প্রতিবেদক, রাজনীতি ডটকম
বর্ষপঞ্জির পাতায় আজ ৫ আগস্ট। ছাত্র-জনতার মনের পাতায় ৩৬ জুলাই। এক বছর আগে সহস্রাধিক প্রাণের বিনিময়ে এসেছিল এই দিন, যে দিন লাখো মানুষের ঢলের মুখে পতন ঘটেছিল ১৬ বছর ক্ষমতায় জেঁকে বসা আওয়ামী লীগ সরকারের। ছাত্র-জনতার স্রোতের মুখে সেদিন হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যার মধ্য দিয়ে টানা ৩৬ দিনের এক অবিস্মরণীয় আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
শেখ হাসিনার দেড় দশকের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানে তিন দিন পরই ছাত্র-জনতার প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। সেখানে স্থান পান রক্তক্ষয়ী জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া দুজন ছাত্র উপদেষ্টা। জুলাই গণহত্যার বিচারের পাশাপাশি ফ্যাসিবাদী শক্তির ক্ষমতায় আসার পথ রোধ করতে রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে সে সরকার।
আওয়ামী লীগের পতনের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার ঐতিহাসিক এই দিনটিকে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ফ্যাসিবাদী শক্তির পতন উদযাপনসহ এ দিনটি ঘিরে আজ মঙ্গলবার দিনব্যাপী নানা কর্মসূচিও নিয়েছে সরকার।
সকাল থেকেই দিবসটির উদযাপন শুরু হবে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে সেখানে দিনভর থাকছে বিভিন্ন ব্যান্ড ও শিল্পগোষ্ঠীর সংগীত পরিবেশন। এর মধ্যেই বিকেল ৫টায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে সবার অংশগ্রহণে ঐতিহাসিক ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করা হবে।
৩৬ জুলাই উদযাপনের আয়োজনে আরও থাকছে— ৬৪ জেলায় ‘জুলাই শহিদ স্মৃতিস্তম্ভে’ সকাল ৯টায় পুষ্পস্তবক অর্পণ। পাশাপাশি সারা দেশের প্রতিটি ধর্মীয় উপাসনালয়ে মোনাজাত ও প্রার্থনা হবে। এ দিন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের সব সার্কেল অফিস নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে রাস্তার পাশে বা নিজস্ব জায়গায়, ট্রাফিক ইন্টারসেকশনে বনজ, ফলজ ও ঔষধি গাছ রোপণ করবে।
এ দিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলোতে জুলাই নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র, ডকুমেন্টারি ও প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করা হবে। এ ছাড়া এদিন ‘নোটস অন জুলাই’ শিরোনামে জুলাইয়ের কিছু নির্বাচিত ছবি দিয়ে পোস্টকার্ড ডিজাইন করা হবে, যা জনসমাগমের মধ্যে ভলান্টিয়াররা নিয়ে ঘুরবেন এবং জনগণ ইচ্ছামতো পোস্টকার্ড নিয়ে নিজেদের জুলাইয়ের অভিজ্ঞতা লিখতে পারবেন।
ঐতিহাসিক এ দিবসটি উপলক্ষ্যে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বাণীতে তারা দুজনেই জুলাই আন্দোলনের শহিদদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন, স্মরণ করেছেন আন্দোলনে আহতদের। সবাইকে ঐতিহাসিক এ অর্জনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দনও জানিয়েছেন। জানিয়েছেন জুলাই আন্দোলনের চেতনা সবাই মিলে বাস্তবায়নের আহ্বান।
জুলাই অভ্যুত্থানের পটভূমি তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন বলেন, এ গণঅভ্যুত্থান ছিল দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, দুঃশাসন, দুর্নীতি, লুটপাট, গুম, খুন, অপহরণ, ভোটাধিকার হরণসহ সব ধরনের অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্ম ও আপামর জনতার ক্ষোভের বিস্ফোরণ।
