খালেদা জিয়ার সঙ্গে জামায়াত আমিরের বৈঠকে আলোচনায় ২ দলের দূরত্ব\n
গত প্রায় ৯ মাসে দুই দলের শীর্ষ নেতাদের একে অন্যের বিরুদ্ধে সমালোচনা ও আক্রমণাত্মক বক্তব্যের বাইরে নীতিগত শক্ত অবস্থান ছিল জাতীয় নির্বাচনের তারিখ নিয়ে। জামায়াত চেয়ে আসছে আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন। বিএনপি চায় জরুরি কিছু সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ এবং সেটি কোনোভাবেই ডিসেম্বরের পরে নয়।
এর আগে অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ইস্যুতে দুই দলের বিরোধের মাঝখানে পড়ে যায়। এর মধ্যে প্রধানতম বিরোধ ছিল জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় নিয়ে। বিএনপির কঠোর অবস্থান ছিল আগে জাতীয় নির্বাচনের পক্ষে। অন্যদিকে জামায়াত সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ ইস্যুতেও দুই দলের পৃথক অবস্থান ছিল, যদিও সেটি ততটা প্রকাশ্য ছিল না।
দেশের রাজনীতিতে দীর্ঘ দিন ধরেই মিত্রতার সম্পর্কে আবদ্ধ ছিল বিএনপি ও জামায়াত। ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারে জামায়াত সঙ্গী ছিল। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতের নেতাদের বিচার প্রক্রিয়া শুরুর সময়ও বিএনপি পাশে ছিল জামায়াতের।
আওয়ামী লীগের দীর্ঘ দেড় দশকের শাসনামলে ভুক্তভোগী বিএনপি ও জামায়াতের মিত্রতা অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পরপরই বিরোধে রূপ নেওয়ার ঘটনা বিস্ময় ছড়িয়েছে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যে। তবে লন্ডনের বৈঠক দুই দলের মুখোমুখি সেই অবস্থানে পরিবর্তন এনেছে বলেই ধারণা বিশ্লেষকদের।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না রাজনীতি ডটকমকে বলেন, নির্বাচন প্রশ্নে জামায়াতের এখনকার অবস্থান দলটির একটি দৃশ্যমান পরিবর্তন তো বটেই। কারণ গতকালের আগে কেউ ভাবেনি যে নির্বাচন প্রশ্নে তারা এতটা সুনির্দিষ্ট বক্তব্য রাখবে।
এক প্রশ্নের জবাবে মান্না বলেন, লন্ডনে দুই দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে কী আলোচনা হয়েছে, তা জানি না। কিন্তু মিডিয়ায় যেসব খবর এসেছে তাতে দেখা যায়, দুই দলের মধ্যে বিদ্যমান দূরত্ব ও নির্বাচনের তারিখ নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে।
রাজনীতিতে এই বৈঠকের গুরুত্ব থাকার কথা উল্লেখ করে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মান্না বলেন, বিএনপি নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ দাবি করে আসছিল। এখন জামায়াতের অবস্থানও অনেকটা তাদের কাছাকাছি। এর ফলে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা নিয়ে এক ধরনের ঐক্য ও সরকারকে চাপ দেওয়ার পথ সুগম হতে পারে।
এক প্রশ্নের জবাবে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আমরা একটি কোয়ালিটি নির্বাচন চাই এবং এটি ডিসেম্বরের মধ্যেই করতে চাই। তিন মাস পরে নির্বাচন করলে দেশে অনেক কিছু হয়ে যাবে— বিষয়টি এমনও নয়।’
প্রথম থেকেই বিএনপি চাইছিল যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় নির্বাচন। তাদের অবস্থান ছিল, নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করেই সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে হবে।
অন্যদিকে জামায়াতের দাবি ছিল, আওয়ামী লীগের বিচার ও রাষ্ট্রীয় সংস্কার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন নয়। সংসদ নির্বাচন আর স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কোনটি আগে হবে, তা নিয়েও সুস্পষ্ট বিপরীতমুখী অবস্থান ছিল দল দুটির। এসব মতপার্থক্যের ফলে দুই দলের দীর্ঘদিনের মৈত্রীতে ফাটল ধরতে শুরু করে।
