একটি মেয়ে, একটি পরীক্ষা— এক নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যান

জান্নাতুল বাকেয়া কেকা

১০০ নম্বরের উত্তর না-ই বা লিখি— জীবনে কখনো কখনো পাস মার্কসও জরুরি হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু সেক্ষেত্রেও যদি পরীক্ষার্থীর সেই সুযোগটুকু কেড়ে নেওয়া হয়, তাহলে প্রশ্ন ওঠে— এই শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য কী? শিক্ষার্থী কেন পরীক্ষা হলে ঢোকার সুযোগ পাবে না? শিক্ষক বা সিস্টেমের কি কোনো দায় নেই?

বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫। একবিংশ শতকে এসেও আমরা এমন একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছি, যেখানে একজন ছাত্রী পরীক্ষা কেন্দ্রে এসে পৌঁছেও পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি পেল না! এই শিক্ষার্থী একজন বাবাহীন কন্যা, যে মাকে হাসপাতালে রেখে এসেছে শুধু পরীক্ষা দিতে। অথচ তাকে ঘরে ফেরত যেতে হলো!

এ ঘটনায় আমি শুধু ক্ষুব্ধ নই, আমি স্তব্ধ, ব্যথিত। মেয়েটির বয়স আমার কন্যার সমান। এ খবর দেখে আমি নিজেও অস্তিত্ব নিয়ে সংকটে পড়ে গেছি। বুকের ভেতর দলা পাকানো যন্ত্রণা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কেঁদে ফেলেছি। তবু যন্ত্রণার ভার হালকা হয়নি।

কীভাবে একজন শিক্ষার্থীকে শুধু সময়মতো কেন্দ্রে পৌঁছাতে না পারার কারণে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হলো না? পাস মার্কস অনেক শিক্ষার্থীর জন্য একটা সেতু, যে সেতু না পার হলে সে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ধাপে পিছিয়ে পড়ে। কেন এমন নিষ্ঠুর নিয়ম? আজ এই মেয়েটি পরীক্ষা দিতে পারল না, কাল তার মতো আরও অনেকে একই পরিণতির শিকার হবে। এই এক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করতে পারার ফলে তাকে এবং তার পরিবারকে যেসব মানসিক-সামাজিক-আর্থিক প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হবে, সেগুলোর ভার কি কেউ বইবে?

বিশেষ করে যিনি দায়িত্বে ছিলেন, সেই নারী শিক্ষক— তিনি কি এই বাস্তবতা বোঝেন না? নারী হয়ে, শিক্ষক হয়ে তিনি কি অনুভব করতে পারলেন না একজন বাবাহীন মেয়ের অসহায়তা? তার মা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে, আর সে এসেছে পরীক্ষায় অংশ নিতে। এই পরিস্থিতিতে মানবিকতা দেখানো কি ধর্মের পরিপন্থি হতো?

সারা দেশে প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষায় রেজিস্ট্রেশন করে। কিন্তু পরীক্ষায় অংশ নেয় মাত্র ১০-১২ লাখ। বাকি তিন থেকে পাঁচ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে, যার বড় অংশ মেয়ে। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, আর্থিক সংকট, অকালবিবাহ— এসব কারণেই মেয়েরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ বাস্তবতা জানার পরও যদি একজন শিক্ষক মানবিক আচরণ না করেন, তাহলে তিনি কীসের শিক্ষক?

আজকের শিক্ষিকা যদি সেই মেয়েটিকে একটু সাহস দিতেন, পাশে দাঁড়াতেন, পরীক্ষায় বসতে দিতেন, তাহলে হয়তো তার প্রতি আমরা শ্রদ্ধা জানাতাম। সেটিই হতো একটি আদর্শ দৃষ্টান্ত। কিন্তু তিনি করলেন ঠিক উলটোটি— একটি কন্যাশিশুর স্বপ্নভঙ্গের কারণ হয়ে উঠলেন।

মেয়েটির দোষ কী ছিল? দেরিতে আসার কারণ ছিল মায়ের অসুস্থতা। একজন শিক্ষক কেন নিজের হাতে তাকে পরীক্ষাকক্ষে নিয়ে গেলেন না? এই মেয়ে যদি পরীক্ষায় অংশ নিতে না পারে, তবে তার জীবন, পড়ালেখা, ভবিষ্যৎ— সব কিছুই নতুন করে অনিশ্চয়তায় পড়ে যাবে।

