ে বিজ্ঞানচর্চা করতেন। সেই তরুণের নাম আলবার্ট আইনস্টাইন। কোনো ল্যাবরেটরি, অবজারভেটরির সাহায্য ছাড়াই স্রেফ কিছু থট এক্সপেরিমেন্ট করে মহাবিশ্বের এক মহারহস্য উন্মোচনের খসড়া তিনি করেন মগজ ব্যবহার করে।

১৯০৫ সাল নাগাদ সকল প্রস্তুতি শেষ করে ফেলেন তিনি। প্রকাশের অপেক্ষায় আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব, বা স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি। রিলেটিভিটি থেকেই বেরিয়ে এসেছে পদার্থবিদ্যার ইতিহাসে সর্বকালের সেরা সমীকরণটি। ভর শক্তির সমীকরণ, E = mc2। আর এই সমীকরণ বলছে একটি বিশেষ কথা। সেই বিশেষ কথাটি নিয়ে আইনস্টাইন থিওরি অব রিলেটিভিটির ছাড়াও আরেকটা প্রবন্ধ লিখলেন। সেই প্রবন্ধে দিলেন আলোক-তড়িৎক্রিয়ার ব্যাখ্যা। এজন্য তিনি ধার করলেন প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব। কোয়ান্টাম তত্ত্বকে মেনে নিয়ে আইনস্টাইন বললেন, আলোর পক্ষেও সম্ভব ইলেকট্রনের মতো ভরযুক্ত বস্তু কণাকেও স্থানচ্যূত করা, যদি সেটার আচরণ কণার মতো হয়। হ্যাঁ, আলোর কণাতত্ত্ব অনেক আগেই খারিজ করে দিয়েছিলেন টমাস ইয়াং, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তরঙ্গ তত্ত্ব। তরঙ্গ তত্ত্ব প্রমাণিত সত্য। আইনস্টাইন বললেন আলোর নতুন কণা ধর্ম আসলে নিউটনের পর্যবেক্ষণ করা কণার মতো নয়। আইনস্টাইন এই কণা ধর্ম প্রতিষ্ঠা করলেন প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বের আলোকে। প্ল্যাঙ্ক যেমন বলেছিলেন, আলো আসলে শক্তির গুচ্ছ গুচ্ছ প্যাকেটের সমষ্টি। আইনস্টাইন সেই প্যাকেটকে তুলনা করলেন শক্তির কণা হিসেবে। বহু পরে শক্তির এই কণার নামকরণ করা হয় ফোটন নামে।

আইনস্টাইন শক্তির এই কণাকে তুলনা করলেন কামানের গোলার সঙ্গে। কামানের গোলা ছুটে গিয়ে যেমন ধ্বংস করে দিতে পারে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ সৈন্যদের। তেমনি আলোর এই কণার যদি পর্যাপ্ত শক্তি থাকে, সেটি গিয়ে আঘাত করবে ধাতব পদার্থের ইলেকট্রনকে। সেই আঘাতের ধাক্কা সামলাতে না পেরে ইলেকট্রন ছিটকে বেরিয়ে যাবে ধাতব পরমাণুর শেষ শক্তিস্তর থেকে। ছুটে বেরিয়ে যাওয়া এসব ইলেকট্রনের গতিশক্তি থেকেই আলোর ঝলকানি দেখা যায়।

আইনস্টাইন বললেন, ভর না থাকলেও আলোর কণার গতিশক্তি আছে, অর্থাৎ এর মোমেন্টাম আছে, সরল বাংলায় আমরা যেটাকে ভরবেগ বলি। সেই ভরবেগের কারণেই আলো এভাবে ইলেকট্রনকে ছিটকে বের করে দিতে পারে। আইনস্টাইন আরও দেখালেন, সব আলোর পক্ষে এভাবে ইলেকট্রনকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এর জন্য থাকতে হবে পর্যাপ্ত শক্তি। অতি বেগুনি রশ্মির পক্ষে ব্যাপারটা সহজ, কারণ এদের কম্পাঙ্ক অনেক বেশি, তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কম, তাই শক্তিও অনেক বেশি। অন্যদিকে আমাদের দৃশ্যমান আলোগুলোর অত শক্তি নেই। তাই এদের দিয়ে আলোক-তড়িৎক্রিয়া সম্ভব নয়। সম্ভব নয় ইনফ্রারেড কিংবা বেতার তরঙ্গের পক্ষেও। এদের শক্তি দৃশ্যমান আলোর চেয়েও অনেক কম। অন্যদিকে গামা রশ্মি কিংবা এক্স-রের কম্পাঙ্ক অতি বেগুনি রশ্মির চেয়েও বেশি। তাই আলোক-তড়িৎক্রিয়ায় এদের সক্রিয়তা অনেক বেশি।

