top ad image
top ad image
home iconarrow iconঘরের রাজনীতি

দ্য গার্ডিয়ানকে ড. ইউনূস

গাজার মতো বিধ্বস্ত অবস্থায় দেশকে রেখে গেছেন শেখ হাসিনা

গাজার মতো বিধ্বস্ত অবস্থায় দেশকে রেখে গেছেন শেখ হাসিনা
ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে বাংলাদেশ ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে সোমবার। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান সাইটের স্ক্রিনশট

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা যখন গত বছরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন, ওই সময়ের বাংলাদেশকে ফিলিস্তিনের যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা জনপদের সঙ্গে তুলনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

প্রভাবশালী ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ঘরবাড়ি বা স্থাপনা নয়, বরং একটি দেশ পরিচালনার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তার সবকিছুই ধ্বংস করে রেখে গেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। সেখান থেকে তার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।

সোমবার (১০ মার্চ) দ্য গার্ডিয়ান “মুহাম্মদ ইউনূস অন পিকিং আপ দ্য পিসেস ইন বাংলাদেশ আফটার ‘মনুমেন্টাল’ ড্যামেজেস বাই শেখ হাসিনা’স রুল” শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

প্রতিবেদনটির প্রতিবেদক হান্নাহ এলিস-পিটারসেনের প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘তিনি (শেখ হাসিনা) যে ক্ষতি করে রেখে গেছেন তা বিশাল। ওই সময় দেশ ছিল সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত, ঠিক যেন আরেকটি গাজা। তবে পার্থক্য হলো— এখানে কোনো ভবন বিধ্বস্ত হয়নি, বরং সব প্রতিষ্ঠান, নীতিমালা, মানুষ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে।’

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গত বছরের আগস্টে দেশে ফেরেন, ওই সময় বাংলাদেশের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। সড়কগুলো তখনো ছিল রক্তে ভেজা, মর্গগুলো ছিল পুলিশের গুলিতে শিশুসহ সহস্রাধিক মানুষের স্তূপে পূর্ণ।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে তখন মাত্রই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটেছে। শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে করে পালিয়েছেন ভারতে। তার দলের লোকজন তখন আত্মগোপনে। বিক্ষুব্ধ জনতা তখন শেখ হাসিনার নৃশংসতার প্রতিশোধ নিতে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে হামলা চালিয়ে লুটপাট করেছে।

দ্য গার্ডিয়ান বলছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দেড় দশকের এই শাসনামলের বড় একটি সময় দেশের বাইরে কাটিয়েছেন দরিদ্রদের জন্য ক্ষুদ্রঋণের পথপ্রদর্শক হিসেবে নোবেল পুরস্কারজয়ী অধ্যাপক ইউনূস। শেখ হাসিনা রাজনৈতিকভাবে হুমকি মনে করতেন তাকে। ফলে এই দেড় দশকে অধ্যাপক ইউনূস বারবার অপমান ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। দেশে স্বাধীনভাবে তাকে কাজ করতে দিতেন না শেখ হাসিনা। বলা যায় অধ্যাপক ইউনূস রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাও ছেড়ে দিয়েছিলেন।

ছাত্র-জনতার জোয়ারের মুখে শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনর্প্রতিষ্ঠা করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিতে অধ্যাপক ইউনূসকে অনুরোধ জানায় গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্ররা। তাদের এ অনুরোধে সাড়া দেন অধ্যাপক ইউনূস, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

গার্ডিয়ানের প্রতিদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার শাসনামল ছিল অত্যাচার, সহিংসতা ও দুর্নীতির অভিযোগে পরিপূর্ণ। জুলাই-আগস্টে মাত্র কয়েক সপ্তাহে প্রায় ১৪ শ মানুষের রক্তের ওপর দিয়ে তার এই শাসনামলের অবসান ঘটে। ওই অভ্যুত্থান নিয়ে অনুসন্ধানের পর জাতিসংঘ বলছে, শেখ হাসিনার নির্দেশে পুলিশের সহিংস দমন-পীড়ন মানবতাবিরোধী অপরাধের সামিল হতে পারে। তবে শেখ হাসিনা অতিরিক্ত বল প্রয়োগের সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

অধ্যাপক ইউনূসের বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছে গার্ডিয়ান। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর ছয় মাসে শেখ হাসিনার সুরক্ষা বলয়ে থেকে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালানো ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি করেছেন। শেখ হাসিনার বিরোধী ও সমালোচকদের যেসব গোপন বন্দিশালায় নিয়ে নির্যাতন করা হতো বলে অভিযোগ রয়েছে, সেগুলোও খালি করা হয়েছে। মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে শত শত অভিযোগ উঠেছে, যেগুলো সবই তিনি অস্বীকার করেছেন।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস এ বছরের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। গার্ডিয়ান বলছে, এই নির্বাচন হলে সেটি হবে কয়েক দশকের মধ্যে বাংলাদেশে প্রথম অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন অধ্যাপক ইউনূস। কিন্তু ঢাকার রাজপথে বের হলে মনে হতে পারে বাংলাদেশ একটি সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। অধ্যাপক ইউনূস এখনো বিভিন্ন মহলে ব্যাপকভাবে আদৃত হলেও তার রাষ্ট্র পরিচালনার সক্ষমতা ও প্রতিশ্রুত সংস্কার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

