‌‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের’ রাজনৈতিক গুরুত্ব কতটা

বিবিসি বাংলা
প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯: ৫২

ঢাকায় ৩১ ডিসেম্বর ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের যে কর্মসূচি, তাকে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে ‘প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ’ বলে মন্তব্য করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও তাদের ঘনিষ্ঠ জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা।

বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা গত শনিবার ওই কর্মসূচি ঘোষণা করেন, যে অনুষ্ঠানে ‘৭২এর সংবিধানের কবর রচনা’ করা হবে বলে নেতৃবৃন্দ দাবি করেছেন। এদিকে, রবিবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের তরফ থেকে বলা হয়, ৩১ ডিসেম্বরের কর্মসূচি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ’।

এখন সরকারের দিক থেকে আসা ওই বক্তব্যে ‘অসন্তোষ’ প্রকাশ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা বলছেন, মঙ্গলবারের কর্মসূচিটি সরকারের সহায়তায় হচ্ছে না ঠিকই, তবে তারা মনে করেন জুলাই-অগাস্ট অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে তাদের ঘোষণাপত্রটি হবে ভবিষ্যৎ জাতীয় রাজনীতির জন্য নির্দেশক ও বিশেষ গুরুত্ববাহী।

অবশ্য বিশ্লেষকরা মনে করেন, পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে ও পরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ওপর যে আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা ছিলো - তাএখন বিভিন্ন কারণে কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে।

এছাড়াও আন্দোলন সফল হওয়ার পাঁচ মাস পর এসে ওই আন্দোলনের ঘোষণাপত্র, বিশেষ করে দেশের সংবিধান নিয়ে নতুন অবস্থান প্রকাশ করে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নিজেদের সংগঠিত হবার প্রয়াস বলেই মনে করছেন তারা। ফলে এমন একটি অবস্থায় এই কর্মসূচির রাজনৈতিক গুরুত্ব কতটা তা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের মনে প্রশ্ন আছে।

প্রসঙ্গত, গত পাঁচই অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে 'রাষ্ট্র সংস্কারের' দাবি উঠে আসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে।

সংবিধান সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশন কাজ করছে

এজন্য কেউ কেউ সংবিধানে পরিবর্তন আনারও প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আবার কেউ কেউ বিদ্যমান সংবিধান বাতিল করে পুনর্লিখনের দাবি তোলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের গঠিত গণপরিষদ বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করে।

মূলতঃ সরকারি চাকরিতে কোটার বিরোধিতার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনে পরিণত হলেও, সেসময় সংবিধান পরিবর্তন বা বাতিলের বিষয়টি আলোচনা কিংবা দাবি - কোন পর্যায়েই ছিলো না।

কিন্তু এটি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস কর্তৃক গঠিত সংবিধান সংস্কার বিষয়ক কমিশনের সংবাদ সম্মেলনে, যেখানে ওই কমিশনের সদস্য মাহফুজ আলম 'এক দফা ঘোষণার দিনই সংবিধান বাতিল হয়ে গেছে' - এমন মন্তব্য করার পরই।

ছাত্রনেতাদের বক্তব্য ও সরকারের অবস্থান

রবিবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলেছেন, আসছে ৩১শে ডিসেম্বর ‘দেশে মুজিববাদী সংবিধানের কবর রচিত হবে’, এবং ‘আওয়ামী লীগ দল হিসেবে অপ্রাসঙ্গিক’ হয়ে পড়বে বাংলাদেশে। তারা জানান, ওইদিন ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে 'জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র' ঘোষণা করা হবে।

সংবাদ সম্মেলনে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘এই ঘোষণাপত্র পাঁচই অগাস্টেই হওয়া উচিত ছিল, না হওয়ার ফলে ফ্যাসিবাদের পক্ষের শক্তিগুলো ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে। দুই হাজারের ঊর্ধ্বে শহীদ এবং ২০ হাজারের ঊর্ধ্বে আহতদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে তারা এ আন্দোলনের 'লেজিটেমেসি'কে প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। জুলাই অভ্যুত্থান, যে গণ অভ্যুত্থানটি হয়েছে...তার মধ্য দিয়ে মানুষ 'মুজিববাদী সংবিধানে'র বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এই যে মানুষ মুজিববাদী সংবিধানের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, তার একটি লিগ্যাল ডকুমেন্টেশন থাকা উচিত।’