আইনস্টাইন কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহার করে আলোক-তড়িৎক্রিয়ার ব্যাখ্যা যেমন দিলেন, আলোর কণার নানা চরিত্র ও ধর্মের ব্যাখ্যাও এলো এই কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাহায্যে। পরে ১৯১৪ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী রবার্ট অ্যান্ড্রুজ মিলিক্যান পরীক্ষাগারে আইনস্টাইনের ব্যাখ্যার প্রমাণ দিলেন।

অন্যদিকে ৫ বছর পেরিয়ে এসেও প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব বৈজ্ঞানিক মহলে তেমন আলোড়ন ফেলতে পারেনি। কিন্তু আইনস্টাইন যখন এর ব্যবহার একবার দেখিয়ে দিলেন, তখন এটা নিয়ে হৈ চৈ শুরু হলো। গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে নীলস বোর পরমাণুর গঠন ব্যাখ্যা করতে গিয়েও আশ্রয় নিলেন কোয়ান্টাম তত্ত্বের। তখন থেকেই মূলত পদার্থবিজ্ঞানের এই নতুন শাখাটির পরিপূর্ণতার দিকে যাত্রা শুরু হয়।

৪.

আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব ব্যবহার করে করে যদি আলোক-তড়িৎক্রিয়া ব্যাখ্যা করা যায়, তাহলে দেখা যাবে কিছু ঝামেলা তৈরি হচ্ছে। আলোক-তড়িৎক্রিয়া সংঘঠিত হতে অনেক সময়ের প্রয়োজন, অনন্ত আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব সে কথাই বলে। কারণ আলো নিরবিচ্ছিন্ন শক্তির হলে অনেক্ষণ ধরে ইলেকট্রনের ওপর পড়লে হয়তো ইলেকট্রন উত্তেজিত হয়ে এক সময় ছিটকে বেরিয়েও যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে আলোক-তড়িৎক্রিয়া মুহূর্তের মধ্যেই সংঘঠিত হয় এবং ন্যানো সেকেন্ড সময় লাগে। এত কম সময়ে তরঙ্গের পক্ষে সম্ভব নয় আলোক-তড়িৎক্রিয়া ঘটানো।

আলো যদি কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুযায়ী ফোটন কণা হয়, তাহলে একটা ফোটন একটা মাত্র ইলেকট্রনকে আঘাত করবে। ইলেকট্রন ফোটন থেকে কিছু শক্তি ধার করে প্রবল বেগে বেরিয়ে যাবে ধাতব পরমাণু থেকে। এক্ষত্রে একটা ফোটনের শক্তি মাত্র একটা ইলেকট্রনই গ্রহণ করবে। অন্যকোনো ইলেকট্রনকে সেই শক্তির ভাগ সে দেবে না। তাই ইলেকট্রন সেই শক্তি নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে ছুটে বেরিয়ে যেতে পারবে। অন্য দিকে আলো যদি ফোটন কণা না হয়ে শুধু তরঙ্গ হয়, তাহলে তার নির্দিষ্ট কোনো আকার থাকে না। তরঙ্গের শক্তি ভাগ হয়ে যায় পরমাণুর সব ইলেকট্রনে। এর ফলে নির্দিষ্ট একটা ইলেকট্রন পরমাণুর বন্ধন মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসার জন্য পারে না পর্যাপ্ত শক্তির জোগান দিতে। সবগুলো ইলেকট্রনই শক্তিস্তরভেদে কমবেশি আলগা হয়ে যাওয়ার। তখন সর্বশেষ শক্তিস্তরের ইলেকট্রনকে অপেক্ষা করতে হয় আরেক ঝাঁক তরঙ্গ আসার অপেক্ষায়। এভাবে ক্রমাগত একের পর এক আলোর ঝাঁক এসে ধাতুর পৃষ্ঠতলের প্রতিটা পরমাণুর প্রতিটা ইলেকট্রনকে শক্তি জোগাতে লেগে যেত বহু সময়। সুতরাং তরঙ্গ তত্ত্বের সাহায্যে এ ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে আলোক-তড়িৎক্রিয়ার কালক্ষেপন না করার বৈশিষ্ট্য আলোর কোয়ান্টাম তত্ত্ব দিয়েই শুধু ব্যাখ্যা করা যায়।