গার্ডিয়ান বলছে, রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ক্ষমতায় ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে আছে। তারা অধ্যাপক ইউনূসের ওপর দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের জন্য চাপ তৈরি করছে। অন্যদিকে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্ররাও নিজেদের রাজনৈতিক দল গঠন করেছে।

খুব শিগগিরই নির্বাচন না-ও হতে পারে— এমন আশঙ্কার কথা তুলে ধরে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গার্ডিয়ানকে বলেছেন, ‘এই সরকার শুধু একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা। এখনকার দৈনন্দিন কার্যক্রমের জন্য কাউকেই দায়বদ্ধ করা যাচ্ছে না। সংস্কার নিয়ে কথা হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্যও তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, ম্যান্ডেট বা সক্ষমতা নেই।’

শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ যে অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে, সেগুলোকে গার্ডিয়ানের কাছে শেখ হাসিনার শাসনের পরিণতি হিসেবেই চিত্রিত করছেন অধ্যাপক ইউনূস।

তিনি বলেন, হাসিনার শাসনামলে কোনো সরকার ছিল না। এটি ছিল ডাকাত পরিবারের মতো। বসের কাছ থেকে কোনো আদেশ এলে তা বাস্তবায়ন করা হতো। কেউ সমস্যা তৈরি করছে? তাদের অদৃশ্য করে দেওয়া হতো। নির্বাচন করতে চান? তারা নিশ্চিত করত যে আপনি সব আসন জিতবেন। টাকা চান? তারা ব্যাংক থেকে এমন একটি মিলিয়ন ডলারের ঋণ নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিত যা কখনো ফেরত দিতে হবে না।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার সময়ে দুর্নীতির মাত্রা এমন ছিল যে ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে একবারে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা হয়েছে এবং অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনার আত্মীয়দের মধ্যে আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের একজন হলেন তার ভাগ্নি, যিনি যুক্তরাজ্যের লেবার এমপি টিউলিপ সিদ্দিক। খালার প্রভাবে নানা ধরনের সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তার নামে, যা বাংলাদেশে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এমন অভিযোগ ওঠার পর তিনি ব্রিটেনের মন্ত্রিত্ব ছেড়েছেন, যদিও তিনি কোনো ধরনের অন্যায় সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

গার্ডিয়ান বরছে, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডের আর্থিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে বাংলাদেশ সরকার, দেশটি থেকে যেন পাচার হওয়া আনুমানিক ১৭ বিলিয়নেরও বেশি ডলারের অর্থ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালানো যায়। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজনরা দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে এই টাকা সরিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এই অর্থ দ্রুত ফেরত আসার আশা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘ব্যাংকগুলোকে জনগণের অর্থ লুট করার পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। এতে সরকারের সক্রিয় অংশগ্রহণও ছিল। তারা তাদের কর্মকর্তাদের বন্দুকসহ পাঠাত সব কিছু অনুমোদন করানোর জন্য।’

শেখ হাসিনার তার শাসনামলে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলতেন। বর্তমানে তিনি সেই প্রতিবেশী দেশেই আশ্রিত। এ কারণে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অধ্যাপক ইউনূস নেতৃত্বে থাকাকালীন ভারত এই সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বরং সম্প্রতি দিল্লি ঢাকাকে ‘সন্ত্রাসবাদকে স্বাভাবিকীকরণ’ করার অভিযোগ এনেছে।

অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, ভারত যদি শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেয়, তবে তা সহ্য করা যেতে পারে। কিন্তু ভারতে অবস্থান করে বাংলাদেশের সব কাজ নস্যাৎ করতে প্রচারণা চালানোর অনুমতি দেওয়া বিপজ্জনক। এটি দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলে।

সম্প্রতি অধ্যাপক ইউনূস ট্রাম্পের বিলিয়নিয়ার সমর্থক ইলন মাস্ককে বাংলাদেশে তার স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক নিয়ে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। অধ্যাপক ইউনূসের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, মাস্ক এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ সফর করতে পারেন।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস আশাবাদ জানিয়েছেন যে ট্রাম্প বাংলাদেশকে ‘একটি ভালো বিনিয়োগের সুযোগ’ ও বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে দেখতে পারেন এবং মাস্কের সফরের সময় তিনি এই বিষয়টি তার সামনে উপস্থাপন করার পরিকল্পনা করছেন।

r1 ad
r1 ad
top ad image