বিচার চাইলেন স্বজনরা, কাঁদলেন অতিথিরাও

প্রতিবেদক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৫, ০১: ০০
মঙ্গলবার রাজধানীর চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের শোক ও বিজয়ের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করে বিএনপি। ছবি: ফোকাস বাংলা

এক বছর আগের জুলাই। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের আন্দোলন তখন স্বৈরাচার-ফ্যাসিস্ট সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে। রাজপথ তখন ছাত্র-জনতার দখলে। সরকারি বাহিনীও দেদারছে গুলি ছুড়ছে মানুষের ওপর। সেসব গুলি বুকে-পিঠে বরণ করে নিয়ে প্রাণ দিয়েছেন অনেকে। অমানুষিক নির্যাতনের পর কারও কারও প্রাণ গেছে হাসপাতালে। গত বছরের সেই জুলাই অভ্যুত্থানে এভাবেই হারিয়েছে সহস্র প্রাণ।

জুলাই অভ্যুত্থানের এসব শহিদদের পরিবারের সম্মানে বিশেষ আলোচনা সভা আয়োজন করেছিল বিএনপি। দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে যারা আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলে যারা গুম-খুনের শিকার হয়েছেন, তাদের পরিবারও এ আয়োজনে অংশ নেয়।

স্বজন হারানো এসব পরিবারের সদস্যরা অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন প্রিয় মানুষগুলোকে হারানোর বেদনার কথা। কীভাবে তারা প্রাণ হারিয়েছেন কিংবা গুমের শিকার হয়েছেন— এমন বেদনাবিধূর সব ঘটনা উঠে আসে তাদের বয়ানে। হত্যার বিচার চেয়ে কেউ কেঁদেছেন, কেউ আবার গুম হওয়া সন্তান-স্বামী-পিতার অপেক্ষায় থাকার কষ্টের কথা তুলে ধরেছেন। হৃদয়বিদারক এসব ঘটনার বর্ণনায় অনুষ্ঠানস্থলের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। উপস্থিত অতিথিরাও কেউ অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি।

মঙ্গলবার (১ জুলাই) বিকেলে রাজধানীর চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের শোক ও বিজয়ের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে এ বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করে বিএনপি।

গুম হওয়া ছাত্রদল নেতা পারভেজের কিশোরী মেয়ে রিধি বাবাকে কাছে না পাওয়ার কষ্টের কথা তুলে ধরে অনুষ্ঠানে। রিধি বলে, অনেক বছর হলো আমি আর আমার ছোট ভাই বাবাকে দেখতে পাইনি। আমি আর আমার ভাই বাবাকে কি কোনোদিন জড়িয়ে ধরতে পারব না?

রিধির বেদনামাখা এমন আকুতিতে উপস্থিত সবার চোখ ভিজে ওঠে। ‘জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’ শীর্ষক এ অনুষ্ঠানে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত তারেক রহমানকে পর্যন্ত চোখ মুছতে দেখা যায়।

BNP Pgogram On July Commomoration 01-07-2025 (3)

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপি চেয়ারপরসন খালেদা জিয়া। তার ভিডিওবার্তা প্রচার করা হয়। ছবি: ফোকাস বাংলা

অনুষ্ঠানের শুরুতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ভিডিওবার্তায় বক্তব্য দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ভার্চুয়ালি যুক্ত থেকে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও শীর্ষ নেতারা। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে জাতীয় নেতাদের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহিদসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে গুম-খুন-নিপীড়নের শিকার পরিবারগুলোর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াতের পর শহিদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন ও জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপরই ফ্যাসিবাদী শাসনের ছায়ায় হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের স্মৃতি ও অভ্যুত্থানে শহিদদের গল্প উঠে আসে মঞ্চে। এ সময় জুলাই অভ্যুত্থানে শহিদদের পরিবারের সদস্যসহ আহতরা অভিযোগ করে বলেন, তাদের আন্দোলনে নতুন বাংলাদেশ পেলেও তাদের পরিবারের পাশে অথবা তাদের চিকিৎসায় তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।

অন্তর্বর্তী সরকার ও জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া সমন্বয়কদের কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে এ সময় শহিদ পরিবারের সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কেউ আবার ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে সংসদের উচ্চকক্ষ (প্রস্তাবিত) ও নিম্ন কক্ষে নিজেদের প্রতিনিধিত্বও চেয়েছেন।

জুলাই অভ্যুত্থানে সাভারে শহিদ হওয়া ইয়ামিনের বাবা মহিউদ্দিন বলেন, শান্তির স্বার্থে শুধু সংসদের উচ্চকক্ষের নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে হওয়া উচিত। আগামী নির্বাচনে জুলাইয়ের শহিদ পরিবার থেকে সংসদের উচ্চ ও নিম্নকক্ষে ১০ জন প্রতিনিধি মনোনয়নের আশা করেন বলে জানান তিনি।

