রাখাইনে ‘করিডোর’ ইস্যুতে তীব্র প্রতিক্রিয়া, সরকারের নতুন ব্যাখ্যা\n
যে প্রশ্নগুলোর সরাসরি উত্তর সরকার দিচ্ছে না তা হলো— জাতিসংঘ বাংলাদেশকে এই মানবিক করিডোর দিতে প্রস্তাব দিয়েছে কি না, সেটি নিশ্চিত নয়। আবার জাতিসংঘ এই করিডোর দেওয়ার কথা বললেও তাতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী দেশগুলো রাজি কি না, সে বিষয়ে কোনো তথ্য জানা নেই। করিডোরের শর্তগুলোও সরকার স্পষ্ট করেনি।
এর মধ্যে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের কমিশনার মিজানুর রহমান মঙ্গলবার বলেছেন, ইউএনএইচসিআর তাকে অতিরিক্ত এক লাখ রোহিঙ্গার জন্য বাড়িঘর তৈরির অনুরোধ করেছে। এরা মিয়ানমারে যুদ্ধ শুরুর পর বাংলাদেশে এসেছেন আরাকান আর্মির নির্যাতনের শিকার হয়ে। প্রশ্ন উঠছে, রাখাইনে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের অল্পসংখ্যকই ওখানে থাকতে পারছেন। তাহলে এই মানবিক সহায়তা আসলে কার জন্য?
গত রোববার (২৭ এপ্রিল) বিকেলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে শর্তসাপেক্ষে মিয়ানমারের বেসামরিক জনগণের জন্য করিডোর দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা জানান। এ নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
একদিনের মাথায় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, মানবিক করিডোর নয়, বরং রাখাইনে জাতিসংঘ সহায়তা দিতে চাইলে সেটা পৌঁছাতে পরিবহনসহ লজিস্টিক সহযোগিতা দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ নীতিগত সম্মতি দিয়েছে।
মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) বিষয়টি ব্যাখ্যা করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম নিজের ফেরিফায়েড ফেসবুকে লিখেছেন, কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ‘মানবিক করিডোর’ স্থাপন নিয়ে জাতিসংঘ কিংবা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো আলোচনা হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমাদের অবস্থান হলো— যদি জাতিসংঘের নেতৃত্বে রাখাইনে মানবিক সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়, তবে বাংলাদেশ সে ক্ষেত্রে যৌক্তিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্যের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের বক্তব্যের এই ভিন্নতার কারণ হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা ও উদ্বেগের কথা বলা হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো রাজনৈতিক দল মনে করছে, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে রাখাইনে মানবিক করিডোর দেওয়ার বিষয়টি অন্তবর্তী সরকারের কাজ নয়। বিশেষ পরিস্থিতিতে যদি এমন কিছু করতেও হয়, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য দরকার।
দলগুলোর শীর্ষস্থানীয় নেতারাও বলছেন, করিডোর দেওয়ার সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা, প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক, রোহিঙ্গা সংকটসহ অনেকগুলো বিষয় যুক্ত। ফলে সরকারের একার পক্ষে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সমীচীন হবে না।
রাজনৈতিক নেতাদের এমন বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ রাজনীতি ডটকমকে বলেন, করিডোর দেওয়ার সিদ্ধান্ত অন্তবর্তী সরকারের কাজ না। মানুষ এই সরকারের কাছে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন, জরুরি সংস্কার ও হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্রের পথচলার শুরুটা দেখতে চায়।
রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের অনেকে এ-ও মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার এমন জাতীয় স্পর্শকাতর বিষয়ে একক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘মানবিক করিডোর দেওয়ার মতো এত বড় উদ্যোগ সরকার কেন নিয়েছে, তা জানতে পারলে ভালো হতো। এখানে দেশের স্বার্থ নাকি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত, তা বুঝতে হবে।’
মাহমুদুর রহমান মান্না কিছুটা জানাবোঝার কথা বললেও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব সরকারকে দিতে নারাজ। প্রিন্স রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘অনির্বাচিত এই সরকার এমন অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেই পারে না। এমনকি নির্বাচিত সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিতে চাইলেও তা নিয়ে রাজনৈতিক দল, বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা, যুক্তি-তর্ক ও ঐক্যের প্রয়োজন অনিবার্য।’
প্রেস সচিব শফিকুল আলম অবশ্য বলেছেন, সরকার সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। যথাসময়ে এ বিষয়ে দেশের অংশীজনদের (স্টকহোল্ডার) সঙ্গে আলোচনা করা হবে। তার মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে রাখাইনে সহায়তা পৌঁছানোর একমাত্র কার্যকর রুট বাংলাদেশ। এ পথে ত্রাণ পৌঁছে দিতে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে যৌক্তিক সহায়তা দিতে সম্মত। তবে রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠানোর বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
এর আগে রোববার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের জানান, নীতিগতভাবে সরকার মানবিক করিডোর দিতে সম্মত। কারণ এটি একটি হিউম্যানিটেরিয়ান প্যাসেজ (ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর জন্য করিডর)। এ বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কিছু শর্তের কথা উল্লেখ করলেও সেগুলো বিস্তারিত বলেননি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেন, সেসব শর্তাবলি পূরণ হলে অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করা হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবার আগে এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক প্রতিক্রিয়ায় সোমবার বলেন, হিউম্যানিটিরিয়ান প্যাসেজ (মানবিক করিডোর) নিয়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসে নেওয়া উচিত ছিল। এ ধরনের সিদ্ধান্তে দেশের ‘স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে’ পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
