কাশ্মির— দশকের পর দশক ধরে ভারত-পাকিস্তান সংকটের কেন্দ্রবিন্দু

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ২১: ০১
মানচিত্রে অবস্থান ভারত, পাকিস্তান ও কাশ্মিরের

ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে উত্তেজনা ছড়িয়েছে নতুন করে। দুই দেশই পরস্পরের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। এক দেশ আরেক দেশের নাগরিকদের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে ভিসা। দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে দুই দেশ। স্থগিত ঘোষণা হয়েছে বাণিজ্য, আকাশপথে যোগাযোগ। দুই দেশই ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে পরীক্ষা পর্যন্ত করে ফেলেছে।

দুই দেশের মধ্যে এমন প্রায় যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরির পেছনে রয়েছে জম্মু কাশ্মিরের পহেলগামে পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জনের নিহত হওয়ার ঘটনা। ভারত বলে আসছে, ওই হামলার নেপথ্যে রয়েছে পাকিস্তান। তবে পাকিস্তান এ হামলায় যেকোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছে। কিন্তু ভারতের নেওয়া পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপের বিপরীতে পাকিস্তানেরও ভারতের বিরুদ্ধে পালটা পদক্ষেপে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছেই।

কেবল এবারই নয়, গত সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতেই রয়েছে এই কাশ্মির। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী দেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই ভূখণ্ড নিয়ে দুটি যুদ্ধ করেছে।

দুই দেশই এই অঞ্চলটিকে সম্পূর্ণ নিজেদের দাবি করে আসছে। তবে গোটা কাশ্মিরের একাংশ (জম্মু কাশ্মির) নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ভারত, একাংশ (আজাদ কাশ্মির) নিয়ন্ত্রণ করে থাকে পাকিস্তান। চীনও এই অঞ্চলের কিছু অংশে শাসন পরিচালনা করে। এটি বিশ্বের অন্যতম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সামরিকায়িত অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

২০১৯ সালে, ভারতের সংসদ এই অঞ্চলের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে, যা এই অঞ্চলকে স্বায়ত্তশাসনের কিছুটা অধিকার দিয়েছিল। তখন জম্মু-কাশ্মীর দুই অংশকে দুটি কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়।

এরপর থেকে ভারত সরকার বারবার দাবি করেছে, এই অঞ্চলে নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এবং ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ থামানো গেছে। তবে মঙ্গলবারের মর্মান্তিক সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত সরকারের সে দাবি নিয়ে আবার প্রশ্ন তুলছেন সমালোচকরা।

Pahelgam-Valley-Wiki-Photo-24-04-2025

পহেলগাম উপত্যকা, যেখানে সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণ হারিয়েছে ২৬ জন। কাশ্মিরের এই অঞ্চলটিকেই ‘ভূস্বর্গ’ বলে ডাকা হয়। ছবি: উইকিপিডিয়া

১৯৪৭ থেকে ইতিহাস

ব্রিটিশ শাসন থেকে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর সে সময়কার রাজকীয় শাসকদের পছন্দ অনুযায়ী যেকোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগ দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। ওই সময় কাশ্মিরের মহারাজা হরি সিং ছিলেন একজন হিন্দু শাসক। কিন্তু অঞ্চলটি আবার ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে দুই দেশের মাঝে অবস্থিত এই অঞ্চল নিয়ে তিনি মহারাজা হরি সিং সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে পরিবহন ও অন্যান্য পরিষেবা বজায় রাখার জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন ‘স্থবির’ চুক্তি সই করেন।

১৯৪৭ সালের অক্টোবরে মুসলিমদের ওপর আক্রমণের খবরে এবং হরি সিংয়ের দেরি করতে থাকার কৌশলে হতাশ হয়ে পাকিস্তানের নৃগোষ্ঠী কাশ্মীরে আক্রমণ করে। মহারাজা সিং তখন ভারতের সামরিক সহায়তা চান।

ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন বিশ্বাস করতেন, কাশ্মির ভারতের সঙ্গে সাময়িকভাবে যুক্ত হলে শান্তি বজায় থাকবে এবং পরে তার চূড়ান্ত অবস্থান নিয়ে গণভোট হবে। সে মাসেই হরি সিং ‘অধিগ্রহণ চুক্তি’ সই করেন, যার মধ্য দিয়ে কাশ্মিরের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতির নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

ভারতীয় সেনাবাহিনী ভূখণ্ডের দুই-তৃতীয়াংশ দখল করে নেয়। আর পাকিস্তান দখল করে উত্তরের বাকি অংশ। গত শতরের পঞ্চাশের দশকে চীন এ রাজ্যের পূর্ব অংশ আকসাই চিন দখল করে। এই ‘অধিগ্রহণ চুক্তি’ আগে সই হয়েছিল, নাকি ভারতীয় সেনা আগে প্রবেশ করেছিল— এটি এখনো ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বড় বিতর্কের বিষয়।

ভারত বলে আসছে, মহারাজা প্রথমে সই করেছিলেন। ফলে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি বৈধ। অন্যদিকে পাকিস্তান বলে আসছে, মহারাজা সৈন্য আগমনের আগে সই করেননি। তাই ভারত ও মহারাজা পাকিস্তানের সঙ্গে হওয়া ‘স্থগিত চুক্তি’ লঙ্ঘন করেছেন।

পাকিস্তান কাশ্মিরের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি গণভোট দাবি করে। আর ভারতের ভাষ্য, ধারাবাহিকভাবে রাজ্য ও জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে কাশ্মিরিরা ভারতের সঙ্গে যুক্ত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

Security-Situation-IOn-Kasmir-24-04-2025

কাশ্মিরে নিরাপত্তা বাহিনীর টহল। ছবি: রয়টার্স

পাকিস্তান জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রস্তাবের কথা বলে থাকে, যেখানে জাতিসংঘ পরিচালিত গণভোটের কথা বলা হয়েছে। ভারতের পালটা যুক্তি, ১৯৭২ সালের শিমলা চুক্তি অনুযায়ী সমস্যার সমাধান রাষ্ট্রের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমেই হতে হবে।

কয়েক দশক ধরে দুপক্ষের এমন অবস্থানে খুব একটা নড়চড় হয়নি। এ ছাড়াও কিছু কাশ্মিরি রয়েছেন, যারা আবার ভারত বা পাকিস্তানের কাউকেই মেনে নিতে রাজি নন। তারা কাশ্মিরকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চান। এই গোষ্ঠীর অবস্থানের বিপক্ষে আবার ভারত-পাকিস্তান এক, তারা কেউই কাশ্মিরকে স্বাধীন দেখতে রাজি না।

কাশ্মির নিয়ে ভারত ও পাকিস্তান ১৯৪৭-৪৮ ও ১৯৬৫ সালে যুদ্ধ করেছে। তারা শিমলা চুক্তিতে মূল যুদ্ধবিরতির যে রেখা ছিল, সেটিকে নিয়ন্ত্রণ রেখা হিসেবে চূড়ান্ত করে। তবে এতে সংঘর্ষ বন্ধ হয়ে যায়নি। ১৯৯৯ সালে সিয়াচেন হিমবাহ অঞ্চলে আরও সংঘর্ষ হয়, যা ছিল নিয়ন্ত্রণ রেখার বাইরে। ২০০২ সালেও দুই দেশ আবার যুদ্ধের কাছাকাছি চলে যায়।

১৯৮৯ সালে ইসলামপন্থিদের নেতৃত্বে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। বিতর্কিত ‘সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ ক্ষমতা আইন’ (এএফএসপিএ) চালু করে ভারত সেনাবাহিনীকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেয়। এ আইন নিয়ে মাঝে মাঝে পর্যালোচনা হলেও, এটি এখনও ভারত-শাসিত জম্মু ও কাশ্মিরে কার্যকর।

Movement-Fror-Free-Kashmir-24-04-2025

ভারত-পাকিস্তানের থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন কাশ্মিরের আন্দোলনও চলছে দীর্ঘ দিন ধরেই। ছবি: সংগৃহীত