জুলাইয়ের চেতনা বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, এই বৈষম্যমূলক ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপ করে গণতন্ত্র পুনর্প্রতিষ্ঠা, জনগণের ক্ষমতায়ন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করাই ছিল জুলাই অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য। একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে ফ্যাসিবাদের মূলোৎপাটন করে জুলাইয়ের চেতনার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।
বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, টানা ১৬ বছরের স্বৈরাচারী অপশাসনের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিস্ফোরণ ছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থান। জুলাই অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল একটি বৈষম্যহীন, দুর্নীতি ও স্বৈরাচারমুক্ত নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে রাষ্ট্রকে জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া।
ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সবাইকে এক থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, হাজারও শহিদের আত্মত্যাগ আমাদের রাষ্ট্র সংস্কারের যে সুযোগ এনে দিয়েছে তা যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। পতিত স্বৈরাচার ও তার স্বার্থলোভী গোষ্ঠী এখনো দেশকে ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হবে। আসুন, সবাই মিলে আমরা এমন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলি, যেখানে আর কোনো স্বৈরাচারের ঠাঁই হবে না।
একসময় সরকারি চাকরির ৫৬ শতাংশ পদে নিয়োগ হতো অগ্রাধিকারে কোটা থেকে। এর মধ্য্যে ৩০ শতাংশ পদ সংরক্ষিত ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য। এ ছাড়া ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা, ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও ১ শতাংশ পদ প্রতিবন্ধী প্রার্থী কোটার জন্য বরাদ্দ ছিল।
সরকারি সরকারিতে নিয়োগে এই অগ্রাধিকার কোটাব্যবস্থাকে বৈষম্য অভিহিত করে ২০১৮ সালেই শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন। সে আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত কোটাপদ্ধতি বাতিল করে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
সে পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট করেন চাকরিপ্রত্যাশী ও বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে গত বছরের ৫ জুন রায় দেন হাইকোর্ট। এতে ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল হয়েছে বলে জানান আইনজীবীরা।
এ অবস্থায় গত বছরের জুলাইয়ের প্রথম দিন কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে ফের আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। তারা সার্বিকভাবে অগ্রাধিকার কোটাকে ১০ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে এনে বাকি পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের দাবি জানান। এর মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করলেও সে আপিল শুনানি পিছিয়ে গেলে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন অব্যাহত রাখেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে সময় নেয়নি। ক্রমেই সে আন্দোলন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে দিনের পর দিন রাজপথে অবস্থান ধরে রাখেন শিক্ষার্থীরা।
আওয়ামী লীগ সরকার আরও অনেক আন্দোলনের মতোই শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে ‘সরকার পতনের ষড়যন্ত্র’ বলে আখ্যা দেয়। একপর্যায়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে পড়ে ছাত্রলীগ (বর্তমানে নিষিদ্ধঘোষিত) এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