এ ফাটল প্রকাশ্যে আসে দুই দলের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যে। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান একবার তীব্র ভাষায় বিএনপিকে আক্রমণ করে বলেন, ‘একজন চাঁদাবাজ পালিয়েছে, আরেকজন চাঁদাবাজিতে লেগে গেছে।’ কোনো নাম উল্লেখ না করলেও জামায়াতের আমিরের এ বক্তব্যকে স্পষ্টতই বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত হিসেবেই দেখেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিএনপি নেতারাও চুপ থাকেননি। তারা একাত্তরের ভূমিকার প্রসঙ্গ টেনে জামায়াতকে রাজনৈতিকভাবে ‘অপাঙ্ক্তেয়’ আখ্যা দেন। কিছু নেতা বলেন, যাদের একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান ছিল, তারা এখন সংস্কারের কথা বলে জাতীয় নির্বাচনে দেরি করাতে চায়।
গত বছরের আগস্টের পর জামায়াতের নেতাকর্মীরা সামাজিক মাধ্যমে বিএনপির বিরুদ্ধে একের পর এক পোস্ট দেন। বিশেষত টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজির নানা অভিযোগের কথা তারা তুলে ধরেন।
প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির সিনিয়র নেতারাও চুপ থাকেননি। দলের একাধিক নেতা একাত্তরের প্রসঙ্গ টেনে জামায়াতের ওপর দায় চাপাতে শুরু করেন। এক নেতা বলেন, ‘যাদের হাতে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের রক্ত লেগে আছে, তারা কি আজ সংস্কারের মুখপাত্র হতে পারে?’
এদিকে জামায়াত নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে মত দেয়। বিএনপি এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়। বিএনপি নেতাদের মতে, এ ধরনের অবস্থান মূলত সরকারের সময়ক্ষেপণের কৌশলকে প্রশ্রয় দেয় এবং জাতীয় নির্বাচন পেছানোর পটভূমি তৈরি করে।
গণ অভ্যুত্থানে কৃতিত্ব নিয়েও পালটাপালটি অবস্থান নেয় দল দুটি।
বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ার পর আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য ইসলামপন্থি দলগুলোকে নিয়ে মৈত্রী গড়ার চেষ্টা শুরু করে জামায়াত। একইভাবে বিএনপিও তৎপর হয় নির্বাচনি যাত্রায় ইসলামপন্থিদের পাশে পেতে।
এই টানাপোড়েনের মধ্যেই ১৩ এপ্রিল লন্ডনে তারেক রহমানের বাসায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান। তারেক রহমানও সাক্ষাতের সময় উপস্থিত ছিলেন।
শফিকুর রহমান বলেছেন, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেওয়াই ছিল এ সাক্ষাতের মূল উদ্দেশ্য। সে সাক্ষাতে রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ আলোচনায় উঠে এলেও সিদ্ধান্তমূলক কোনো আলোচনা হয়নি। এ সাক্ষাৎ অনানুষ্ঠানিক ছিল জন্যই কোনো দলের পক্ষ থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে এটি নিয়ে কিছু জানানো হয়নি।
পত্রপত্রিকার খবর অবশ্য বলছে, ১৩ এপ্রিল দুই দলের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে সাম্প্রতিক বিরোধ ও দূরত্ব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকে জাতীয় নির্বাচনের বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
জামায়াতের মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বলেছেন, লন্ডনে এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে আগামীতে দুই দলের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে।
