পারিবারিক কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শিশুটি\n
এ ঘটনার পর আমার মনে হচ্ছে, আসলে সম্পর্কের কোন দাম নেই। লজ্জাশরমও উঠে গেছে দেশ থেকে। না হলে বাপ ছেলে এক মেয়েকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে কী করে! ওরা নিজেরা নিজেদের মুখ দেখে কী করে! ৮ বছরের আছিয়াকে ধর্ষণ করেছে তিনজন পুরুষ একযোগে। তিনজনই তার আত্মীয়। বড় আনন্দে সে গিয়েছিল বোনের বাড়িতে বেড়াতে। সেখানে যে তার জন্য অপেক্ষা করছে মৃত্যুদূত ছোট্ট মেয়েটি বুঝবে কী করে!
এ ঘটনা এবং পাশাপাশি ঘটে যাওয়া আরো কয়েকটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফুঁসে উঠেছিল দেশ, বিশেষত নারীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীকে ওড়না পরানো শিখিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন কর্মচারী। ঠিকমতো ওড়না না পরলে নাকি তার অসুবিধা হয়। মেয়েটি অভিযোগ জানালে এই লোক গ্রেফতার হয়। কিন্তু একদল জনতা সারারাত বিক্ষোভ করে তাকে জেল থেকে বের করে এনেছে আকন্ঠ মালায় ডুবিয়ে মাথায় পাগড়ি বেঁধে, বুকে পবিত্র কোরআন শরীফ দিয়ে।
ছেলেবেলা থেকে জেনে এসেছি, ত্যাগী রাজনীতিবিদরা জেল খেটে বেরুলে তাদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হয়! কেউ অসাধারণ রেজাল্ট যেমন বোর্ডে ফাস্ট-সেকেন্ড হলে তাকে ফুলের মালা দেওয়া হয়। অর্থাৎ সচরাচর দেখা যায় না এমন কোন ভালো/ মহৎ কাজ করলেই মালা জুটত। এছাড়া আর কাউকে মালা পরানো হয়েছে বলে শুনিনি বা দেখিনি। ফুল খুব পবিত্র জিনিস, যার তার গলায় দিলে ফুলের অসম্মান, অবমাননা হয়। আর তখন এত অঢেল ফুল ছিল না, পয়সাও ছিল না, দেখানো বাণিজ্যও ছিল না!
এখন তো দেখছি মালা পাবার ক্রাইটেরিয়া চোর, ডাকাত, পকেটমার, ছিনতাইকারী, ইভটিজার, ধর্ষক, খুনি! যে যত বড় অপরাধী তার জন্য তত বড় মালা! আছিয়ার ধর্ষকদের মালা পরা ছবি দেখার অপেক্ষায় আছি।
আছিয়াকে নিয়ে দেশব্যাপী আগেই আলোচনা হচ্ছিল। তবে ঘটনার প্রতিবাদে মধ্যরাতে মেয়েরা রাস্তায় নেমে ‘তুমি কে, আমি কে, আছিয়া আছিয়া’ স্লোগান দিলে শধু এদেশে নয়, বিশ্বমঞ্চে আলোচিত হতে থাকে আছিয়া ধর্ষণের ঘটনা। হ্যাঁ ফেসবুকে অনেক সমালোচনা, কটূক্তি, গালাগালও করা হয় মেয়েদের! তারা নাকি মধ্যরাত না হলে নামতে পারে না! কেন রাত কী শুধু পুরুষের? বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা মেয়ে হেনস্থা হলো, আছিয়া তখন মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, লালমাটিয়ায় মেয়েরা মার খেলো, দেশব্যাপী একের পর এক লোমহর্ষক নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে, ওরা নামবে না? নিশ্চিন্তে ঘুমাবে? রাত দিন কী, ওরা যখন খুশি নামবে।
শুধু ওরা তো না, নেমেছে সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা, শিক্ষকরা, সাধারণ জনগণ যোগ দিয়েছে তাদের সাথে। দিন কয়েক আগে একটা মেয়ের সাক্ষাৎকার দেখলাম। সেখানে প্রশ্নকর্তা জানতে চাচ্ছেন, সরকারের কাছে আপনি কী চান? মেয়েটির জবাব, আমি রাতে একা ঘুরতে চাই। রাতে যখন ইচ্ছা একা হাঁটতে চাই। ওর এই চাওয়া কী বলে? বলে মেয়েরা রাতে একা বেরুতে পারে না, তাদের নিরাপত্তা নেই। সমাজের একটা শ্রেণি চায়, দিন রাত কোনোটাই নারীর নয়। তারা দিনের আলো দেখবে না, দেখবে না রাতের চাঁদ। তাদের সারাজীবন ঘিরে থাকবে অন্ধকার।
এর আগে লালমাটিয়ায় দুজন মেয়ের সিগারেট খাওয়াকে কেন্দ্র করে ঘটেছে আরেকটি ঘটনা। এক/ অথবা একাধিক পুরুষ তাদের সিগারেট না খাওয়ার সবক দিলে মেয়েরা তর্ক করেন। শোনা যায় মেয়েদের গায়ে নাকি হাতও তোলা হয়েছে। সত্য মিথ্যা জানি না। এরপর কিছু নারী রাজপথে নেমে প্রকাশ্যে ধুমপানের অধিকার দাবি করেছে । তারা বলেছে, পুরুষ প্রকাশ্যে ধূমপান করলে যদি দোষ না হয় নারী করলে দোষ হবে কেন? তাদের দাবি, আসল কথা হচ্ছে নারী। নারীর শরীর। নারীকে অবদমন করার চেষ্টা।