১৬ জুলাই ঢাকাসহ সারা দেশে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। সেদিন প্রাণ হারান ছয়জন। এর মধ্যে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিরস্ত্র আবু সাঈদ বুক পেতে দাঁড়িয়েছিলেন, পুলিশের বুলেট ঝাঁঝরা করে দেয় তার বুক। এ দৃশ্যের ভিডিও বারুদ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশের শিক্ষার্থীদের বুকে।
শিক্ষার্থীরা দাবি আদায়ে রাজপথে অনড় থাকলে সরকারি বাহিনী এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষ-সংঘাতও বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে প্রাণহানি। একপর্যায়ে সরকার সারা দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়, জারি করে কারফিউ। তাতে দমানো যায়নি আন্দোলন, কমানো যায়নি প্রাণহানি।
এর মধ্যে সরকারি উদ্যোগে তড়িঘড়ি করে আপিল বিভাগে শুনানি করিয়ে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের আদেশ নিয়ে আসা হয়। কিন্তু ততক্ষণে আর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কেবল কোটাব্যবস্থা সংস্কারে সীমাবদ্ধ নেই। সহপাঠীদের প্রাণহানির বিচারের দাবিতে তখন উত্তাল শিক্ষার্থীরা। সাবেক সরকারপ্রধানের ক্ষমা প্রার্থনাসহ নানা দাবি তোলেন তারা। সরকারও সেসব দাবি মেনে নেওয়ার পথে হাঁটেনি।
জুলাইয়ের শেষ দিকে প্রথমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ককে ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যায় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। পরে একে একে তুলে নেওয়া হয় আরও তিনজনকে। ‘সমন্বয়করা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন’ বলে ডিবি তাদের নিরাপত্তা দিতে হেফাজতে নিয়ে রেখেছিল বলে জানায়। সপ্তাহখানেক পর ছয় সমন্বয়ককে দিয়ে একটি ভিডিও বিবৃতি দেওয়ানো হয় এই বলে— সরকার শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়েছে বলে আন্দোলন স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে।
সবার মধ্যেই সন্দেহ তৈরি হয়, চাপের মুখে হয়তো ছয় সমন্বয়ককে ওই বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয়েছে। অন্য সমন্বয়করা পালটা বিবৃতি দেন, ডিবি হেফাজতে থেকে দেওয়া বিবৃতি তারা মেনে নেননি, আন্দোলন চলবে। ফলে ডিবির ওই ‘নাটক’ও কাজে লাগেনি। বরং রাজপথে আন্দোলন আরও শক্তিশালী হতে থাকে। প্রাণহানিও বাড়তে থাকে।
জুলাই মাস শেষ হতে হতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আর শিক্ষার্থীদের মধ্যেও সীমাবদ্ধ থাকেনি। কিশোর-তরুণদের তাজা প্রাণ যখন রাজপথে ঝরছিল, তখন তাদের অভিভাবকরা আর বসে থাকতে পারেননি। একে একে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ রাজপথে সক্রিয় হতে থাকেন।
আন্দোলনের শুরুর দিকেই তখনকার সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা এই আন্দোলনকে ‘সরকার পতনে’র আন্দোলন হিসেবে একাধিকবার অভিহিত করেছিলেন। আগস্ট শুরু হতে হতে সত্যি সত্যিই সে আন্দোলনের গতিমুখ তার পদত্যাগের এক দফা দাবির দিকেই ধাবিত হতে থাকে। ছাত্র-জনতা সে দাবি আদায় করেও ছাড়ে।
আগস্টের প্রথম দিন ডিবি হেফাজত থেকে মুক্তি পান ছয় সমন্বয়ক। সে দিন প্রার্থনা, পদযাত্রা, বিক্ষোভ-সমাবেশসহ নানা আয়োজনে পালন করা হয় ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস’ কর্মসূচি। আলাদা করে সমাবেশ করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি জানান শিল্পীরা। পরদিন ২ আগস্ট ঘোষণা করা হয় ছাত্র-জনতার গণমিছিল কর্মসূচি।
আগস্টের দ্বিতীয় দিনেই ডিবি হেফাজত থেকে ছাড়া পাওয়া ছয় সমন্বয়ক এক বিবৃতিতে জানান, তাদের চাপ প্রয়োগ করে কর্মসূচি প্রত্যাহারের ভিডিও রেকর্ড করা হয়েছিল। এতে ছাত্র-জনতা আরও ক্ষোভে ফেটে পড়ে। পরদিন ৩ আগস্ট সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল ও ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল শেষে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে সমাবেশ এবং ৪ আগস্ট থেকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন সমন্বয়করা।
