রাজনীতি

বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস

অরুণাভ বিশ্বাস
আপডেট : ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১৭: ৩৭
প্রতিকী ছবি। ছবি : এআইয়ের তৈরি।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলন বড় বড় সব রাজনৈতিক পরিবর্তনেরই পরিবর্তন ঘটিয়েছে। পাশাপাশি জাতির চেতনাগত, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক রূপান্তরেরও চালিকা শক্তি হিসেবেওে কাজ করেছে এই আন্দোলন। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে শুরু করে পাকিস্তানি শাসনামল এবং পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্র সমাজ সবসময়ই ছিল আন্দোলনের অগ্রভাগে। তাদের শক্তিশালী অবস্থান, ত্যাগ এবং নেতৃত্ব সমাজে পরিবর্তন আনার জন্য এক অসাধারণ ইতিহাস তৈরি করেছে। এসব ইতিহাস জাতীয়ভাবেই তো বটে্ি, আন্তর্জাতিক গবেষণাতেও আলোচিত হয়েছে।

ব্রিটিশ শাসনামলে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিল প্রথম উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক সক্রিয়তা। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের ঘোষণা অনুযায়ী বাংলা বিভাজনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী ঢেউ ওঠে। তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকার বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্ররা লাইনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদে সামিল হয়। এরাই পরবর্তীতে স্বদেশি আন্দোলনে জড়িত হয়ে ব্রিটিশবিরোধী এক শক্তিশালী ছাত্র নেতৃত্ব গড়ে তোলে।

তবে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস নতুন মোড় নেয় পাকিস্তান আমলে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পূর্ব বাংলা বা বর্তমান বাংলাদেশ হয়ে ওঠে পাকিস্তানের একটি প্রদেশ – পূর্ব পাকিস্তান। শুরুর দিকেই ভাষার প্রশ্নে উপেক্ষা শুরু হয় পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হলে ১৯৪৮ সাল থেকেই বাঙালি ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সরাসরি রাস্তায় নামে, গঠিত হয় "তামাদ্দুন মজলিস", "রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ" ইত্যাদি ছাত্র সংগঠন।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেকে শহীদ হন। এই ঘটনা শুধু ভাষার দাবি নয়, বরং জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় ছাত্রসমাজের প্রথম রক্তক্ষয়ী লড়াই হয়ে ওঠে। জাতিসংঘ ২১ ফেব্রুয়ারিকে "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস" হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যার পেছনের কৃতিত্ব ছাত্র আন্দোলনের।

ভাষা আন্দোলনের পরে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবির সমর্থনে ছাত্রদের তৎপরতা এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল একে একে সেইসব অধ্যায়, যেগুলোতে ছাত্ররাই হয়ে ওঠে রাজনৈতিক রূপান্তরের প্রধান চালক। ছয় দফা আন্দোলনের সময় ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ রাজপথে যে সম্মিলিত শক্তি দেখিয়েছিল, তা পাকিস্তান সরকারকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, যেখানে ছাত্ররা "অ্যাসেম্বলি ফাঁসাও", "আয়ুববিরোধী আন্দোলন", "গণতন্ত্র চাই" ইত্যাদি স্লোগানে রাজপথ কাঁপিয়ে তোলে, তা শেষ পর্যন্ত আইয়ুব খানের পতনের পথে নিয়ে যায়। ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান (আসাদ) পুলিশের গুলিতে শহীদ হন, যার প্রতিক্রিয়ায় গোটা জাতি জেগে ওঠে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেও ছাত্রদের অবদান অনস্বীকার্য। "স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ" গঠনের মাধ্যমে তারা যুদ্ধের প্রাক্কালে দেশের সর্বত্র আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়। বহু ছাত্র সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়ে অংশ নেয়, অনেকে শহীদ হন। স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশের নতুন পথচলায় ছাত্র সমাজ যেমন উচ্চাশা নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর ছায়ায় ঢুকে পড়ে বিভাজন ও সংঘাতও।

স্বাধীনতার পরবর্তী সময়েও ছাত্র আন্দোলন থেমে থাকেনি। ১৯৮২ সালে সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে শিক্ষানীতির প্রতিবাদে ছাত্রদের ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে। ‘সংকোচ নয়, সংগ্রাম চাই’ ধ্বনি তুলে ছাত্ররা রাজপথে নামে। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনে ছাত্রসমাজ আবারও এক কাঁধে নেতৃত্বের ভার তুলে নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা – সবখানে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের মতো সংগঠনগুলো স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনকে তীব্র করে তোলে।

বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসগুলো হয়ে ওঠে গণতান্ত্রিক চর্চার কেন্দ্র। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগ করেন। এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়, নির্বাচিত সরকার গঠিত হয়। গবেষক ড. রিচার্ড বেনেটস্টুডেন্ট অ্যাক্টিভিজম ইন সাউথ এশিয়া বইয়ে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ওপর আলোকপাত করেছেন, বলেছেন—"বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলন ছিল রাজনৈতিক পরিবর্তনের একমাত্র নির্ভরযোগ্য বাহন, যা জনগণকে ক্ষমতার শেকড়ে সংযুক্ত করেছে।" তাঁর মতে, ভাষা আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত ছাত্ররাই ছিল নেতৃত্বের কারিগর।

