বিজ্ঞান
যে আবিষ্কার ভুলিয়ে দিয়েছিল মৃত্যুযন্ত্রণা
যে আবিষ্কার ভুলিয়ে দিয়েছিল মৃত্যুযন্ত্রণা
আধুনিক ব্ল্যাকহোল তত্ত্ব এসেছে আলবার্ট আইস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা থেকে। সেই তত্ত্ব বলে, মহাকর্ষ কোনো আকর্ষণ বল নয়।
ভারী বস্তু তার চারপাশের স্থানকালকে বাঁকিয়ে দেয়। সেই বাঁকানো স্থানকালের ভেতরে কোনো বন্তু থাকলে সেটা ওই ভারী বস্তুর দিকে হেলে পড়ে। যেমন সূর্য এর চারপাশের স্থান কাল বাঁকিয়ে রেখেছে। সেই বাঁকা স্থানকালের ভেতরে আটকে গেছে পৃথিবীসহ অন্য গ্রহগুলো। এর ভেতরেই ঘুপাক খেতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। তাই দেখে আমরা মনে করি, সূর্যর আকর্ষণে বুঝি গ্রহগুলো ঘুরছে।
তেমনি পৃথিবী এর চারপাশের স্থানকাল এমনভাবে বাঁকিয়ে রেখেছে যে, গাছের আপেল ঠিক পৃথিবীর বুকেই আছড়ে পড়বে।
অর্থাৎ আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা হলো নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রের পরিমার্জিত রূপ। নিউটনের মহকর্ষ সূত্র বুধ গ্রহের গতি-প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে পারত না। সেটার সমাধান করতে গিয়েই আইনস্টাইন সাধারণ আপেক্ষিকতার জন্ম দেন।
সাধারণ আপেক্ষিকতা বুধগ্রহের গতি-প্রকৃতি তো ব্যাখ্যা করতে পারেই, সেই সঙ্গে নিউটনের মহাকর্ষ যেসব বিষয়ের সমাধান দিতে পারে, সেগুলোর সমাধানও নির্ভুলভাবে দেয়। সুতরাং আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা শিগগিরি বিজ্ঞানীসমজে প্রভাব বিস্তার করে।
২.
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে তখন। জার্মানির হয়ে যুদ্ধ করছেন একজন পদার্থবিজ্ঞানী। নাম তাঁর কার্ল শোয়ার্জশির্ড। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর কাজ ছিল সৈন্যদের নিক্ষেপ করা গোলাবারুদের সঠিক দিক-নির্দেশনা দেওয়া। যাতে গোলা ছুড়লে ঠিক লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছায়। লোকটা যুদ্ধে এসেছিলেন দেশমাতৃকার টানে। একেবারে নিজের ইচ্ছায়। কিন্তু বিজ্ঞানী মানুষ, যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করলেও বিজ্ঞান থেকে দূরে থাকতেন না। সভ্য সমাজ থেকে নিয়মিত বিজ্ঞানের জার্নাল পাঠানো হতো তাঁর কাছে।
১৯১৪ সাল তিনি যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। খুব শিগগির তার মুখ আলসার দেখা দেয়। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছটফট করেন। কিন্তু এটাকে গুরত্ব দেননি তেমন। আর দশটা সাধারণ ঘা হিসেবেই দেখছিলেন। ২০১৫ সালের নভেম্বরে আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রকাশ করেন। দশটি সমীকরণের সমাহারে তৈরি একটা জটিল তত্ত্ব। সমীকরণগুলোর সমাধানও বেশ জটিল।