এ দিনই শহিদ মিনারে শিক্ষক, অভিভাবক, সংস্কৃতি কর্মী, সুশীল সমাজের সদস্য এবং বামপন্থি কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত হয় ‘দ্রোহযাত্রা’। পল্টন থেকে শুরু করে দ্রোহযাত্রা শেষ হয় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে। সেই কর্মসূচি থেকে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ সরকারপ্রধানের পদত্যাগের দাবি তোলেন।
৩ আগস্ট আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের গণভবনে আলোচনার জন্য আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সাফ জানিয়ে দেন, ‘গুলি আর সন্ত্রাসের সঙ্গে কোনো সংলাপ হবে না।’
বিকেলে বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে লাখো মানুষের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সমাবেশ থেকে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ঘোষণা করেন এক দফা দাবি— সরকার পতন। এ দাবিতে ৪ আগস্ট থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য অসহযোগ আন্দোলনও ঘোষণা করা হয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও ছাত্র-জনতার দাবি মেনে সরকারকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানান। এ দিন আলোচনায় আসে ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি।
আগের কয়েকদিনের মতো ৪ আগস্টও দেশব্যাপী ব্যাপক সহিংসতা হয়, প্রাণ হারান শতাধিক মানুষ। এর মধ্যে শাহবাগে বিপুল জনসমাগমের মধ্যে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। প্রথমে ৬ আগস্ট এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হলেও পরে সেটি এগিয়ে ৫ আগস্ট করা হয়। পরে ছাত্রনেতারা জানিয়েছেন, ‘মার্চ টু ঢাকা’ ঠেকাতে সরকার কঠোর অবস্থান নিচ্ছে ও সে অনুযায়ী প্রস্তুত হচ্ছে বলে তারা তথ্য পেয়েছিলেন। সে কারণেই সে কর্মসূচি একদিন এগিয়ে আনা হয়।
অবশেষে আসে ৫ আগস্ট। আগের দিন থেকেই ঢাকামুখী মানুষের আনাগোনা শুরু হয়েছিল। এ দিন সকাল থেকেই যেন ঢল নামতে থাকে ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে। একদিকে যাত্রাবাড়ী, আরেকদিকে উত্তরার আব্দুল্লাহপুর— এই দুটি পয়েন্ট বেলা গড়িয়ে সকাল ১০টা পার হতেই হয়ে ওঠে জনসমুদ্র। দুই পাশ থেকেই লাখ লাখ মানুষ ঢুকতে থাকে রাজধানীতে।
গণভবন থেকে তখনো বলা হচ্ছিল, যেকোনো উপায়ে ঢাকায় মানুষের প্রবেশ ঠেকাতে হবে। কিন্তু এই বিপুল জনস্রোত প্রতিরোধ করার সাধ্য ছিল না কোনো বাহিনীর। পুলিশ বাহিনী হাল ছেড়ে দেয়। সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত জানায়, বহির্শত্রুর হাত থেকে দেশের নাগরিকদের রক্ষার যে শপথ তারা নিয়েছে, রাজপথে তাদের বিরুদ্ধে তাদের পক্ষে অস্ত্র ধরা সম্ভব না। ছাত্র-জনতার বিজয় তখন আসন্ন। সে বিজয় বুঝে নিতে তারা রওয়ানা দেন গণভবনের পথে।
দুপুর ১টার দিকে খবর আসে, জনসাধারণের উদ্দেশে টেলিভিশনে ভাষণ দেবেন সেনাপ্রধান। ছাত্র-জনতা তখনই নিশ্চিত হয়ে যায়, বিজয় এসে গেছে, বাকি শুধু আনুষ্ঠানিকতা। দুপুর দেড়টা নাগাদ খবর আসে, শেখ হাসিনা তার ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে হেলিকপ্টারে করে ঢাকা ছেড়েছেন, গন্তব্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভারত।
দুপুর ২টার পর সেনাপ্রধান টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে নিশ্চিত করেন শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার খবর। জানান, ছাত্র-জনতা প্রতিনিধিসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে।