তিনি আরো বলেন, ‘২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান ঘিরে আমাদের যে গণ-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, '৭২ এর সংবিধানের বিপরীতে গিয়ে মানুষ যে রাস্তায় নেমে এসেছে এ অভ্যুত্থানে – সেটার প্রাতিষ্ঠানিক, দালিলিক স্বীকৃতি ঘোষণা করার জন্য আমরা ৩১শে ডিসেম্বর ছাত্রজনতার উপস্থিতিতে শহীদমিনার থেকে আমাদের 'প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভ্যুলেশন' ঘোষণা করবো।’

ওই সংবাদ সম্মেলনের এর কয়েক ঘণ্টা পর আরেক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মো. শফিকুল আলম বলেন, এর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তিনি বলেন, এটিকে সরকার 'প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ' (বেসরকারি উদ্যোগ) হিসেবেই দেখতে চায়।

‘এটি একটি প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ। আমরা এটিকে প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ হিসেবেই দেখছি। সরকারের সঙ্গে এর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। যারা এটিকে সাপোর্ট করছেন, এটা প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভকে সাপোর্ট করছেন,’ বলেছেন তিনি।

কী প্রতিক্রিয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের?

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণার পর প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে একে 'প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ' বলায় কর্মসূচির গুরুত্ব কমেছে কি - না, এখন সে প্রশ্নই উঠছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। এদিকে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ বিবিসিকে বলেছেন, কর্মসূচির গুরুত্ব কমেনি, কারণ এ কর্মসূচি সরকারের সহায়তায় হচ্ছে না।

তবে, সরকারের উপদেষ্টারা এ কর্মসূচিতে আসবেন বলে জানান তিনি। ‘আমরা ছাত্র জনতাকে আহবান করেছি স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নেয়ার জন্য। তবে সরকারের কেউ এটাকে প্রাইভেট বলতে পারে না। ওনারা '২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন। তারা এভাবে বলতে পারে না। এ ধরনের অসতর্ক মন্তব্যে আমরা অসন্তোষ প্রকাশ করছি,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিত্র সংগঠন জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিনও বলছেন, সরকারের দিক থেকে যে বক্তব্য এসেছে তাতে মঙ্গলবারের কর্মসূচির কোন গুরুত্ব কমেনি বরং বেড়েছে। কারণ আন্দোলনকারী ছাত্ররা নিজেরাই এটি করছেন জনগণের সমর্থন নিয়ে।

‘এটি সরকারের বিষয় নয়। এটি জুলাই অভ্যুত্থানের স্বারক ও দালিলিক প্রমাণের বিষয়। তবে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই এ সরকার ক্ষমতায় এসেছে। সে কারণে সরকারের দিক থেকে কেউ কোন অপ্রত্যাশিত মন্তব্য করলে সেটা আমাদের মর্মাহত করে,’ বলেছেন তিনি।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন এ কর্মসূচিকে ঘিরে যত ধরনের বক্তব্য এসেছে সরকারসহ আন্দোলনের পক্ষে থাকা বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে তাতে টানাপড়েন অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

কী বলছেন বিশ্লেষকেরা?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, সংবিধান নিয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির বিরোধিতা স্পষ্ট। আবার সরকারের মধ্যেও ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দেখা যাচ্ছে।

‘সরকারের একজন উপদেষ্টা ৩১শে ডিসেম্বরের ডাক দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। আবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং বলেছে এটি প্রাইভেট উদ্যোগ। এসব কিছুই এ কর্মসূচিকে ঘিরে যে জল্পনা কল্পনা কিংবা উত্তেজনা তৈরি হয়েছিলো তা প্রশমিত করে দিয়েছে,’ বলেন অধ্যাপক নাসরীন।