তবে আলোচনা যাই হোক, ওই বৈঠকের পরই পালটে যায় মাঠের পরিস্থিতি। দীর্ঘদিন সংস্কারে অনড় থাকা জামায়াত হঠাৎ করেই নির্বাচনের সুরে কথা বলতে শুরু করে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, এটা তাদের মধ্যে মতপার্থক্য কমিয়ে আনার একটি চেষ্টা হতে পারে। তেমন হলে এর প্রভাব বোঝা যাবে কয়েক দিন পর। দেখতে হবে ওই সময় তারা পরস্পরের প্রতি বিষোদগার করছে কি না। বিষোদগার কমে এলে বুঝতে হবে, এর পেছনে ওই সাক্ষাৎ ভূমিকা রেখেছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে ১৯৯৯ সালে জোট বাঁধে জামায়াত। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় ঐক্যজোট রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসার পর থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে দল দুটির মধ্যে কিছু টানাপোড়েন হলেও জোট নিয়ে সংকট তৈরি হয়নি।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এক সঙ্গে অংশ নেয় দল দুটি। ২০২২ সালে দল দুটি জোট ভেঙে দিয়ে সরকার পতনের যুগপৎ আন্দোলনে শুরু করে। তবে শেখ হাসিনার পতনের এক মাসের মাথায় নানা ইস্যুতে দল দুটির মতবিরোধ রাজনীতির মাঠে আলোচনার অন্যতম বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
তবে জামায়াতের অবস্থান বদলে বিএনপির মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ নির্বাচনের তারিখ ইস্যুতে বিএনপি রাজনীতির মাঠে অনেকটাই একা হয়ে পড়ছিল। ইসলামী আন্দোলন, হেফাজত, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মতো দলগুলোর অবস্থান ছিল— সংস্কার আগে, নির্বাচন পরে। একমাত্র বিএনপিই ছিল বিপরীত মেরুতে।
জামায়াতের এই অবস্থান বদলের পর ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও ঘোষণা দিয়েছে, তারা চায় ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নির্বাচন শেষ হোক। তাদের মতে, ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর সেপ্টেম্বরে সেনাবাহিনী প্রধান যে ১৮ মাসের রূপরেখা দিয়েছিলেন, তা আগামী ফেব্রুয়ারিতে পূর্ণ হবে।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে বলেন, আগামী ১৮ মাসের মধ্যে যেন নির্বাচন হতে পারে, সে জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো সম্পন্ন করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলও একই সুরে বলেছেন, নির্বাচন জুনের মধ্যে হলেও চেষ্টা থাকবে ডিসেম্বরে তা শেষ করার।
এসব অবস্থান ইঙ্গিত দেয়, সরকার, বিভক্ত রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো ধীরে ধীরে একটি অভিন্ন রূপরেখার দিকে যাচ্ছে। যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্ক নির্ভর করবে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আসা বা না আসা নিয়ে। এখনো ধারণা করা হয়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অবাধ সুযোগ দেওয়া হলে তারা বিরোধী দলের ভূমিকায় আসীন হতে পারে। সেক্ষেত্রে জামায়াতের সংসদে বিরোধী দল হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যায়।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে জামায়াত বা এনসিপি ভালো করতে না পারলে বরং তারা দুর্বল ও রাজনীতিতে গুরুত্বহীন হবে। সরকারের সঙ্গে মিলেমিশে জামায়াত ও এনসিপি এখন তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে।
তাছাড়া রাজনৈতিক অঙ্গনে নির্বাচনের দাবি যেমন আছে, তেমনি নির্বাচন যেন না হয় সেজন্য নানা অপতৎপরতাও রয়েছে।
আপাতদৃষ্টিতে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে সমঝোতার আভাস মিললেও বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি কৌশলগত ঐক্য হতে পারে। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এটি বজায় থাকবে। কিন্তু নির্বাচনের পরে রাজনৈতিক লাভ-লোকসান বুঝে আবারও টানাপোড়েন দেখা দিতে পারে।