ততক্ষণে ছাত্র-জনতার দখলে গণভবন, সংসদ ভবন থেকে শুরু করে গোটা ঢাকা। সহস্রাধিক প্রাণহানির শোকের পথ বেয়ে ১৬ বছরের কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাচারকে হঠিয়ে বিজয় অর্জনের এক অনন্য দৃশ্যপট রাজপথে। একাত্তরের জনযুদ্ধ মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৫৪ বছর পর নব্বইয়ে গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পতনের সাক্ষী হয়েছিল মানুষ। ৩৫ বছর পর আরেক স্বৈরশাসনের অবসানের সাক্ষী হলো জাতি।
বর্ষপঞ্জির পাতায় আজ ৫ আগস্ট। ছাত্র-জনতার মনের পাতায় ৩৬ জুলাই। এক বছর আগে সহস্রাধিক প্রাণের বিনিময়ে এসেছিল এই দিন, যে দিন লাখো মানুষের ঢলের মুখে পতন ঘটেছিল ১৬ বছর ক্ষমতায় জেঁকে বসা আওয়ামী লীগ সরকারের। ছাত্র-জনতার স্রোতের মুখে সেদিন হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যার মধ্য দিয়ে টানা ৩৬ দিনের এক অবিস্মরণীয় আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
শেখ হাসিনার দেড় দশকের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানে তিন দিন পরই ছাত্র-জনতার প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। সেখানে স্থান পান রক্তক্ষয়ী জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া দুজন ছাত্র উপদেষ্টা। জুলাই গণহত্যার বিচারের পাশাপাশি ফ্যাসিবাদী শক্তির ক্ষমতায় আসার পথ রোধ করতে রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে সে সরকার।
আওয়ামী লীগের পতনের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার ঐতিহাসিক এই দিনটিকে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ফ্যাসিবাদী শক্তির পতন উদযাপনসহ এ দিনটি ঘিরে আজ মঙ্গলবার দিনব্যাপী নানা কর্মসূচিও নিয়েছে সরকার।
সকাল থেকেই দিবসটির উদযাপন শুরু হবে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে সেখানে দিনভর থাকছে বিভিন্ন ব্যান্ড ও শিল্পগোষ্ঠীর সংগীত পরিবেশন। এর মধ্যেই বিকেল ৫টায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে সবার অংশগ্রহণে ঐতিহাসিক ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করা হবে।
৩৬ জুলাই উদযাপনের আয়োজনে আরও থাকছে— ৬৪ জেলায় ‘জুলাই শহিদ স্মৃতিস্তম্ভে’ সকাল ৯টায় পুষ্পস্তবক অর্পণ। পাশাপাশি সারা দেশের প্রতিটি ধর্মীয় উপাসনালয়ে মোনাজাত ও প্রার্থনা হবে। এ দিন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের সব সার্কেল অফিস নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে রাস্তার পাশে বা নিজস্ব জায়গায়, ট্রাফিক ইন্টারসেকশনে বনজ, ফলজ ও ঔষধি গাছ রোপণ করবে।
এ দিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলোতে জুলাই নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র, ডকুমেন্টারি ও প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করা হবে। এ ছাড়া এদিন ‘নোটস অন জুলাই’ শিরোনামে জুলাইয়ের কিছু নির্বাচিত ছবি দিয়ে পোস্টকার্ড ডিজাইন করা হবে, যা জনসমাগমের মধ্যে ভলান্টিয়াররা নিয়ে ঘুরবেন এবং জনগণ ইচ্ছামতো পোস্টকার্ড নিয়ে নিজেদের জুলাইয়ের অভিজ্ঞতা লিখতে পারবেন।
ঐতিহাসিক এ দিবসটি উপলক্ষ্যে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বাণীতে তারা দুজনেই জুলাই আন্দোলনের শহিদদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন, স্মরণ করেছেন আন্দোলনে আহতদের। সবাইকে ঐতিহাসিক এ অর্জনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দনও জানিয়েছেন। জানিয়েছেন জুলাই আন্দোলনের চেতনা সবাই মিলে বাস্তবায়নের আহ্বান।
