top ad image
top ad image
home iconarrow iconফিচার

সাহিত্য

সৈনিক তলস্তয়, সাহিত্যিক তলস্তয়

সৈনিক তলস্তয়, সাহিত্যিক তলস্তয়
লিও তলস্তয়

জীবন এমন এক যাত্রা, যেখানে পথের বাঁকে বাঁকে রয়েছে গল্প, অভিজ্ঞতা আর বদলে যাওয়ার কাহিনি। এমনই এক জীবনের নাম লিও তলস্তয়। যিনি প্রথমে হয়েছিলেন সৈনিক, পরে রূপ নিয়েছিলেন একজন চিন্তাশীল সাহিত্যিক ও দার্শনিকে। নিজের জীবনে পরিবর্তন এনে, তিনি অসংখ্য মানুষের জীবনের মানে খুঁজে পেতে সাহায্য করেছেন। তলস্তয় শুধু একটি নাম নয়, বরং এক জীবন্ত আদর্শ। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষ যদি চায়, তবে নিজেকে বদলানো সম্ভব—এবং তিনিই তার জীবন্ত প্রমাণ।

লিও তলস্তয়ের পুরো নাম ছিল কাউন্ট লেভ নিকোলায়েভিচ তলস্তয়। জন্ম ১৮২৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর, রাশিয়ার টুলা প্রদেশের ইয়াস্নায়া পলিয়ানা নামক এক গ্রামে। বাবা-মায়ের অভিজাত পরিবারে জন্ম হলেও, তার শৈশবটা কেটেছে অনেক দুঃখ-কষ্ট আর প্রিয়জন হারানোর মধ্য দিয়ে। মাত্র দুই বছর বয়সেই মাকে হারান, এরপর বাবা, দাদি ও ফুফুকেও হারাতে হয় খুব অল্প বয়সে। এক ফুফুর কাছে কাজান শহরে বড় হন তলস্তয়।

শৈশবে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়াশোনা শুরু হয়। পরে ভর্তি হন কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্রথমে ভাষা, পরে আইন নিয়ে পড়েন। কিন্তু আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় তার মন বসত না। বরং মন পড়ত ফরাসি ও ইংরেজ লেখকদের লেখায়, বিশেষ করে রুশোর চিন্তাধারা তার উপর গভীর প্রভাব ফেলে। অবশেষে কোনো ডিগ্রি ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন।

শিক্ষাজীবন ছেড়ে ফিরে যান নিজের গ্রামে, কৃষিকাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেখানেও মন বসে না। তখন বড় ভাইয়ের পরামর্শে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ককেশাসে সৈনিক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে যুদ্ধ, প্রকৃতি ও সাধারণ মানুষের জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখেন। এই অভিজ্ঞতা থেকেই জন্ম নেয় তার প্রথম সাহিত্যিক ভাবনা।

এই সময়েই তিনি লেখেন নিজের শৈশব নিয়ে ‘শৈশব’ নামে উপন্যাস, যা পাঠিয়ে দেন একটি পত্রিকায়। সম্পাদক লেখাটি পড়ে মুগ্ধ হয়ে উত্তর পাঠান, এবং তলস্তয় সাহিত্যের পথে আরও উৎসাহ পান।

১৮৫৪ সালে তলস্তয় পাঠানো হয় ক্রিমিয়ায়, যেখানে রাশিয়া এক ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। যুদ্ধের নৃশংসতা তাকে মানসিকভাবে নড়ে দেয়। তিনি বুঝতে পারেন, যুদ্ধ কখনো মানুষের প্রকৃত কল্যাণ বয়ে আনে না। যুদ্ধ থেকে ফিরে সেনাবাহিনী ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন।

এরপর তিনি ফিরে যান নিজের গ্রামে। শুরু করেন আত্মজীবনীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্ব—‘কৈশোর’ ও ‘যৌবন’। এই তিনটি উপন্যাসই (শৈশব, কৈশোর, যৌবন) তার জীবনের প্রতিচ্ছবি, যেখানে একজন মানুষ কীভাবে বড় হয়, নিজেকে খুঁজে পায়, তার গল্প বলা হয়েছে।

তলস্তয় কিছুদিন ইউরোপ ভ্রমণ করেন। প্যারিসে গিয়ে একদিন ফাঁসির দৃশ্য দেখে তিনি এতটাই মর্মাহত হন যে, মানবজাতির প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। ফিরে এসে বিয়ে করেন ডাক্তার কন্যা সোফিয়াকে। এই দম্পতির ঘরে জন্ম হয় ১৩ সন্তানের।

এ সময় থেকে তিনি পুরোপুরি সাহিত্যচর্চায় মন দেন। লিখেন ‘কসাক’ নামে একটি উপন্যাসিকা। এরপর শুরু করেন তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘ওয়ার এন্ড পিস’, যা তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যকর্ম বলে ধরা হয়।