শিগগিরিই আইনস্টাইনের এই পেপারের কপি পৌঁছে যায় যুদ্ধক্ষেত্রে। শোয়ার্জশিল্ডের হাতে। তিনি কাজের ফাঁকে, আর আলসারের যন্ত্রণার মধ্যেই মন দিয়ে পড়লেন আইনস্টাইনের তত্ত্ব। তাঁর মনে হলো তত্ত্বের সমাধানগুলো বড্ড জটিল হয়ে গেছে। আরও সহজ সমাধান হতে পারত। তিনি নিজে হিসাব করে নতুন সমাধান বের করলেন। তারপর সেগুলো পাঠিয়ে দিলেন আইনস্টাইনের ঠিকানায়।
আইনস্টাইন বার্লিনের বসে সেই সমাধান পড়লেন মুগ্ধ হয়ে। পরে প্রুশিয়ান একাডেমির সভায় পরিচয় করিয়ে দিলেন একজন অখ্যাত বিজ্ঞানীর কাজকে। সেদিন থেকেই কার্ল শোয়ার্জশিল্ডের নামটা বিজ্ঞানীরা জেনে গেলেন। অন্যদিকে আইনস্টাইন শোয়ার্জশিল্ডের কাজের ভূয়শি প্রসংশা করে তাঁকে একটি চিঠি লিখলেন।
চিঠিটা শোয়ার্জশিল্ডের আনন্দ বাড়িয়ে দিয়েছিল বহুগুনে। কিন্তু আনন্দ করার মতো শারিরিক অবস্থা তাঁর ছিল না। মুখের আলসারগুলো ততদিনে ছড়িয়ে পড়েছে গোটা শরীরে। প্রচণ্ড ব্যথা আর যন্ত্রণায় দিন কাটছে। তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রের এক হাসপাতালে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন পেমফিগাস ভালগারিস নামের এক দুরারোগ্য বাধ্যিতে আক্রান্ত তিনি। এর কোনো চিকিৎসা নেই।
যন্ত্রণা ভুলতে শোয়ার্জশিল্ড আরও বেশি করে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিতা নিয়ে ডু থাকতেন। খাতাকলমে করতেন গাণিতিক কাঁটাছেঁড়া। সত্যি বলতে কি, শোয়ার্জশিল্ড খেয়াল করে দেখেছেন, যখন তিনি তত্ত্ব নিয়ে মেতে থাকেন, করেন গাণিতিক হিসাব-নিকাশ, তখন ব্যাথা-যন্ত্রণা যেন কোথায় পালিয়ে যায়। তাই আরও বেশি করে হিসাব-নিকাশে ডুবে যান।
শরীরের অবস্থা তখন খুবই খারাপ। নড়াচড়া করার শক্তিটাও হারিয়ে ফেলেছেন। ওদিকে হিসাব-নিকাষের জালও গুটিয়ে ফেলেছেন শোয়ার্জশিল্ড। আইনস্টাইনের তত্ত্বের আরেকটা অদ্ভুত সমাধান বেরিয়ে এসেছে। সেই সমাধানের মূল বক্তব্য বিস্ময়কর। হিসাব থেকে দেখা গেছে, যেকোনো ভারী বস্তুকে সংকুচিত করে একটা নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধে নিতে পারলে, সেই বস্তুর ঘনত্ব বেড়ে যাবে প্রচণ্ড মাত্রায়। ফলে তার চারপাশের স্থানকাল বেঁকে যাবে ভয়ংকরভাবে। সেই বস্তুর কাছাকাছি তখন যে জিনিস আসুক, বস্তুটা সেটাকে গিলে খাবে। এমনকী সেই বস্তুর কাছ থেকে কোনো আলোও বেরিয়ে আসতে পারবে না।
যেমন সবটুকু ভর ঠিক রেখে যদি সূর্যকে সংকুচিত ব্যাসার্ধ্য কমিয়ে তিন কিলোমিটারে নিয়ে আসা যায়, এটা সেই মহাখাদক বস্তুতে পরিণত হবে। বহু পরে ১৯৬৮ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী জন হুইলার এই বস্তুটার নামকরণ করেছিলেন ব্ল্যাকহোল। অন্যদিকে পৃথবীর ব্যাসার্ধ্য কমিয়ে যদি মাত্র এক সেন্টিমিটারে নিয়ে আসা যায়, তাহলে পৃথিবী ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে। আর এই বিশেষ ব্যাসার্ধেরে নামকরণ করা হয়েছে ‘শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধ্য’ নামে।