বর্তমানে যদিও ছাত্র রাজনীতি অনেকটাই দলনির্ভর ও সংঘাতমুখী হয়ে উঠেছে, তথাপি কিছু গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে ছাত্রদের অগ্রণী ভূমিকা লক্ষ্য করা গেছে। ২০১৫ সালে ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সোচ্চার হয়। আবার ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং একই বছরের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন পুরো জাতিকে নাড়িয়ে দেয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংগঠিত হওয়া এসব আন্দোলনের নেতৃত্বেও ছিল মূলত ছাত্রসমাজ। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় ছাত্ররা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে, রাস্তায় প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়ায় এবং শৃঙ্খলার অনন্য নজির স্থাপন করে।

এই সময় আন্তর্জাতিক মিডিয়াও ছাত্রদের প্রশংসা করে। যুক্তরাজ্যের মিডলসেক্স ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানী ড. হ্যারল্ড কিংসলে বলেন—"বাংলাদেশের ছাত্রদের মধ্যে যে দায়িত্ববোধ, তা শুধু উন্নয়নশীল বিশ্বের নয়, বরং যে কোনো দেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য এক অনুপ্রেরণা।" তাঁর মতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে ছাত্ররা অত্যন্ত সংহত ও বুদ্ধিদীপ্তভাবে দাবি উপস্থাপন করতে পারে, যা বিশ্বজুড়ে নজিরবিহীন।

তবে সমসাময়িক সময়ে ছাত্র রাজনীতির একটা নেতিবাচক দিকও সামনে এসেছে – তা হলো সহিংসতা, সেশনজট, দলীয়করণ এবং ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণের লড়াই। অনেক সময়ই দেখা যায়, রাজনীতির ছায়ায় শিক্ষাঙ্গন হয়ে উঠেছে সংঘর্ষের মঞ্চ। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের জায়গা সংকুচিত হয়ে আসে।

এই প্রসঙ্গে কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ ড. জ্যানেট ড্যানিয়েলস বলেন—"ছাত্র আন্দোলন একসময় ছিল পরিবর্তনের জনভিত্তিক হাতিয়ার, এখন সেটি অনেকাংশেই হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক হাতিয়ার। এতে আন্দোলনের শক্তি হ্রাস পাচ্ছে এবং শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।"

তবে ইতিহাস বলে, যখনই জাতি সংকটে পড়ে, ছাত্রসমাজের মধ্য থেকেই জেগে ওঠে প্রতিরোধের শক্তি। এই জনপদের ইতিহাসে ছাত্রদের ত্যাগ, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, এবং সময়োচিত প্রতিবাদ ছিল এমন এক বাতিঘর, যেখান থেকে আলোর দিশা পেয়েছে গোটা জাতি।

ভবিষ্যতের বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলন কতটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে, তা নির্ভর করবে ছাত্ররাজনীতি কতটা গণমুখী, স্বতন্ত্র ও আদর্শভিত্তিক হতে পারে তার ওপর। কেননা, ইতিহাস সাক্ষী – রাজপথে সবচেয়ে দৃঢ় কণ্ঠস্বরটি বহুবারই এসেছে একজন ছাত্রের মুখ থেকেই।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

সুখবর পেলেন বিএনপির ২৮ নেতা

এতে বলা হয়েছে, ইতোপূর্বে হবিগঞ্জ জেলাধীন চুনারুঘাট উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সৈয়দ লিয়াকত হাসান স্বেচ্ছায় দল থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করা হয়েছে।

১৪ ঘণ্টা আগে

মৃত্যুদণ্ডই শেখ হাসিনার উপযুক্ত বিচার : আখতার

ভিডিও বার্তায় আখতার হোসেন বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ডই শেখ হাসিনার জন্য উপযুক্ত বিচার। এই রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ন্যায়বিচার করা সম্ভব হবে। সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই, অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে এই রায় সরকারকে কার্যকর করতে হবে।’

১৫ ঘণ্টা আগে

ধৈর্য, সতর্কতা ও ঐক্য বজায় রাখুন : জামায়াত আমির

পোস্টে তিনি আরও লিখেছেন, এই সংকটময় সময়ে আমি আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- আমাদের সংগ্রাম কারও বিরুদ্ধে নয়, আমাদের সংগ্রাম ন্যায়, অধিকার, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার পক্ষে। আমরা চাই এমন একটি বাংলাদেশ, যেখানে সব নাগরিক নিরাপদে মত প্রকাশ করতে পারে, যেখানে বিচার হবে নিরপেক্ষ এবং যেখানে পরিবর্তন আসবে শান্তিপূর্ণ

১৫ ঘণ্টা আগে

রাতে বৈঠকে বসছে বিএনপির স্থায়ী কমিটি

দলীয় সূত্রের তথ্যানুযায়ী, ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন ঘিরে দলীয় মনোনয়নকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হওয়া অস্থিরতা, বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ–অসন্তোষের পরিস্থিতি এবং সাংগঠনিক দুর্বলতা, এসব ইস্যু আজকের আলোচনায় গুরুত্ব পাবে।

১৫ ঘণ্টা আগে