রাস্তার কাজ শেষ না করেই সাড়ে ৬ কোটি টাকার পূর্ণ বিল নিয়ে ঠিকাদার উধাও

টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলায় রাস্তার কাজ শেষ না করেই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) কর্মকর্তাদের যোগসাজশে চূড়ান্ত বিল জমা দিয়ে ঠিকাদারের টাকা তুলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের ভিত্তিতে সরেজমিনে তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রাথমিক তদন্তে কাজ না করে টাকা আত্মসাতের সত্যতাও মিলেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নাগরপুর উপজেলার গয়হাটা ও দপ্তিয়র ইউনিয়নের দুটি কাজ শেষ না করেই ছয় কোটি ৬০ লাখ টাকার পুরো বিল নিয়ে উধাও হয়ে যান ঠিকাদার ও প্রকৌশলী। রোববার (২০ এপ্রিল) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ ঘটনার তদন্ত করেছে দুদক। এ সময় রাস্তাগুলোর বিভিন্ন জায়গায় খনন করে কাজে ব্যবহৃত মালামাল পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপ করে দুদক।
এ ছাড়া এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়েও রাস্তার কাজের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখেন দুদক কর্মকর্তারা। কাজগুলোর কীভাবে করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, এসব বিষয়ও পর্যালোচনা করেন তারা।
টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলায় এমআরআর আইডিপি প্রকল্পের আওতায় দপ্তিয়ার ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তেবাড়িয়া রাস্তার ১৬০০ মিটার বিটুমিন/ পিচ ঢালাই (বিসি) এবং তিনটি বক্স কালভার্ট নির্মাণের কথা ছিল। ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে এই কাজ শুরু করে এক বছরে শেষ করার জন্য দুই কোটি ২০ লাখ টাকা নির্ধারণ করে এলজিইডির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় টাঙ্গাইল শহরের পাড়দিঘুলিয়ার ফ্রেন্ডস কনস্ট্রাকশন নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কয়েক দফায় নামমাত্র কিছু নিম্নমানের খোয়া ফেলে ঠিকাদার আর ওই এলাকা মাড়াননি। রাস্তার কাজও স্বাভাবিকভাবেই শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। রাস্তার দশা আগের মতোই বেহাল।

দুদক কর্মকর্তারা সরেজমিনে প্রকল্পগুলোর কাজ খতিয়ে দেখেন। ছবি: রাজনীতি ডটকম
এদিকে দেলদুয়ার উপজেলায় আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এবং শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটুর নিজ ইউনিয়ন ও মামার বাড়ি গয়হাটায় একই প্রকল্পের আওতায় ৩ দশমিক ৬২ কিলোমিটার রাস্তার কাজ অসমাপ্ত রেখেই উধাও হয়ে যান ঠিকাদার।
অন্যদিকে গয়হাটা থেকে ভারড়া রাস্তায় পিচ ঢালাই (বিসি) করার জন্য ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু করে এক বছরে শেষ করার জন্য চার কোটি ৪০ লাখ টাকায় এলজিইডির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় সৈয়দ মুজিবুর রহমান অ্যান্ড অবনী এন্টারপ্রাইজ নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ৫ আগষ্টের পর থেকে এ প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদার হেকমত পলাতক।
গয়হাটা-ভারড়া রাস্তায় পিচ ঢালাইয়ের পাশাপাশি তিনটি বক্স কালভার্ট নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু এর কিছুই এখনো বাস্তবতার দেখা পায়নি।
এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, কাজ প্রায় পুরোটাই বাকি থাকলেও ২০২৩ সালের জুনে দুটি কাজেরই চূড়ান্ত বিল দিয়ে দেওয়া হয়েছে ঠিকাদারদের। দপ্তিয়রের রাস্তার চূড়ান্ত বিল ও পারফরম্যান্স সিকিউরিটিও ফেরত দেওয়া হয়েছে।
গয়হাটা ইউনিয়নের আরেকটি রাস্তায় ১৩০০ মিটার কাজ করার থাকলেও সরেজমিনে অস্তিত্ব পাওয়া যায় ১১০০ মিটারের। দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, এসব কাজে আইএসজি ঠিক থাকলেও সাব-বেজ ও ডব্লিউএমবির কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার ও থিকনেস কম পাওয়া গেছে বলে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, টাঙ্গাইল জেলার এলজিইডির সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, নাগরপুর উপজেলার সাবেক প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান ও উপসহকারী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলামের যোগসাজশে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সঠিক কাজ না করেই বিল উত্তোলন করেন।
দুদক সূত্র আরও বলছে, প্রকল্পের কাজ আংশিক বাস্তবায়ন করে কাজের চূড়ান্ত বিল তুলে নেওয়ার প্রাথমিক প্রমাণ মিলেছে। এ ছাড়া প্রকল্পের যতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে তার মানও সন্তোষজনক নয়। আংশিক সেই কাজে নিচে বালুর স্তর ঠিক পাওয়া গেলেও খোয়া-বালু থিকনেস অনেক কম। নিম্নমানের খোয়া পাওয়া গেছে। আরেক প্রকল্পে আংশিক কাজ করে বিধি বহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত বিল দেওয়ার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে।
জানতে চাইলে নাগরপুর উপজেলা এলজিইডির প্রকৌশলী তোরাব আলী বলেন, আমি নতুন এসেছি। আমি এসব জানি না। তবে ঊর্ধ্বতনের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত এ কাজগুলো করার ব্যবস্থা করব।
টাঙ্গাইল জেলা দুদকের সহকারী পরিচালক মো. নূর আলাম বলেন, এলজিইডির কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিল তুলে আত্মসাৎ করার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে প্রকৌশলীর উপস্থিতিতে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট রাস্তা দুটি সরেজমিনে পরিমাপ গ্রহণ করা হয় এবং সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়। অভিযানে টাকা আত্মসাতের সত্যতা পাওয়া গেছে। পরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।