আমার প্রশ্ন, ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, একথা সরকারের তরফ থেকে বার বার বলা হয়, সিনেমা হলে শো শুরুর আগে দেখানো হয়, তাহলে সরকার কেন আইন করে এই জিনিসের ব্যবসা বন্ধ করে না? ওটা বন্ধ করে দিলেই তো স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেকটা কমে যায়। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো এদেশে দেদারসে ব্যবসা করে কী করে? একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি, যে অধিকার পুরুষের আছে সে অধিকার নারীর থাকা উচিত। রাষ্ট্রের দায়িত্ব এই ক্ষতিকর বিষয়গুলি নিয়ন্ত্রণ করা, যেন কেউ না খায় সেটা দেখা। শুনলাম সেই নারী হেনস্থাকারী লোকটি নাকি জামিন পেয়ে বেরিয়ে গেছে।
আছিয়ার কথায় আসি, একটা জিনিস খেয়াল করেছি ধর্ষণ খুন ডাকাতি রাহাজানি যাইই হোক না কেন, সাথে সাথে একটা শ্রেণি কটাক্ষ করা বলে, ‘আগে কী এসব হয়নি?’ বা আরও বেশি তাচ্ছিল্য (টিপ্পনি) করে বলে ‘গত পনের বছরে এদেশে একটাও ধর্ষণ খুন বা রাহাজানির ঘটনা ঘটেনি’। এদেশে আগে ধর্ষণ হয়নি এমন নয়। হয়েছে। মারাত্মক মারাত্মক ঘটনা ঘটেছে, শিশু ধর্ষণও হয়েছে। ধর্ষণ করে শিশু মেরেও ফেলা হয়েছে। তবে একজন শিশুকে একযোগে একই পরিবারের তিনজনের অমানবিক পন্থায় ধর্ষণ করার ঘটনা আগে শুনিনি। মাত্র কয়েকদিন মধ্যে এতগুলো ধর্ষণের ঘটনাও শুনিনি।
আর আগে হয়েছে বলে এখনকার হওয়াটাকে তো বৈধতা দেওয়া যায় না। এই ধরনের কথায় বা মন্তব্যে ধর্ষিতাকে অবমাননা করা হয়, ধর্ষণকে খুব ছোটখাট ঘটনা মনে করার প্রবণতা দেখা যায়, ধর্ষকরা সাহস পায়। যারা এসব মন্তব্য করেন তাদের একটু বুঝে কথা বলা দরকার । ঘটনাটি যদি তাদের নিজ ঘরে হয় তখন কেমন হবে সেটা ভেবে দেখতে অনুরোধ করি। কেন হঠাৎ করে ধর্ষণ বেড়ে গেল এটার কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার। যারা এসব করছে তারা কী ধরেই নিয়েছে ধর্ষণ করলে কিছু হবে না! নাহলে এত সাহস হয় কী করে!
গ্রামগঞ্জে নারী বিরোধী ওয়াজ হচ্ছে। নারীকে মঞ্চে বসতে দেওয়া হবে কি হবে না, নারী নেতৃত্বে আসতে পারবে কি না এসব নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। যা মোটেই প্রত্যাশিত নয়। যে দেশে দুজন প্রধানমন্ত্রী নারী ছিলেন, সে দেশে এ আলোচনা হয় কী করে! নারীকে ঘরবন্দী করে রাখার জন্য একটা শ্রেণি খুবই তৎপর হয়ে উঠেছে।
শেষ কথা, আছিয়ার আড়ম্বরপূর্ণ শেষযাত্রায় আছিয়ার কিছু আসে যায় না, আসে যায় না ওর পরিবারের। আছিয়া বাঁচতে পারেনি। প্রাণপণ চেয়েছিল বাঁচতে। বাঁচলেও সে বাঁচা হতো মৃত্যু সমতুল্য। এই নিষ্ঠুর সমাজ তাকে সহজভাবে বাঁচতে দিত না। সেদিক দিয়ে বলতে গেলে সে মরে বেঁচে গেছে, পরিবার আত্মীয় স্বজনকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে। আসলে আমাদের দেশের গরিব আছিয়ারা যেন জন্মে মারা যাবার জন্যই। গরিব হবার অপরাধে জীবিত থেকেও বার বার ওদের যেমন মরতে হয়, তেমনি এই আছিয়ার মতো বিচার না পেয়ে অসময়ে ঢুকে যেতে হয় মাটির তলদেশে।
আছিয়ার শেষযাত্রার আড়ম্বর খুব দৃষ্টিকটু, আরোপিত, অপরাধ ঢাকার প্রবণতার মতো মনে হয়েছে। আছিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা ভালবাসায় নয়, দেশের লোকের মুখ চাপা দেবার জন্য এসব করা হয়েছে তা বুঝতে সবচেয়ে বোকা লোকটারও কোনো অসুবিধা হয়নি। এসব না করে ধর্ষকদের বিচারটা জরুরি। কেউ কেউ বলেছেন, তাৎক্ষণিক বিচারে প্রতিক্রিয়া হতে পারে। আমার তা মনে হয় না। এই ধরনের ঘৃণ্য অপরাধীদের দ্রুততম সময়ে প্রকাশ্যে, মানুষের চোখের সামনে শাস্তি হলে ধর্ষকমনের মানুষগুলো ভয় পাবে। আছিয়ার মা দাবি করেছেন, ধর্ষকদের ফাঁসি। আমাদেরও দাবি এটাই। দাবিটাকে চাঙা রাখতে হবে। ঝিমিয়ে পড়লে ওরা সদর্পে বেরিয়ে যাবে ধর্ষকরা। আছিয়া মরে গেছে, ধর্ষকরা বাঁচবে কেন?
লেখক: কথাশিল্পী ও গবেষক