সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কেন আলোচনায় এলো
বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত নির্বাচন সংস্কার কমিশন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সাথে যে বৈঠক করছে, তাতে অনেকেই দেশের রাষ্ট্রপতি পদে সরাসরি নির্বাচন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ না থাকা এবং সংবিধানে না ভোটের বিধান ফিরিয়ে আনার মতো প্রস্তাব করছে।
বেসরকারি সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজন -এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বাধীন এই কমিশন এসব মতামত সংগ্রহ শেষে সেগুলো পর্যালোচনা করে নির্বাচন সংস্কার বিষয়ে তাদের সুপারিশমালা প্রধান উপদেষ্টাকে দেয়ার কথা রয়েছে।
এর মধ্যেই কমিশনের বৈঠকগুলোতে যারা অংশ নিয়েছেন তাদের মধ্য থেকে অনেকেই রাষ্ট্রপতি পদে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব দেয়ার কারণে বিষয়টি নিয়ে অনেকের মধ্যে আলোচনার আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বিবিসি বাংলাকে বলছেন, তারা এখন সবার মতামত নেয়ার কাজ করছেন, যাতে করে তাদের রিপোর্টে গণআকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং এর মাধ্যমে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তোলার পথ তৈরি হয়।
“নানা ধরনের প্রস্তাব আসছে। অনেকে সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছেন। তারা তাদের যুক্তি তুলে ধরেছেন। সবার মতামত নেয়ার কাজ শেষে হলে আমরা পর্যালোচনা করবো,” বলছিলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী এখন দেশটির রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন সংসদ সদস্যদের ভোটে। একসময় বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি শাসিক সরকার ব্যবস্থায় সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি হওয়ার বিধান ছিল। তবে ১৯৯১ সালে পুনরায় সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার পরে সেই পদ্ধতি বাতিল হয়।
বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, পপুলার বা সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সুযোগ সংসদীয় পদ্ধতিতে নেই এবং তারা এটিকে বাংলাদেশের জন্য খুব একটা প্রয়োজনীয় বলেও মনে করেন না। বরং তারা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনাটাকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন।
সরাসরি রাষ্ট্রপতির নির্বাচন, যুক্তি কী
বদিউল আলম মজুমদার বলছেন, তাদের সাথে বৈঠকগুলোতে যারা সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কথা বলেছেন, তাদের মূল কথা হলো এখন যেভাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হচ্ছে তাতে তাদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও সততার বিষয়টি দেখা হয় না।
“তাছাড়া দলবাজ যারা তারাই রাষ্ট্রপতি হয়ে যাচ্ছেন দলীয় প্রধানের অনুকম্পা নিয়ে। রাষ্ট্রপ্রধানের যে ধরনের ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতা থাকা দরকার সেটি দেখা যায় না। এমন সব যুক্তি তুলে অনেকে সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কথা বলেছেন। কেউ কেউ নির্দলীয় রাষ্ট্রপতিরও প্রস্তাব দিয়েছেন,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
এছাড়া এই কমিশনের সাথে বৈঠকে কেউ কেউ বলেছেন রাষ্ট্রপতি কে হবেন এটা এখন প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায়ের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার ফলে ক্ষমতার ভারসাম্যও নষ্ট হয়ে গেছে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে প্রবল গণআন্দোলনে সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদে সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার বদলে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। মূলত এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় আন্দোলনরত তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী ওই সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছিলো।
সেই সময় সংসদ সদস্যদের ভোটে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন আব্দুর রহমান বিশ্বাস। সেই সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বিএনপির মনোনয়নে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি। পরে আওয়ামী লীগ আমলে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ দলটির মনোনয়নে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এরপর এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ, জিল্লুর রহমান, আবদুল হামিদ ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন নিজ নিজ দলের মনোনয়নে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মনোনয়নে দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের দুই শীর্ষ নেতার ইচ্ছা-অনিচ্ছারই প্রতিফলন ঘটে আসছে বলে মনে করা হয়।
