সিন্ধু নদীর পানি নিয়ে কেন এত দুশ্চিন্তায় পাকিস্তান?\n
মহারাষ্ট্রের পুনের বাসিন্দা আশাবরী সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে জানিয়েছেন, হামলার সময় তিনি তার মা-বাবা ও স্বজনদের সঙ্গে ছিলেন। ওই হামলায় তার বাবা ও এক আত্মীয় নিহত হয়েছেন।
আশাবরী বলেন, ‘আমাদের সাহায্য করার জন্য সেখানে কেউ ছিল না। আমাদের যে খচ্চর-চালকরা আমাদের ওখানে নিয়ে গিয়েছিল, তারাই একমাত্র আমাদের সাহায্য করেছিলেন।’ হামলার ২০ মিনিট পর নিরাপত্তা বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছায় বলে দাবি করেন তিনি।
অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল কেজেএস ধিলোঁ ভারতীয় সেনাবাহিনীর শ্রীনগর-ভিত্তিক ১৫ কোরের প্রাক্তন কম্যান্ডার। তিনি বলেন, আপাতত আমি এটাই বলব— হ্যাঁ, কাশ্মিরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গতিশীল বা ডায়নামিক পদ্ধতিতে কাজ করে। সেটার নিয়মিত পর্যালোচনা করা হয়। সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট থেকে দেখেছি, বৈসরন উপত্যকায় নিরাপত্তা বাহিনীর কোনো উপস্থিতি ছিল না। যে এলাকায় এত পর্যটকদের ভিড়, সেখানে নিরাপত্তা বাহিনী থাকা উচিত ছিল।
যশোবর্ধন আজাদ একজন অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার। তিনি ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোতে বিশেষ পরিচালক হিসাবে কাজ করেছেন এবং জম্মু ও কাশ্মীরের সঙ্গে পরিচিত। তিনি বিবিসিকে বলেন, এভাবে, এত বড় হামলা, তাও পর্যটকদের ওপরে— এটা আমরা আশঙ্কাই করিনি। আক্রমণের জন্য পহেলগামকে বেছে নেওয়াও ছিল কৌশলগত সিদ্ধান্ত। ওই এলাকা তো শান্তিপূর্ণ ছিল। সেখানকার মানুষ পর্যটনের সঙ্গে এতটাই জড়িয়ে আছে যে তারা কখনোই এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করবে না।
যশোবর্ধন আরও বলেন, আমরা যে তথ্য পাচ্ছি— এই সন্ত্রাসবাদীদের সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য ছিল। তারপরও সন্ত্রাসীরা তারা তাদের কার্যসিদ্ধি করেছে। এটি এমন একটি বিষয়, যার সঠিক বিশ্লেষণ করা দরকার এবং এর থেকে শিক্ষা নেওয়া দরকার। আমাদের এটাও ভাবতে হবে যে ওই চরমপন্থিদের কোনো ধরনের স্থানীয় সমর্থন ছিল কি না। তাহলে কি এটা গোয়েন্দা ব্যর্থতা? আপনি হয়তো বলতে পারেন। কিন্তু এটাও মনে রাখবেন, একটি জায়গায় লাখ লাখ নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করা গেলেও কিছু ফাঁকফোকর থাকতেই পারে।
কাশ্মিরের শ্রীনগরে নিরাপত্তা বাহিনীর বাড়তি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। ছবি: রয়টার্স
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ৩৪ লাখেরও বেশি পর্যটক জম্মু ও কাশ্মীর ভ্রমণ করেছেন। ২০২৩ সালের শেষে এই সংখ্যা দুই কোটি ১১ লাখ ছাড়িয়ে যায়। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল এক কোটি আট লাখের ওপরে। অর্থাৎ পর্যটকদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তির দিকেই ছিল।
জম্মু-কাশ্মীরের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ২০১৯-২০ সালে পর্যটনের অবদান ছিল সাত দশমিক ৮৪ শতাংশ, যা ২০২২-২৩ সালে বেড়ে হয় আট দশমিক ৪৭ শতাংশ। জম্মু-কাশ্মীরে পর্যটন ক্ষেত্রের বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার ২০২১ সাল থেকেই ছিল ১৫ দশমিক ১৩ শতাংশ।