গুম হওয়া বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন ও ‘মায়ের ডাক’র আহ্বায়ক সানজিদা ইসলাম তুলি বলেন, আমাদের অনেক বাধা অতিক্রম করে আজ এখানে আসতে হয়েছে। বিগত সময়ে যত গুম-খুন হয়েছে, জুলাইয়ে আমাদের ছাত্র-জনতা, কৃষক-মজুর সবার আত্মত্যাগের মাধ্যমে এখানে আমরা এসেছি।

BNP Pgogram On July Commomoration 01-07-2025 (1)

লন্ডন থেকে ভার্চুয়লি যুক্ত হয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ছবি: ফোকাস বাংলা

তুলি আরও বলেন, ভিক্টিমদের পক্ষ থেকে আমাদের দাবি— গুমের মহাকৌশলে যারা যুক্ত ছিলেন, যাদের মদতে আয়নাঘরে আমাদের ভাইদের ধরে নেওয়া হয়েছে ও নির্যাতন করা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের হত্যার বিচার আমরা চাই। যতদিন আমাদের শরীরে রক্ত আছে, আমরা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমৃত্যু লড়বো।

আওয়ামী লীগের আমলে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের হাতে নিহত বিশ্বজিৎ দাসের বাবা বলেন, আমার ছেলেকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে, এর বিচার এখনো হয়নি।

বুয়েটে ছাত্রলীগের হাতে নিহত আবরার ফাহাদের বাবা বলেন, আমার ছেলের হত্যার বিচার আমি এখনো পাইনি। কী অপরাধ ছিল আবরার ফাহাদের? সে দেশের পক্ষে কথা বলায় তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের হত্যাকাণ্ড আর না ঘটে। নতুনভাবে দেশটাকে স্বাধীন করা হয়েছে, এই স্বাধীনতা যেন অব্যাহত থাকে।

জুলাই আন্দোলনের ঢাকায় প্রথম শহিদ ফারহান ফাইয়াজের বোন বলেন, আমার ভাই ২৮ জুলাই শহিদ হয়। সে ছিল ঢাকার প্রথম শহিদ। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আমরা যে বিজয় এনেছি, তা আমরা ধরে রাখতে পারছি কি না, তা প্রশ্ন থেকে যায়।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, জুলাইয়ে দলমত নির্বিশেষে প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু এক বছর পর আমার মনে হয় সেই ঐক্য ধরে রাখতে পারছি না। এই বিপ্লবের ফলে আমাদের আশা ছিল নতুন কিছু দেখতে পাব। স্বৈরাচার হাসিনা যত অপকর্ম করেছে, এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার আমরা দেখতে চাই।

গণঅভ্যুত্থানে প্রথম শহিদ আবু সাঈদের বড় ভাই বলেন, আবু সাঈদ বুক পেতে দেশের সবার সাহস জুগিয়েছিল, তাই ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। শহিদ পরিবারের পাশে থাকার জন্য তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

ad
ad

ঘরের রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

বড় দল হিসেবে বিএনপির দায়িত্ব অনেক, স্যাক্রিফাইসটাও বেশি: তারেক রহমান

সংস্কার প্রশ্নে বিএনপি ছাড় দিয়েছে জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, সংস্কার প্রস্তাবনা নিয়ে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করছে সরকার। প্রত্যেকটি দলেরই নিজস্ব আদর্শ ও লক্ষ্য রয়েছে। কিছু মিডিয়ার বিএনপি সংস্কার মানছে না, এমনটা বলা হচ্ছে। কিন্তু সত্যটা হলো সংস্কার প্রশ্নে বিএনপি অনেক বিষয়ে ছাড় দিয়ে

২০ ঘণ্টা আগে

জুলাই অভ্যুত্থানের সেই ঐক্য কোথায়?

কেন সেই ঐক্যের দেখা মিলছে না— এমন প্রশ্নে এককভাবে বিএনপির দায় দেখছে জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। বিএনপি আরও আলোচনায় ঐক্যের সম্ভাবনা দেখছে। আর রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বার্থের সংঘাতের কারণেই ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না।

১ দিন আগে

শহিদদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও গুম-খুনের দ্রুত বিচার চাইলেন খালেদা জিয়া

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, রক্তস্নাত জুলাই-আগস্ট আমাদের মাঝে একবছর পর ফিরে এসেছে। দীর্ঘ ১৬বছর ফ্যাসিস্টদের নির্মম অত্যাচার, নির্যানতন, গ্রেফ্তার, খুন-গুমের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য চেয়েছিলো আওয়ামী লীগ শাসকগোষ্ঠী।

২ দিন আগে

পিআর নির্বাচনব্যবস্থা কতটা উপযোগী, ভেবে দেখতে বললেন তারেক রহমান

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা শক্ত ভিত্তির ওপর রাখতে হলে জনগণের ঐক্য সবচেয়ে বেশি দরকার উল্লেখ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনীব্যবস্থার আড়ালে আবার দেশের রাজনীতিতে ফ্যাসিস্ট পুনর্বাসনের পথ সুগম করে দেওয়া হচ্ছে কি না, তা সবার গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার। নিত্যনতুন ইস

২ দিন আগে