জামায়াত ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানও এ বিষয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। জানতে চাইলে জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র মো. আতাউর রহমান সরকার রাজনীতি ডটকমকে বলেন, জামায়াতের আমিরের ফেসবুক স্ট্যাটাসই এ বিষয়ে দলের অবস্থান।
‘রাখাইনের সঙ্গে মানবিক করিডরের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। এ বিষয়টি জাতির সামনে স্পষ্ট করা দরকার। কারণ এর সঙ্গে অনেক নিরাপত্তা বিষয় জড়িত থাকতে পারে,’— ওই পোস্টে বলেন শফিকুর রহমান।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্য সচিব আলাউদ্দিন মোহাম্মদ নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে লিখেছেন, ‘অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের জাতীয় নিরাপত্তামূলক নীতি গ্রহণে অবশ্যই ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। আলোচনা ছাড়া এ ধরনের সিদ্ধান্তে অন্তবর্তীকালীন সরকারের ইনটেগ্রিটি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।’
মিয়ানমারের যে রাজ্য রাখাইনে করিডোর দেওয়া নিয়ে এত আলোচনা, জাতিসংঘ বলছে গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত সেই রাজ্যটি দুর্ভিক্ষের দিকে যাচ্ছে। গত ৭ নভেম্বর এ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে জাতিসংঘ সেখানে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে বাংলাদেশকে ‘মানবিক করিডোর’ দেওয়ার অনুরোধ করেছিল।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে, আমাদের কাছে করিডোরের বিষয়টি পরিষ্কার নয়। কারণ এ বিষয়টি সেভাবে সামনে আসেনি বা আলোচনা হয়নি। তাই এ সিদ্ধান্ত বেশকিছু প্রশ্ন তৈরি করেছে, যার জবাব সরকারকে দেওয়া উচিত।’
এদিকে করিডর জাতিসংঘ করলেও এতে যুক্তরাষ্ট্র, চীন বা ভারত কিংবা এমন আরও কোনো শক্তি যুক্ত আছে কি না, তা এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয় এবং এ নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের উদ্বেগ রয়েছে। তবে করিডর দেওয়ার বিষয়ে একটি বড় শক্তির সংশ্লিষ্টতা নিয়ে যা বলা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও কল্পিত অপপ্রচার বলে দাবি করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব।
তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে ধারাবাহিক মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারণা চালানো হয়েছে, এটি তারই অংশ। এ ধরনের অপপ্রচার আমরা আগেও দেখেছি, এখনো চলছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তো স্বাভাবিক না, সেখানে দুটি শক্তিশালী পক্ষ। আবার আরাকান আর্মির সঙ্গে আমরা সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কথা বলছি। সেটি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী হয়তো ভালোভাবে দেখবে না। তাই সেনাবাহিনী বা আরাকান আর্মি করিডোর দেওয়ার এই উদ্যোগকে পছন্দ নাও করতে পারে।’
রুহিন হোসেন প্রিন্স মনে করেন, মিয়ানমার ঘিরে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর নানা তৎপরতা ও স্বার্থ রয়েছে। ‘মানবিক করিডোর’ দেওয়ার নামে এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত এখনই এমন সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেলও এক যৌথ বিবৃতিতে এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্যের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘মানবিক করিডোর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এ বিষয়ে বিশদ আলাপ আলোচনা ও ঐক্যমত্য প্রয়োজন। কারণ এর সঙ্গে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তার গুরুতর বিষয় যুক্ত।’
মিয়ানমারের রাখাইনে ‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে সরকারের একক সিদ্ধান্ত অপরিণামদর্শী ও হঠকারিতা বলে মঙ্গলবার এক বার্তায় উল্লেখ করেছে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনও।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ফর্টিফাই রাইটস গত ১২ মার্চ বলেছিল, বাংলাদেশ সরকার ও আরাকান আর্মির উচিত রাখাইন রাজ্যে সংঘাতকবলিত সাধারণ মানুষের কাছে মানবিক সহায়তা দ্রুত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ১৩ থেকে ১৬ মার্চ বাংলাদেশ সফরের ঠিক আগে মানবাধিকার সংগঠনটি এই বিবৃতি দেয়।
এদিকে জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করতে গিয়ে রাখাইনে মানবিক সহায়তার জন্য করিডোর চালু করতে জাতিসংঘের পক্ষে বাংলাদেশের কাছে প্রস্তাব দেন। এরই ধারাবাহিকতায় রোববার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানালেন, সরকার হিউম্যানিটারিয়ান প্যাসেজ বা মানবিক করিডোরের প্রস্তাবে নীতিগত সম্মতি দিয়েছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে অমানবিক অবস্থায় বসবাস করছেন, যাদের বেশিরভাগই ২০১৭ সালে পার্শ্ববর্তী মিয়ানমারে সামরিক অভিযানের মুখে পালিয়ে এসেছেন।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, ‘বাংলাদেশ এরই মধ্যে মানবিক করিডোর হয়ে আছে বলেই লাখ লাখ রোহিঙ্গা আসতে পেরেছে। এখন আনুষ্ঠানিক করিডোর হলে সেখানে তাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি সরকারকে আগে নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এমন কোনো উদ্যোগ তো দৃশ্যমান নয়। বরং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে না। তাহলে আমরা কীভাবে জানব প্রকৃতপক্ষে কী হচ্ছে? সবার আগে করিডোরের উদ্দেশ্য ও শর্তগুলো পরিষ্কার করা প্রয়োজন।’