কাশ্মিরের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ সময়

  • ১৮৪৬: কাশ্মির রাজ্য গঠিত হয়।
  • ১৯৪৭-৪৮: পাকিস্তানি নৃগোষ্ঠী বাহিনীর হামলার পর কাশ্মিরের মহারাজা ভারতের সঙ্গে অধিগ্রহণ চুক্তি সই করেন। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়।
  • ১৯৪৯: ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে কাশ্মির ভাগ হয়।
  • ১৯৬২: আকসাই চিন সীমান্ত নিয়ে চীনের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ হয়। এতে ভারত পরাজিত হয়।
  • ১৯৬৫: দ্বিতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়, যেটি শেষ হয় যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে।
  • কাশ্মিরি জাতীয়তাবাদের উত্থান: জম্মু-কাশ্মির লিবারেশন ফ্রন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়, যার লক্ষ্য ভারত ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মিরকে পুনরায় একত্রিত করে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন।
  • ১৯৭২: শিমলা চুক্তি— যুদ্ধের পর ভারত ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ রেখা চূড়ান্ত করে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় এবং আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে একমত হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে জন্ম নেয় স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
  • ১৯৮০-১৯৯০ দশক: ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থেকে সশস্ত্র প্রতিরোধ, গণবিক্ষোভ ও পাকিস্তান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়।
  • ১৯৯৯: কারগিল যুদ্ধ— পাকিস্তান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী ভারতের অধীন কারগিল অংশে অনুপ্রবেশ করলে ভারত ও পাকিস্তান আবার স্বল্পমেয়াদি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
  • ২০০৮: ভারত ও পাকিস্তান ছয় দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো নিয়ন্ত্রণ রেখা পারাপারের বাণিজ্য রুট চালু করে।
  • ২০১০: ভারত-শাসিত কাশ্মিরে ভারতবিরোধী বিক্ষোভে শতাধিক যুবক নিহত হয়।
  • ২০১৫: রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ— জম্মু ও কাশ্মিরের নির্বাচনে ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি প্রথমবারের মতো এ অঞ্চলে বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। ওই সময় তারা আঞ্চলিক মুসলিম পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে আংশিকভাবে জোট সরকার গঠন করে।
  • ২০১৯: ফেব্রুয়ারিতে পুলওয়ামাতে ভারতের সেনাবাহিনীর কনভয়ে আত্মঘাতী হামলায় অন্তত ৪০ জন সেনা নিহত হয়। আগস্ট মাসে ভারত সরকার জম্মু-কাশ্মির রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে, যা রাজ্যটিকে উল্লেখযোগ্য স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিল। এরপর রাজ্যটিকে ভেঙে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তর করা হয়।

[বিবিসি বাংলা অবলম্বনে]

ad
ad

বিশ্ব রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত যুক্তরাজ্যের, রাষ্ট্রদূতকে তলব

ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি সংসদকে বলেন, আমরা ২০৩০ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রোডম্যাপের আওতায় সহযোগিতার বিষয়টি পর্যালোচনা করব। নেতানিয়াহু সরকারের কর্মকাণ্ডই এ সিদ্ধান্তকে দরকারি করে তুলেছে।

১৫ ঘণ্টা আগে

ভারতকে ‘হারানো’র পুরস্কার হিসেবে ‘ফিল্ড মার্শাল’ হলেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, অসাধারণ সামরিক নেতৃত্ব, সাহস ও বীরত্ব, পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডগত সংহতি রক্ষা এবং শত্রুর বিরুদ্ধে সাহসী প্রতিরক্ষার স্বীকৃতি হিসেবে মন্ত্রিসভা জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনিরকে ফিল্ড মার্শাল র‍্যাংক দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করা হলো।

১৬ ঘণ্টা আগে

ত্রাণের অভাবে গাজায় ৪৮ ঘণ্টায় ১৪ হাজার শিশুর মৃত্যুর শঙ্কা

ফিলিস্তিনের গাজায় দ্রুতই পর্যাপ্ত ত্রাণ না পৌঁছলে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ১৪ হাজার শিশুর মৃত্যু হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল টম ফ্লেচার।

১ দিন আগে

ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে অপ্রত্যাশিত বিজয়ী চীন?

কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনেকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চার দিনব্যাপী সামরিক সংঘর্ষ যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে শেষ হলেও দুই দেশই নিজেদের বিজয়ী বলে দাবি করছে। তবে এ সংঘাতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে চীন। এতে অপ্রত্যাশিত বিজয়ী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে চীনের প্রতিরক্ষা শিল্প। ভারত-পাকিস্তা

১ দিন আগে