আবার গত বছর যে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন হয়েছিল, তাতেও মানুষ উৎসাহের সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন। সরকারি ভাষ্যতে জম্মু-কাশ্মিরের প্রসঙ্গে ‘জিরো টেরর’, অর্থাৎ ‘সন্ত্রাসমুক্ত’র মতো শব্দও উঠে আসছিল। অর্থাৎ ভারত সরকারের দাবি ছিল, জম্মু-কাশ্মির থেকে সন্ত্রাসবাদ প্রায় নির্মূল করা গেছে।
সাউথ এশিয়া টেরোরিজম পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে জম্মু- কাশ্মিরে ‘চরমপন্থি সহিংসতা’য় ১৯ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছিলেন। সে বছর ১৮ জন নিরাপত্তাকর্মী ও ৮৪ জন ‘চরমপন্থি’ নিহত হন।
পরে সহিংসতার মাত্রা আরও বেড়ে যায়। ২০১৮ সালেও ৮৬ জন বেসামরিক নাগরিক, ৯৫ জন নিরাপত্তাকর্মী ও ২৭১ ‘চরমপন্থি’ নিহত হয়েছিলেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে ২০২৩ সালে সহিংসতার মাত্রা ছিল কম। ওই বছর ১২ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন, প্রাণ হারান ৩৩ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও ৮৭ জন ‘চরমপন্থি’। গত বছরে ৩১ জন বেসামরিক নাগরিক ও ২৬ জন নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে ৬৯ জন ‘চরমপন্থি’ প্রাণ হারান কাশ্মিরে।
অর্থাৎ ভারত সরকার যেভাবে কাশ্মিরে সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের দাবি করে থাকে, বাস্তবে পরিস্থিতি ততটা সহিংসতামুক্তও নয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক রাজনৈতিক বিশ্লেষকও বিবিসিকে বলেছেন, জম্মু-কাশ্মির নিয়ে ভারত সরকারের কৌশল পুনর্বিবেচনা করা দরকার।
সেনাবাহিনীর ডিরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশনস (ডিজিএমও) ছিলেন— এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসিকে বলেন, পর্যটকরা বরাবরই সফট টার্গেট। যেহেতু আগে তাদের ওপর এ ধরনের কোনো হামলা হয়নি, তাই ধারণা করা হচ্ছিল ভবিষ্যতেও হামলা হবে না। এখন পহেলগামে হামলার পর পর্যটন নিয়ে সরকারকে কিছু দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। পর্যটনের অনুমতি দেওয়া হোক, তবে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে। নিরাপত্তা বাহিনী যেসব জায়গায় তল্লাশি চালিয়েছে শুধু সেইসব জায়গায় পর্যটকদের যেতে দেওয়া যেতে পারে।
অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ধিলোঁ বলেন, পর্যটকদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় কারও অসুবিধা না করে প্রত্যেকের ওপরে নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষে নজর রাখা সত্যিই কঠিন। দেশি-বিদেশি পর্যটক ছাড়াও স্থানীয়রাও এসব জায়গায় ভিড় করেন। যেমন— টুরিস্ট গাইড, অস্থায়ী ধাবা ও রেস্তোরাঁর কর্মী, ট্যাক্সিচালক, ঘোড়াচালক। দুই-তিন জন সন্ত্রাসবাদীর পক্ষে এ রকম ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়া বা ধরা না পড়া খুবই সহজ।
ইনস্টিটিউট ফর কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্টের নির্বাহী পরিচালক অজয় সাহনি এ প্রসঙ্গে বলেন, সাময়িকভাবে হলেও এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না করা হলে পর্যটকদের মধ্যে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে তা জম্মু-কাশ্মিরের পর্যটনকে ধ্বংস করে দিতে পারে।