জুলাই অভ্যুত্থানের পটভূমি তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন বলেন, এ গণঅভ্যুত্থান ছিল দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, দুঃশাসন, দুর্নীতি, লুটপাট, গুম, খুন, অপহরণ, ভোটাধিকার হরণসহ সব ধরনের অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্ম ও আপামর জনতার ক্ষোভের বিস্ফোরণ।
জুলাইয়ের চেতনা বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, এই বৈষম্যমূলক ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপ করে গণতন্ত্র পুনর্প্রতিষ্ঠা, জনগণের ক্ষমতায়ন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করাই ছিল জুলাই অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য। একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে ফ্যাসিবাদের মূলোৎপাটন করে জুলাইয়ের চেতনার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।
বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, টানা ১৬ বছরের স্বৈরাচারী অপশাসনের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিস্ফোরণ ছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থান। জুলাই অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল একটি বৈষম্যহীন, দুর্নীতি ও স্বৈরাচারমুক্ত নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে রাষ্ট্রকে জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া।
ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সবাইকে এক থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, হাজারও শহিদের আত্মত্যাগ আমাদের রাষ্ট্র সংস্কারের যে সুযোগ এনে দিয়েছে তা যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। পতিত স্বৈরাচার ও তার স্বার্থলোভী গোষ্ঠী এখনো দেশকে ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হবে। আসুন, সবাই মিলে আমরা এমন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলি, যেখানে আর কোনো স্বৈরাচারের ঠাঁই হবে না।
একসময় সরকারি চাকরির ৫৬ শতাংশ পদে নিয়োগ হতো অগ্রাধিকারে কোটা থেকে। এর মধ্য্যে ৩০ শতাংশ পদ সংরক্ষিত ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য। এ ছাড়া ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা, ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও ১ শতাংশ পদ প্রতিবন্ধী প্রার্থী কোটার জন্য বরাদ্দ ছিল।
সরকারি সরকারিতে নিয়োগে এই অগ্রাধিকার কোটাব্যবস্থাকে বৈষম্য অভিহিত করে ২০১৮ সালেই শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন। সে আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত কোটাপদ্ধতি বাতিল করে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
সে পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট করেন চাকরিপ্রত্যাশী ও বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে গত বছরের ৫ জুন রায় দেন হাইকোর্ট। এতে ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল হয়েছে বলে জানান আইনজীবীরা।
এ অবস্থায় গত বছরের জুলাইয়ের প্রথম দিন কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে ফের আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। তারা সার্বিকভাবে অগ্রাধিকার কোটাকে ১০ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে এনে বাকি পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের দাবি জানান। এর মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করলেও সে আপিল শুনানি পিছিয়ে গেলে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন অব্যাহত রাখেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে সময় নেয়নি। ক্রমেই সে আন্দোলন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে দিনের পর দিন রাজপথে অবস্থান ধরে রাখেন শিক্ষার্থীরা।