তার মতে, যেহেতু নিজেদের সরকারই ক্ষমতায় সে কারণে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের শহীদ মিনারে গিয়ে দাবি উপস্থাপনের গুরুত্ব হয়তো সেভাবে থাকবে না। ‘তবে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের যে আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা ছিলো - সে জায়গা নড়বড়ে হয়ে গেছে। এ কর্মসূচির মাধ্যমে তারা হয়তো সেটি ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করতে পারে,’ বলেন অধ্যাপক নাসরীন।

আরেকজন বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক মুজিবুর রহমান মনে করেন, ‘সংবিধানের প্রশ্নটি আন্দোলনের সময় আসেনি’ এবং এমন ‘নতুন অনেক কিছু মানুষ এখন শুনছে’ বলেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রতি যে আস্থা ও ম্যান্ডেট ছিলো সেটা কিছুটা কমছে। ‘তাদের দাবি দাওয়া তো সরকারকে দেবে। সরকার তো তাদেরই। তাহলে শহীদ মিনারে ঘোষণা কেন?,’ প্রশ্ন এই বিশ্লেষকের।

‘এরপর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের বক্তব্যের পর তাদের বক্তব্যের মেরিট কমেছে। এখন ঘোষণাপত্রে কী থাকবে সেটা পরে জানা যাবে। কিন্তু এর মধ্যে তারা যা প্রকাশ করেছেন, সেগুলো মানুষকে খুব বেশি আকৃষ্ট করতে পেরেছে বলে হয় না,’ বলছিলেন তিনি।

তবে, তাদের ঘোষণা যদি দেশকে স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে ও জন প্রত্যাশা গণতান্ত্রিক উপায়ে পূরণের জন্য ভূমিকা রাখে - তাহলে কিছুটা হলেও এর রাজনৈতিক গুরুত্ব থাকবে।

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

জুলাই ঘোষণা ও নির্বাচন ঘিরে আশা-নিরাশা

গণঅভ্যুত্থানের প্রারম্ভে যে গণআকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে প্রথমত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ও পরবর্তীকালে রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, সুশীল সমাজ ও সর্বস্তরের জনসাধারণের পক্ষ থেকে, তা এক কথায় অভূতপূর্ব। বিগত অর্ধ শতাব্দী ধরে রাজনৈতিক সরকারগুলো যে যথাযথভাবে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে গ্রাহ্য করেনি, এই

৪ দিন আগে

নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তা— শেষ, নাকি সাময়িক বিরতি?

বিএনপি, যাদের এক দশকের বেশি সময় ধরে রাজনীতিতে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল, তারা চাইছিল ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হোক, যাতে তারা নিজেদের অবস্থান ফের শক্ত করতে পারে। তবে এনসিপি ও জামায়াত মনে করে, আগে সংবিধান সংস্কার ও নির্বাচন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন দরকার—তারপরেই জাতীয় নির্বাচন দেওয়া যেতে পার

৪ দিন আগে

৩৬ জুলাইয়ের আলো কি মেঘে ঢাকা পড়ছে?

দিনটি এখন ইতিহাসে খোদাই হয়ে আছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়— এটা কি কেবল রোমাঞ্চকর এক স্মৃতি, নাকি বদলে দিয়েছে দেশের ভবিষ্যৎগতি? যে আগুন জ্বলে উঠেছিল সেদিন, তা কি এখনও দীপ্ত? নাকি ঢেকে যাচ্ছে নতুন হতাশার ছায়ায়?

৬ দিন আগে

পুঁজিবাজারের সম্ভাবনা কাজে লাগানোর এখনই সময়

তবে বহু বছর পর ব্যাংক ও বীমা খাত একসঙ্গে ধনাত্মক ধারায় প্রবেশ করেছে। এর কৃতিত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দাবি করতেই পারেন। তিনি ধারাবাহিকভাবে ব্যাংক খাতে নীতি ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে গেছেন এবং আমানতকারীদের আস্থা ধরে রেখেছেন।

৮ দিন আগে