সময় ঘনিয়ে আসছে বুঝতে পেরে শোয়ার্জশির্ড দ্রুত তাঁর কাজ শেষ করেন। এবং পাঠিয়ে দেন আইনস্টাইনের কাছে। আগেরবারের মতোই আইনস্টাইন শোয়ার্জশিল্ডের এই পেপার পড়ে শোনান প্রুশিয়ান অ্যাকাডেমির সভায়। কিন্তু ব্ল্যাকহোলের এই তত্ত্ব আইনস্টাইন আজীবন মানতে পারেননি।
দ্বিতীয় এই পেপার আইনস্টাইনের কাছে পাঠানোর পর শোয়ার্জশিল্ড আর কোনো কাজ করতে পারেননি। বাকি কয়েকটা মাস ধুকে ধুকে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে কাটে। শেষমেষ ১৯১৬ সালের ১১ মে তিনি মারা যান। মাত্র ৪২ বছর বয়সে।
আইনস্টাইন না মানলেও যুক্তরাষ্ট্রের নিউক্লিয়ার বোমার জনক রবার্ট ওপেনহাইমার এটা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে নিউক্লিয়ার বোমা তৈরির কাজে জড়িয়ে পড়েন বলে এ গবেষণা আর এগোয়নি। ষাটের দশকে এসে বিখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ও রজার পেনরোজের কলাণ্যে আবার ব্ল্যাকহোল তত্ত্ব হালে পানি পায়। হ্যাঁ, এখনকার ব্ল্যাকহোল হয়তো পুরোপুরি শোয়ার্জশিল্ডের মতো নয়। কিন্তু শোয়ার্জশিল্ডের ওই গবেষণার ওপর দাঁড়িয়েই ব্ল্যাকহোল জিনিসটা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি পেয়েছিল। তাই শোয়ার্জশিল্ডের তত্ত্ব কিন্তু ভুল প্রমাণিত হয়নি। বরং এটাই হলো ব্ল্যাকহোলের বেসিক তত্ত্ব। সূর্য হয়তো ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে না কখোনো। কারণ, একে সংকুচিত করে শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধে নেওয়া সম্ভব নয়। পৃথিবীকে এক সেন্টিমিটারে সংকুচিত করা সম্ভব নয়। কিন্তু সূর্যর চেয়ে কয়েকগুণ বড় নক্ষত্রগুলোর পক্ষে সম্ভব। এ জন্য বিজ্ঞানীদের কিছু করতে হয় না। নক্ষত্রের ভেতরের যখন জ্বালানি ফুরিয়ে যায়, তখন এদের ভেতরের বস্তুকণাগুলোর মধ্যে মাহাকর্ষীয় আকর্ষণ বল বাড়তে থাকে। ফলে সেগুলো খুব কাছাকাছি চলে আসে। সংকুচিত হতে শুরু করে গোটা নক্ষত্র। এক সময় সেটা নিজের কেন্দ্রের দিকে ভেঙে পড়ে। ফলে ছোট হয়ে শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধেরে ভেতর চলে আসে। তখন সেই নক্ষত্র পরিণত হয় ব্ল্যাকহোলে।
ব্ল্যাকহোলের সেই শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধের শেষ সীমাটাকেই এখন ইভেন্ট হরাইজন বা ঘটনা দিগন্ত নামে ডাকা হচ্ছে। মোটকথা আধুনিক ব্ল্যাকহোলের যে ভিত্তি, সেটা গড়েই উঠেছিল মৃত্যুর কয়েকদিন আগে হাসাপাতালে শুয়ে যন্ত্রণাকাতর এক বিজ্ঞানীর হাতে।
সূত্র: সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান