গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন
নবম গ্রেডে বেতন-ঢাকা ভাতাসহ সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের সুরক্ষায় ২০ খাতে সুপারিশ

সাংবাদিকদের চাকরির শুরুতেই সরকারি চাকরির নবম গ্রেডের সমান বেতন, সাংবাদিক হতে হলে ন্যূনতম স্নাতক শিক্ষাগত যোগ্যতা, মূল্যস্ফীতি অনুযায়ী বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি— সাংবাদিকদের সুরক্ষা ও আর্থিক নিরাপত্তায় এমন নানা সুপারিশ করেছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন। সারা দেশের সব সাংবাদিকের জন্য সমান বেতনের প্রস্তাবের পাশাপাশি জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনায় ঢাকায় কর্মরতদের জন্য ‘ঢাকা ভাতা’র সুপারিশও করা হয়েছে।
কেবল সাংবাদিকদের সুরক্ষা নয়, সার্বিকভাবে গণমাধ্যম খাতের সংস্কারের সুরক্ষার জন্যও নানা সুপারিশ তুলে ধরেছে এই কমিশন। তার মধ্যে একই মালিকানায় একাধিক গণমাধ্যম না রাখা, পত্রিকাগুলোর সরকারি বিজ্ঞাপনের হার যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ, স্বাধীনভাবে সাংবাদিকদের ইউনিয়ন পরিচালনা, গণমাধ্যমের প্রকাশক ও সম্পাদকের যোগ্যতা নির্ধারণ, বিনা বেতনে কোনো সাংবাদিককে নিয়োগ না দেওয়া— এ রকম নানা সুপারিশ উঠে এসেছে কমিশনের প্রতিবেদনে।
শনিবার (২২ মার্চ) প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এসব সুপারশিসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন। দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদসহ অন্য সদস্যরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনটি পড়ুন এখানে—
প্রতিবেদনে বাসস, পিআইবি, জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র টেলিভিশন ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা নিয়েও সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া ভুয়া বা অপতথ্য মোকাবিলা, গণমাধ্যমে জেন্ডার ও সমতা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে আদিবাসী ও প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য সমান সুযোগ তৈরির সুপারিশ।
গণমাধ্যম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ‘জাতীয় গণমাধ্যম কমিশন অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর সংশোধনীর একটি খসড়াও যুক্ত করা হয়েছে প্রতিবেদনের সঙ্গে। যুক্ত করা হয়েছে সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫-এর একটি সংশোধিত খসড়া।
প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর যমুনার সামনে সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
কামাল আহমেদ বলেন, সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা দরকার। বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসে প্রবেশপদ, অর্থাৎ নবম গ্রেডের বেতন স্কেলের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সাংবাদিকদের প্রবেশপদের বেতন হতে পারে। সারা দেশের সাংবাদিকদের জন্য এটি হতে পারে। তবে ঢাকায় যেহেতু জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি, সে ক্ষেত্রে ঢাকার সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে ‘ঢাকা ভাতা’ যোগ করা হতে পারে। সারা দেশে সাংবাদিকেরা যে বেতন পাবেন, ঢাকার ক্ষেত্রে এই ভাতা যোগ হবে। এই ভাতা ঠিক করবে সরকার ও সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন পক্ষ মিলে।
সাংবাদিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বিষয়ে কামাল আহমেদ বলেন, শুধু সাংবাদিক নয়, সম্পাদক ও প্রকাশকের যোগ্যতা কী হবে, সেটিও বলা হয়েছে। সাংবাদিকদের ন্যূনতম যোগ্যতা স্নাতক থাকতে হবে। তারা এক বছর শিক্ষানবিশ থাকার পরে পূর্ণ সাংবাদিকের মর্যাদা পেতে পারেন। তবে শিক্ষানবিশকাল এক বছরের বেশি হওয়া যাবে না, শিক্ষানবিশকালে ভাতাও দিতে হবে।