২০১৯ সালে ৩৭০ ধারা অপসারণের পর থেকে জম্মু-কাশ্মিরে পর্যটনসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করতে সরকার উৎসাহিত করেছে। এসব বিষয়ে সরকারের অবস্থান বদলাবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
নিরাপত্তা ও তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তেও। ছবি: রয়টার্স
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বুধবার তার বিবৃতিতে স্পষ্ট করে দিয়েছেন, এ হামলার পেছনে যারা রয়েছে, তাদের শিগগিরই পালটা জবাব দেওয়া হবে। তবে কী ধরনের আর কবে এই জবাব দেওয়া হবে, তা স্পষ্ট নয়।
জম্মু-কাশ্মিরে নিরাপত্তা বাহিনীর সংখ্যা বাড়িয়ে কি কোনো লাভ হবে? গোয়েন্দা তথ্য জোগাড় করার দিকে ভারতকে কি আরও নজর দিতে হবে? এমন সব প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে।
যশোবর্ধন আজাদ বলেন, আমার মতে, এ হামলার পেছনে পাকিস্তানের হাত রয়েছে। এখন বিপুল সংখ্যক ভারতীয় ও বিদেশি পর্যটক জম্মু-কাশ্মিরে আসছেন। সেখানে ‘জি-টোয়েন্টি’র মতো সম্মেলন হয়েছিল। এত কিছুর পরও আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের ক্ষতি করার লক্ষ্যেই সরাসরি ভারতে এভাবে আক্রমণ চালানো হয়েছে। এ ধরনের চিন্তাভাবনা একমাত্র পাকিস্তানই করতে পারে।
যশোবর্ধন আজাদের মতে, ভারতের এই সুযোগটা কাজে লাগানো উচিত। আশা করি দোষীদের জীবিত ধরা যাবে। তাদের নিজেদের ও পাকিস্তানের কী ভূমিকা ছিল, তার নথি থাকা দরকার। এরপর ভারত যা উপযুক্ত মনে করবে সেই পদক্ষেপ নিক, যেন পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদের পরিকাঠামোটাই পুরোপুরি ভেঙে দেওয়া যায়।
‘আমি সবসময়ই পাকিস্তানের সঙ্গে সংলাপের পক্ষে। একই সঙ্গে আমি এটাও মনে করি, লাইন অব কন্ট্রোলে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চালিয়ে যাওয়া যথার্থ কি না, তা পর্যালোচনা করার সময় এসেছে। আমার মনে হয়, এই যুদ্ধবিরতিতে ভারতের থেকে পাকিস্তানই বেশি লাভবান হচ্ছে,’— বলেন যশোবর্ধন আজাদ।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অজয় সাহনি বলেন, ‘জম্মু-কাশ্মিরে ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সন্ত্রাসবাদ চলছে। পরিসংখ্যানের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয়, এই সন্ত্রাসবাদ এখন শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আরও বেশি করে নিরাপত্তা বাহিনী পাঠানো দরকার। এ প্রশ্নে বলব, পাহাড় ও জঙ্গলে ভরা এলাকার ভূগোলটা যদি দেখেন, তাহলে একটানা কত সংখ্যক বাহিনী মোতায়েন করতে পারবেন?’
‘এই মুহূর্তে যেটা দরকার তা হলো— পুরো দেশের থেকে স্থানীয় মানুষরা যেন নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে না করেন, সেটা ভারতকে সুনিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য আমাদের রাজনীতিবিদদের বিভেদমূলক বক্তব্য বন্ধ করতে হবে। আমরা যদি নিশ্চিত করতে চাই যে আমাদের গোয়েন্দা ব্যবস্থা আরও ভালো হয়ে উঠবে, আমাদের পুলিশ বাহিনী শক্তিশালী হবে এবং সন্ত্রাসবাদীদের জন্য কোনো সমর্থন থাকবে না, তাহলে স্থানীয় জনগণকে নিজেদের পক্ষে আনতে হবে,’— বলেন অজয় সাহনি।