আলোকে শুধু তরঙ্গ ধরে হিসাব করলে ইলেকট্রনের গতিশক্তি বাড়ানোর জন্য আলোর তীব্রতাও বাড়ানোর দরকার হবে। ধরা যাক, একটা ধাতুকে বেগুনি আলো দিয়ে আঘাত করা হচ্ছে। আলোটা অত জোরালো নয়। তাই আলোক তরঙ্গ গিয়ে ইলেকট্রনকে আঘাত করবে, তারপর সেটা বেরুবে, এর জন্য সময় লাগবে, একসময় ধীরে ধীরে ইলেকট্রন পরমাণু থেকে নির্গত হবে। যেহেতু তরঙ্গের শক্তি সব ইলেকট্রনের ভেতর ভাগ হয়ে যাচ্ছে, তাই একটা সময় এক সাথে অনেকগুলো ইলেকট্রন মুক্ত হবে। তরঙ্গের শক্তি ভাগ হয়ে যাচ্ছে বলে ইলেকট্রন অনুজ্জ্বল বেগুনি আলো থেকে। খুব দ্রুত গতিতে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত শক্তি পায় না। তাই অনুজ্জ্বল বা কম তীব্রতার আলোতে ইলেকট্রনের বেগ কম হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে আলোক-তড়িৎ ক্রিয়ায় সেটা ঘটে না।

নির্গত ইলেকট্রনের গতিবেগ বাড়াতে হলে, তরঙ্গ তত্ত্ব মতে আলোর উজ্জ্বলতা অর্থাৎ তীব্রতা বাড়াতে হবে। একই রঙের আলোর কম্পাঙ্ক সবসময় এক। সে অনুজ্জ্বলই হোক আর তীব্রই হোক। অর্থাৎ আলোর তীব্রতার সাথে কম্পাঙ্কের সম্পর্ক নেই। তাহলে তরঙ্গ তত্ত্ব অনুযায়ী ইলেকট্রনের গতিশক্তিও আলোর কম্পাঙ্কের ওপর নির্ভর করার কথা নয়। কিন্তু আলোক-তড়িৎক্রিয়ার পরীক্ষা বলছে ভিন্ন কথা। দেখা যায়, আলোর কম্পাঙ্ক বাড়ালেই কেবল ইলেকট্রনের গতিশক্তি বাড়ে। অর্থাৎ বেগুনি আলোর চেয়ে অতি বেগুনি আলোয় ইলেকট্রনের গতিশক্তি বেশি হয়। আলো উজ্জ্বল কি অনুজ্জ্বল, তার ওপর নির্ভর করে না ইলেকট্রনের গতিশক্তি।

কোয়ান্টাম তত্ত্ব বলে, একটা ফোটন যেহেতু একটা ইলেকট্রনকেই আঘাত করে। সুতরাং ফোটনের শক্তি যত বেশি হবে ইলেকট্রনের গতিশক্তি তত বেশি হবে। আলোর কম্পাঙ্ক বাড়লেই কেবল ফোটনের শক্তি বাড়ে। তাই ইলেকট্রনের গতিশক্তি নির্ভর করে আলোর কম্পাঙ্কের ওপর। অন্যদিকে আলোর তীব্রতা বাড়লে ফোটনের পরিমাণও বেশি হয়। আলোও তত উজ্জ্বল হয়। বেশি বেশি ফোটন বেশি বেশি ইলেকট্রনকে আঘাত করতে পারে। তাই নির্গত ইলেকট্রনের সংখ্যাও বাড়বে আলোর তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে। কিন্তু তরঙ্গ তত্ত্বে বলা হচ্ছে উল্টো কথা।

এটাই ছিল আলোক-তড়িৎক্রিয়ার জন্য আইনস্টাইনের দেওয়া ব্যাখ্যা। আর এই ব্যাখ্যা প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বকেই শুধু শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দেয়নি, আজ যে আমরা ডিজিটাল জীবন-যাপন করছি, এর পেছনে বড় ভূমিকা পালন করছে আলোক-তড়িৎক্রিয়া। টেলিভিশনে আমরা যে ছবি দেখি তা আলোক তড়িৎ-ক্রিয়ারই ফল। আজকের স্মার্টফোন, কম্পিউটার সবকিছুতেই আলোক-তড়িৎক্রিয়ার জয়জয়কার। আর এগুলো সম্ভবই হতো যদি না শুধু থট এক্সপেরিমেন্ট করেই আইনস্টাইন নামের সেই কেরানি যুবকটি আলোক-তড়িৎক্রিয়ার ব্যাখ্যা না দিতেন।

সূত্র: নিউ সায়েন্টিস্ট

r1 ad
r1 ad