top ad image
top ad image
home iconarrow iconফিচার

ইতিহাস

উপমহাদেশের প্রথম যুদ্ধ!

উপমহাদেশের প্রথম যুদ্ধ!
চ্যাটজিপিটির চোখে দশরাজ যুদ্ধ

আমরা যখন ভারতের ইতিহাসের প্রথম যুদ্ধ নিয়ে ভাবি, তখন অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে—“প্রথম যুদ্ধ” বলতে কোনটিকে বোঝানো হচ্ছে? ভারতের মাটি তো হাজার হাজার বছরের পুরনো সভ্যতার সাক্ষী, এখানে তো বহু যুদ্ধ হয়েছে—আক্রমণকারী এসেছে বহিরাগত হয়ে, রাজ্য জয় করেছে, সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু ইতিহাসবিদদের মতে, "ভারতের ইতিহাসে প্রথম যুদ্ধ" বলতে মূলত বোঝানো হয় "দশরাজ যুদ্ধ" (Battle of Ten Kings)—যা ঘটেছিল বৈদিক যুগে, প্রায় ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এই যুদ্ধের তথ্য পাওয়া যায় আমাদের প্রাচীনতম সাহিত্যগ্রন্থ ঋগ্বেদ-এ, যা শুধু ধর্মীয় নয়, ঐতিহাসিক দলিল হিসেবেও বিবেচিত হয়।

দশরাজ যুদ্ধ বা “দশজন রাজা বনাম এক রাজা”র এই যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন একজন—রাজা সৌদাসা (অন্য মতে রাজা সুধাস বা রাজা ভারত), আর তাঁর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন দশটি গোষ্ঠীর রাজারা। এই যুদ্ধ হয়েছে সরস্বতী নদীর তীরে—আজকের পাকিস্তানের পাঞ্জাব অঞ্চলের কাছাকাছি, যাকে গবেষকরা বলেন “সরস্বতী-দৃশ্য” এলাকা।

ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডলে (৭.১৮-৭.৩৩) এই যুদ্ধের বিশদ বিবরণ আছে। সেখানে বলা হয়েছে, রাজা সুদাস ছিলেন ত্রিতসু গোষ্ঠীর নেতা, যাঁকে তাঁর পুরোহিত বিষ্ণুমিত্র কৌশিক এবং পরে বসিষ্ঠ সহায়তা করেন। তাঁর বিরুদ্ধে একত্রিত হয়েছিল দাশরাজ বা দশজন রাজা—যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পুরু, দ্রুহ্যু, অনু, পাক্থ, শিব, ভরৎ ইত্যাদি গোত্র। তাঁরা একযোগে আক্রমণ করেছিলেন সুদাসকে, কিন্তু তিনি বিজয়ী হন।

ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার বলেন, “দশরাজ যুদ্ধ ছিল মূলত রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াই। এখানে গোত্র বা গোষ্ঠীর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা দেখা যায়। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়েই ভরট গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছিল, যাদের থেকেই পরে মহাভারতের ‘ভারত’ বংশের নামকরণ হয়।”

তবে এই যুদ্ধকে "ভারতের প্রথম যুদ্ধ" বলার ক্ষেত্রে মতভেদও আছে। ইতিহাসবিদ আর.সি. মজুমদার বলেন, “দশরাজ যুদ্ধ ছিল গোষ্ঠীভিত্তিক সংঘর্ষ, যদিও তা বৈদিক সাহিত্যে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। কিন্তু তা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক যুদ্ধ ছিল না, বরং সামাজিক ও ধর্মীয় প্রভাবও ছিল।”

আধুনিক প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই যুদ্ধের অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক করেন, কারণ সরাসরি প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে ঋগ্বেদের বিশ্লেষণ করে তাঁরা বুঝতে চেষ্টা করেছেন সেই সময়ের রাজনৈতিক পরিবেশ। ড. অমিতেশ ব্যানার্জী, যিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক, বলেন, “ঋগ্বেদ আমাদের ধর্মীয় আচার জানায় ঠিকই, তবে তার ভেতরে লুকিয়ে আছে ইতিহাসের গাঢ় ছায়া। দশরাজ যুদ্ধ তারই এক নিদর্শন।”

এই যুদ্ধ শুধু একটা সামরিক সংঘর্ষ ছিল না, বরং একধরনের সাংস্কৃতিক রূপান্তরেরও দ্যোতক। এই সময়েই পুরোহিতশ্রেণি ও যোদ্ধা শ্রেণির মধ্যে বিভাজন স্পষ্ট হয়। বসিষ্ঠ ও বিষ্ণুমিত্রের দ্বন্দ্ব, রাজা সুদাসের এক পুরোহিত ত্যাগ করে অন্যকে গ্রহণ—এসবই রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশ ছিল।

অনেক গবেষক আবার বলেন, দশরাজ যুদ্ধের মধ্যে ভারতের রাষ্ট্র গঠনের প্রাথমিক চিহ্ন পাওয়া যায়। আগে যেসব গোষ্ঠী স্বতন্ত্রভাবে বাস করত, তারা আস্তে আস্তে একীভূত হতে থাকে এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দিকে এগোয়। এই কেন্দ্রভিত্তিক শক্তি গঠনের ধারা পরবর্তী সময়ে মগধ, মৌর্য বা গুপ্ত সাম্রাজ্যের জন্ম দেয়।

ভারতের ইতিহাসের এই প্রথম যুদ্ধের প্রভাব শুধু সামরিক বা রাজনৈতিক ছিল না, এর সামাজিক দিকও বিশাল। পরবর্তী বৈদিক সমাজে গোত্রভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা থেকে রাজ্যভিত্তিক কাঠামোতে রূপান্তর শুরু হয়। ঋগ্বেদের পরবর্তী স্তোত্রগুলোতেও রাজ্য, ধর্ম, পুরোহিত ও শাসকশ্রেণির সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা পাওয়া যায়। দশরাজ যুদ্ধ যেন ছিল সেই বৃহৎ রূপান্তরের সূচনাপর্ব।

আজকের দিনে আমরা যখন কার্গিল যুদ্ধ, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পড়ি, তখন ভাবি—এটাই বুঝি যুদ্ধের চূড়ান্ত রূপ। কিন্তু এই দশরাজ যুদ্ধ মনে করিয়ে দেয়, ভারতের যুদ্ধ ইতিহাস হাজার হাজার বছরের পুরনো। রাজনৈতিক আধিপত্য, সামাজিক শৃঙ্খলা ও ধর্মীয় মতভেদ—সব মিলিয়ে আমাদের ইতিহাসের প্রথম যুদ্ধ ছিল নানা মাত্রিক এবং গভীর।

r1 ad
top ad image