‘ওয়ার এন্ড পিস’: ইতিহাস, প্রেম আর জীবনের সংমিশ্রণ

‘ওয়ার এন্ড পিস’ উপন্যাসটি শুধু যুদ্ধ নয়, বরং মানুষের জীবনের গভীর দার্শনিকতা নিয়ে লেখা। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের রাশিয়া আক্রমণের সময়ের প্রেক্ষাপটে লেখা এই উপন্যাসে রয়েছে কয়েকটি অভিজাত পরিবারের জীবনের ওঠানামা, প্রেম, আত্মত্যাগ, যুদ্ধ আর মানবতা। ৬০০-র বেশি চরিত্র আর বিশাল পরিসরের এই উপন্যাস প্রকাশের পরই বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলে দেয়।

‘ওয়ার এন্ড পিস’-এর পর তিনি লেখেন ‘আন্না কারেনিনা’, যেখানে একজন নারীর সমাজের সাথে সংগ্রাম, তার প্রেম ও তার পরিণতির গল্প বলা হয়েছে। বইটির প্রথম লাইন আজও বিখ্যাত—

“সব সুখী পরিবার একরকম, কিন্তু সব অসুখী পরিবার অসুখী নিজের নিজেরভাবে।”

এই উপন্যাস অবলম্বনে পরবর্তীতে বহু সিনেমা ও নাটক নির্মিত হয়েছে।

তলস্তয় জীবনের মধ্যবয়সে এসে গভীর সংকটে পড়েন—জীবনের আসল উদ্দেশ্য কী? শুধু খ্যাতি আর অর্থ কি জীবনের শেষ কথা? তিনি খুঁজতে থাকেন ধর্মে এর উত্তর। কিন্তু চার্চ তাকে আশ্বস্ত করতে পারেনি। বরং তিনি অনুভব করেন চার্চ থেকে মানুষ দূরে সরে যাচ্ছে। তাই তিনি লেখালেখির মাধ্যমে নিজের মতবাদ প্রকাশ করেন।

তিনি ধনসম্পদ ত্যাগ করার চিন্তা করেন, যা নিয়ে স্ত্রী সোফিয়ার সঙ্গে বিরোধ শুরু হয়। ধীরে ধীরে এই মতবিরোধ এতটাই চরমে পৌঁছে যে, শেষ বয়সে তলস্তয় বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যান।

১৯১০ সালের নভেম্বর মাসে, স্ত্রী ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব এড়িয়ে তিনি তার মেয়ে ও একজন চিকিৎসককে নিয়ে অজানার পথে যাত্রা করেন। কিন্তু বয়সজনিত কারণে বেশি দূর যেতে পারেননি। রাশিয়ার আস্তাপোভে এক ট্রেন স্টেশনের পাশে একটি বাড়িতে তার শরীর ভেঙে পড়ে। সেখানেই ২০ নভেম্বর, ৮২ বছর বয়সে তলস্তয় মৃত্যুবরণ করেন। পরে তাকে ইয়াস্নায়া পলিয়ানার প্রিয় গ্রামে সমাহিত করা হয়।

তলস্তয়ের জীবন ও আদর্শ শুধু সাহিত্যে নয়, রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলেছে। তার ‘অহিংস’ মতবাদ ভারতীয় নেতা মহাত্মা গান্ধী-কে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। গান্ধী নিজেই তলস্তয়ের সঙ্গে চিঠিপত্র চালাচালিও করতেন।

তলস্তয়ের আদর্শ রুশ বিপ্লবেরও পথপ্রদর্শক হয়। তার লেখায় বারবার উঠে এসেছে—মানুষ কী নিয়ে বাঁচে, ভালোবাসা কী, নৈতিকতার গুরুত্ব কতখানি।

তিনি সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার জন্য বারবার মনোনীত হয়েছিলেন, কিন্তু কোনোবারই পাননি। আবার শান্তির জন্যও মনোনয়ন পেয়েছিলেন। অনেকে বলেন, এ এক বড় ভুল ছিল নোবেল কমিটির। তবে তাতে কিছু আসে যায় না। কারণ তলস্তয়ের সাহিত্য, চিন্তা ও আদর্শ নোবেল পুরস্কারের চেয়েও বড়।

লিও তলস্তয় এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি নিজেকে বদলে নিতে পেরেছিলেন, আর তাই বদলে দিতে পেরেছিলেন অন্যদের। একজন মানুষ কীভাবে নিজের ভেতরের আলো দিয়ে অন্ধকার ভাঙে, তা শিখতে চাইলে তলস্তয়ের জীবনটাই এক অনুপম পাঠশালা। সাহিত্য দিয়ে তিনি বেঁচে আছেন, থাকবেন অনন্তকাল।

r1 ad
top ad image