একই সাথে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ ও এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ছাড়া বাকী সবাই নিজ নিজ দলীয় প্রধানের প্রতি আনুগত্য পোষণ করে গেছেন বলেও আলোচনা আছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। এজন্য অনেকেই সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর সীমাহীন ক্ষমতা এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য না থাকাকেই দায়ী করে আসছেন।
সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন: সুবিধা-অসুবিধা
বিশ্লেষকরা বলছেন এখন বাংলাদেশের সংবিধানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকায় সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সুযোগই নেই। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার আছে এমন কোন দেশে আবার ভোটারদের সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার নজিরও নেই।
তারপরেও প্রধানমন্ত্রীর ‘সীমাহীন’ ক্ষমতায় রাশ টানতে সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাবগুলো আলোচনায় আসছে। তাদের মতে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হলে রাষ্ট্রপতির নৈতিক, আইনি ও গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তি আরও শক্ত হবে, যা ক্ষমতা কাঠামোতে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে আসবে।
যদিও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আব্দুল লতিফ মাসুম বলছেন, সংসদীয় পদ্ধতিতে সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা যৌক্তিক হবে না কারণ জনগণই ভোট দিয়ে সংসদ ও সরকার গঠন করছে।
“ক্ষমতার চেক অব ব্যালেন্স থাকা দরকার কিন্তু সেটি করতে হবে রাষ্ট্রপতিকে আরও ক্ষমতায়ন করে। এজন্য সরাসরি ভোটে সংসদ হওয়ার পর আবার সরাসরি ভোট করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দরকার নেই। বরং সেটি হলে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হতে পারে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তিনি বলেন সংসদীয় পদ্ধতিতে জনগণ সরাসরি ভোট দেয় এবং তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া দল ঠিক করে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী কে হবেন।
“আবার রাষ্ট্রপতিও ভোটে হলে তখন নির্বাচিত সংসদ ও সরকারের ওপর রাষ্ট্রপতির আরেক ধরনের প্রাধান্য তৈরি হওয়ার সুযোগ আসবে এবং সেটি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারেই কেবল হতে পারে”।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আরেকজন অধ্যাপক মো. আব্দুল মান্নান মনে করেন, সরাসরি ভোটে হলে একটিই সুবিধা, তা হলো প্রেসিডেন্ট সরাসরি নির্বাচিত-এটি বলা যাবে।
“আমাদের দেশে যেভাবে নির্বাচন হয় তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রার্থীই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকবে। ফলে এটি আলাদা কোন অর্থ বহন করবে না। বরং কোন কারণে দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব হলে সরকারে অচলাবস্থা তৈরির আশংকা তৈরি হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তার মতে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী-উভয়কেই সমান ক্ষমতা দিতে হবে এর কোন প্রয়োজনই নেই। তবে একটা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রপতিকে সাংবিধানিকভাবে আরও কিছু ক্ষমতা দেয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
এদিকে রবিবারও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষক প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেছে। বৈঠকের পর কমিশন প্রধান বদিউল আলম মজুমদার প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিষয়টি আজকের বৈঠকেও এসেছে।
“সরাসরি নির্বাচনের কথা অনেকে বলেছেন। রাষ্ট্রপতির পদকে আরও শক্তিশালী করার কথা বলেছেন,” বলছিলেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে, ফ্রান্সে বা মালদ্বীপে সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে থাকেন এবং তিনিই সরকার প্রধান হিসাবে ভূমিকা রাখেন।
তবে ডেনমার্ক বা শ্রীলঙ্কার মতো দেশে ভোটার সংসদ সদস্য নির্বাচন করলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা যেমন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন, অন্যদিকে ভোটাররা সরাসরি প্রেসিডেন্টও নির্বাচন করে থাকেন।
অন্যদিকে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ যেসব দেশে সংসদীয় ব্যবস্থার সরকার পদ্ধতি রয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রপতি সংসদের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে থাকে।
যুক্তরাজ্য, সুইডেন, ডেনমার্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া বা নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলোয় সাংবিধানিক রাজতন্ত্র থাকায় সেসব দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা রয়েছে, তবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রসঙ্গ আসে না।