প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্যরা। ছবি: প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর
কামাল আহমেদ বলেন, কমিশনের অনেকগুলো সুপারিশ সরকারের নির্বাহী আদেশেও বাস্তবায়নযোগ্য। আমরা আশা করি, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও ভবিষ্যৎ নির্বাচিত সরকার সবাই এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করবে।
প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে দেশের গণমাধ্যমের ইতিহাসের একটি পর্যালোচনা করেছেন বলেও জানান কামাল আহমেদ। বলেন, ইতিহাস পর্যালোচনা করে সেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করেছি। কোথায় কোথায় ত্রুটি ছিল, কী কী ত্রুটি ছিল এবং সেই ত্রুটি দূর করার জন্য সেরা উপায় কী হতে পারে, সেগুলো খোঁজার চেষ্টা করেছি। গণমাধ্যম, সাংবাদিক, ও সাংবাদিকতার সমস্যা চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী সুপারিশ দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
কামাল আহমেদ বলেন, গণমাধ্যমের মালিকানা একক হাতে কেন্দ্রীভূত থাকলে তাকে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা হয়, পারিবারিক স্বার্থে, নিজস্ব গোষ্ঠীর স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা হয়। সেটা থেকে বেরিয়ে আসার প্রতিকার হচ্ছে, সেটা যদি পাবলিক লিস্টেড কোম্পানি হয়। তাই আমরা সুপারিশ করেছি, বড় ও মধ্যম আকারের যত গণমাধ্যম আছে, তাদের উচিত হবে পাবলিক লিস্টেড কোম্পানি করা।
তিনি আরও বলেন, যারা টেলিভিশন, বড় বড় সংবাদপত্রের মালিকানায় আছেন, তাদের মালিকানার মধ্যে জনগণের স্বার্থ কতটুকু প্রতিফলিত হচ্ছে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কারণ তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। আমরা গণমাধ্যম থেকে রাজনীতিকদের জবাবদিহিতা চাইছি, আমলাদের জবাবদিহিতা চাইছি, কিন্তু গণমাধ্যমের জবাবদিহিতা কোথায়? একটা পত্রিকা আরেকটা পত্রিকার মালিকের বিরুদ্ধে বলছে, তার জবাবদিহিতা কোথায়? এটা কি জনস্বার্থ সম্পর্কিত, নাকি একেবারেই ব্যক্তিগত স্বার্থ সম্পর্কিত? এসব প্রশ্ন আমরা বিবেচনা করে দেখেছি।

প্রতিবেদন হস্তান্তরের পর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্যরা। ছবি: প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর
প্রতিবেদনে গণমাধ্যমের সব শাখাকেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে উল্লেখ করে কামাল আহমেদ বলেন, আমরা সংবাদমাধ্যম বলতে পত্রিকা, টেলিভিশন, অনলাইন পোর্টাল, রেডিও— সবগুলোই বিবেচনা করে দেখেছি। এদের একেকজনের একেক রকম সমস্যা। কিন্তু সাংবাদিকতার সমস্যা সবক্ষেত্রেই একরকম। টেলিভিশন সাংবাদিকের যে সমস্যা, পত্রিকার সাংবাদিকেরও সেই সমস্যা। সুতরাং, সাংবাদিকতার কী সমস্যা, সেটা আমরা চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি। সেটা মোকাবিলার কী উপায় হতে পারে, সেটি চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি।
গত বছরের ১৮ নভেম্বর গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার। গণমাধ্যমকে স্বাধীন, শক্তিশালী ও বস্তুনিষ্ঠ করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব করার লক্ষ্যে এই ‘গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনে’র প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কামাল আহমেদকে।
কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন, অ্যাটকোর সভাপতি অঞ্জন চৌধুরী, বাংলাদেশ টেলিভিশনের অবসরপ্রাপ্ত উপমহাপরিচালক কামরুন নেসা হাসান, দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক ও সম্পাদক পরিষদের প্রতিনিধি শামসুল হক জাহিদ, নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (নোয়াব) সচিব আখতার হোসেন খান, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, যমুনা টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের ট্রাস্টি ফাহিম আহমেদ, মিডিয়া সাপোর্ট নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক সাংবাদিক জিমি আমির, দ্য ডেইলি স্টারের বগুড়া প্রতিনিধি মোস্তফা সবুজ, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের উপসম্পাদক টিটু দত্ত গুপ্ত এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধি আবদুল্লাহ আল মামুন।