আওয়ামী লীগ সরকার আরও অনেক আন্দোলনের মতোই শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে ‘সরকার পতনের ষড়যন্ত্র’ বলে আখ্যা দেয়। একপর্যায়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে পড়ে ছাত্রলীগ (বর্তমানে নিষিদ্ধঘোষিত) এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
১৬ জুলাই ঢাকাসহ সারা দেশে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। সেদিন প্রাণ হারান ছয়জন। এর মধ্যে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিরস্ত্র আবু সাঈদ বুক পেতে দাঁড়িয়েছিলেন, পুলিশের বুলেট ঝাঁঝরা করে দেয় তার বুক। এ দৃশ্যের ভিডিও বারুদ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশের শিক্ষার্থীদের বুকে।
শিক্ষার্থীরা দাবি আদায়ে রাজপথে অনড় থাকলে সরকারি বাহিনী এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষ-সংঘাতও বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে প্রাণহানি। একপর্যায়ে সরকার সারা দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়, জারি করে কারফিউ। তাতে দমানো যায়নি আন্দোলন, কমানো যায়নি প্রাণহানি।
এর মধ্যে সরকারি উদ্যোগে তড়িঘড়ি করে আপিল বিভাগে শুনানি করিয়ে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের আদেশ নিয়ে আসা হয়। কিন্তু ততক্ষণে আর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কেবল কোটাব্যবস্থা সংস্কারে সীমাবদ্ধ নেই। সহপাঠীদের প্রাণহানির বিচারের দাবিতে তখন উত্তাল শিক্ষার্থীরা। সাবেক সরকারপ্রধানের ক্ষমা প্রার্থনাসহ নানা দাবি তোলেন তারা। সরকারও সেসব দাবি মেনে নেওয়ার পথে হাঁটেনি।
জুলাইয়ের শেষ দিকে প্রথমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ককে ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যায় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। পরে একে একে তুলে নেওয়া হয় আরও তিনজনকে। ‘সমন্বয়করা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন’ বলে ডিবি তাদের নিরাপত্তা দিতে হেফাজতে নিয়ে রেখেছিল বলে জানায়। সপ্তাহখানেক পর ছয় সমন্বয়ককে দিয়ে একটি ভিডিও বিবৃতি দেওয়ানো হয় এই বলে— সরকার শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়েছে বলে আন্দোলন স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে।
সবার মধ্যেই সন্দেহ তৈরি হয়, চাপের মুখে হয়তো ছয় সমন্বয়ককে ওই বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয়েছে। অন্য সমন্বয়করা পালটা বিবৃতি দেন, ডিবি হেফাজতে থেকে দেওয়া বিবৃতি তারা মেনে নেননি, আন্দোলন চলবে। ফলে ডিবির ওই ‘নাটক’ও কাজে লাগেনি। বরং রাজপথে আন্দোলন আরও শক্তিশালী হতে থাকে। প্রাণহানিও বাড়তে থাকে।
জুলাই মাস শেষ হতে হতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আর শিক্ষার্থীদের মধ্যেও সীমাবদ্ধ থাকেনি। কিশোর-তরুণদের তাজা প্রাণ যখন রাজপথে ঝরছিল, তখন তাদের অভিভাবকরা আর বসে থাকতে পারেননি। একে একে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ রাজপথে সক্রিয় হতে থাকেন।
আন্দোলনের শুরুর দিকেই তখনকার সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা এই আন্দোলনকে ‘সরকার পতনে’র আন্দোলন হিসেবে একাধিকবার অভিহিত করেছিলেন। আগস্ট শুরু হতে হতে সত্যি সত্যিই সে আন্দোলনের গতিমুখ তার পদত্যাগের এক দফা দাবির দিকেই ধাবিত হতে থাকে। ছাত্র-জনতা সে দাবি আদায় করেও ছাড়ে।
আগস্টের প্রথম দিন ডিবি হেফাজত থেকে মুক্তি পান ছয় সমন্বয়ক। সে দিন প্রার্থনা, পদযাত্রা, বিক্ষোভ-সমাবেশসহ নানা আয়োজনে পালন করা হয় ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস’ কর্মসূচি। আলাদা করে সমাবেশ করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি জানান শিল্পীরা। পরদিন ২ আগস্ট ঘোষণা করা হয় ছাত্র-জনতার গণমিছিল কর্মসূচি।