আমি অনুরোধ করছি সংশ্লিষ্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়, রাষ্ট্র, শিক্ষাবিদ, লেখক, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের প্রতি— এই মেয়েটির পাশে দাঁড়ান। তার জীবনে যে ক্ষতি হয়েছে, তার বিচার চাই। সেই নারী শিক্ষকের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করুন, যিনি মানবিকতার চেয়ে নিয়মকে বড় মনে করেছেন।

এই মেয়েটির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আজকের অন্যায়ের প্রতিকারের ওপর। কেউ কি দেখবেন যেন মেয়েটি তার ক্ষতির প্রতিকার পায়?

অবশ্য সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মো. রুহুল কুদ্দুস কাজল বিনা খরচে মেয়েটিকে আইনি সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘যদি কোনো মাধ‍্যমে মেয়েটির সঙ্গে কারও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়, একটা মেসেজ দেবেন দয়া করে। মেয়েটি যেন বাকি পরীক্ষাগুলোতে অংশগ্রহণ করে। আজ মিস হওয়া পরীক্ষা তিনি দিতে পারবেন। আশা করি, শিক্ষা বোর্ডসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর তার পরীক্ষার ব‍্যবস্থা গ্রহণ করবে। সরকারি কর্তৃপক্ষ যদি না করে, সুপ্রিম কোর্টের দ্বার তার জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। বাকি পরীক্ষা শেষে তিনি হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন দায়ের করতে পারবেন। মেয়েটি বা তার পরিবার চাইলে এ ব্যাপারে আমার চেম্বার থেকে বিনা পারিশ্রমিকে আইনি সহায়তা প্রদান করা হবে।’

সরকারের ভেতর-বাইরে বিবেকবান মানুষ এবং সুশীল সমাজসহ সবাই মেয়েটির পাশে দাঁড়াবে, অন‍্যায়ের প্রতিকার নিশ্চিত করবে— এই প্রত্যাশা করছি।

লেখক: গণমাধ্যম কর্মী ও লেখক

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

দুর্গাপূজা— শক্তি, সংস্কৃতি ও সম্প্রীতির সম্মিলন

মহাভারতে দেখা যায়, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে নামার আগে অর্জুন দেবী দুর্গার আরাধনা করেছিলেন। দেবীর আশীর্বাদপ্রাপ্ত হয়ে তিনি যুদ্ধে সফল হন। এভাবেই প্রাচীন ভারতবর্ষে দেবী দুর্গা শক্তি, বীরত্ব ও মাতৃত্বের সার্বজনীন প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন এবং আজও সেই চেতনা বাংলার সমাজে গভীরভাবে বিদ্যমান।

১৩ দিন আগে

ট্রাম্পের সফর, ডাফির কবিতা, স্টার্মারের ‘রাজকীয় তাস’

ট্রাম্পের সফর ঘিরে ডাফির লেখা কবিতায় যুদ্ধের ধ্বংস আর ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের আভিজাত্যের বৈপরীত্য ফুটে উঠেছে। সেই বৈপরীত্যই সামনে এসেছে—যুদ্ধবিধ্বস্ত বাস্তবতার ভেতর রাজকীয় ভোজের ঝলমল।

১৪ দিন আগে

কুরুচিপূর্ণ ভাষায় ভয় দেখানো: বিচারহীনতার নবতর সংযোজন

এসব পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞদের মধ্যকার আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে, বিশেষ করে মাঠপর্যায়ে যারা কাজ করেন তাদের মতামতের ভিত্তিতে গৃহীত হয় না। অধিকাংশ সময় তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিজস্ব চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটাতে চেষ্টা করে। তাই সমন্বয়হীনভাবে গৃহীত পরি

১৪ দিন আগে

বইমেলা দেড় মাস এগিয়ে আনা অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত

কোনো বই পাঠকের কাছে পৌঁছাতে হলে প্রয়োজন বাজারজাতকরণ, আলোচনার সৃষ্টি ও প্রচার। সময় সংকোচনের কারণে সেই কাজ হবে অপ্রতুল, ফলে বিক্রিও প্রভাবিত হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবেন লেখক ও প্রকাশক উভয়েই।

১৫ দিন আগে