আগস্টের দ্বিতীয় দিনেই ডিবি হেফাজত থেকে ছাড়া পাওয়া ছয় সমন্বয়ক এক বিবৃতিতে জানান, তাদের চাপ প্রয়োগ করে কর্মসূচি প্রত্যাহারের ভিডিও রেকর্ড করা হয়েছিল। এতে ছাত্র-জনতা আরও ক্ষোভে ফেটে পড়ে। পরদিন ৩ আগস্ট সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল ও ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল শেষে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে সমাবেশ এবং ৪ আগস্ট থেকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন সমন্বয়করা।
এ দিনই শহিদ মিনারে শিক্ষক, অভিভাবক, সংস্কৃতি কর্মী, সুশীল সমাজের সদস্য এবং বামপন্থি কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত হয় ‘দ্রোহযাত্রা’। পল্টন থেকে শুরু করে দ্রোহযাত্রা শেষ হয় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে। সেই কর্মসূচি থেকে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ সরকারপ্রধানের পদত্যাগের দাবি তোলেন।
৩ আগস্ট আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের গণভবনে আলোচনার জন্য আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সাফ জানিয়ে দেন, ‘গুলি আর সন্ত্রাসের সঙ্গে কোনো সংলাপ হবে না।’
বিকেলে বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে লাখো মানুষের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সমাবেশ থেকে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ঘোষণা করেন এক দফা দাবি— সরকার পতন। এ দাবিতে ৪ আগস্ট থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য অসহযোগ আন্দোলনও ঘোষণা করা হয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও ছাত্র-জনতার দাবি মেনে সরকারকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানান। এ দিন আলোচনায় আসে ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি।
আগের কয়েকদিনের মতো ৪ আগস্টও দেশব্যাপী ব্যাপক সহিংসতা হয়, প্রাণ হারান শতাধিক মানুষ। এর মধ্যে শাহবাগে বিপুল জনসমাগমের মধ্যে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। প্রথমে ৬ আগস্ট এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হলেও পরে সেটি এগিয়ে ৫ আগস্ট করা হয়। পরে ছাত্রনেতারা জানিয়েছেন, ‘মার্চ টু ঢাকা’ ঠেকাতে সরকার কঠোর অবস্থান নিচ্ছে ও সে অনুযায়ী প্রস্তুত হচ্ছে বলে তারা তথ্য পেয়েছিলেন। সে কারণেই সে কর্মসূচি একদিন এগিয়ে আনা হয়।
অবশেষে আসে ৫ আগস্ট। আগের দিন থেকেই ঢাকামুখী মানুষের আনাগোনা শুরু হয়েছিল। এ দিন সকাল থেকেই যেন ঢল নামতে থাকে ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে। একদিকে যাত্রাবাড়ী, আরেকদিকে উত্তরার আব্দুল্লাহপুর— এই দুটি পয়েন্ট বেলা গড়িয়ে সকাল ১০টা পার হতেই হয়ে ওঠে জনসমুদ্র। দুই পাশ থেকেই লাখ লাখ মানুষ ঢুকতে থাকে রাজধানীতে।
গণভবন থেকে তখনো বলা হচ্ছিল, যেকোনো উপায়ে ঢাকায় মানুষের প্রবেশ ঠেকাতে হবে। কিন্তু এই বিপুল জনস্রোত প্রতিরোধ করার সাধ্য ছিল না কোনো বাহিনীর। পুলিশ বাহিনী হাল ছেড়ে দেয়। সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত জানায়, বহির্শত্রুর হাত থেকে দেশের নাগরিকদের রক্ষার যে শপথ তারা নিয়েছে, রাজপথে তাদের বিরুদ্ধে তাদের পক্ষে অস্ত্র ধরা সম্ভব না। ছাত্র-জনতার বিজয় তখন আসন্ন। সে বিজয় বুঝে নিতে তারা রওয়ানা দেন গণভবনের পথে।
দুপুর ১টার দিকে খবর আসে, জনসাধারণের উদ্দেশে টেলিভিশনে ভাষণ দেবেন সেনাপ্রধান। ছাত্র-জনতা তখনই নিশ্চিত হয়ে যায়, বিজয় এসে গেছে, বাকি শুধু আনুষ্ঠানিকতা। দুপুর দেড়টা নাগাদ খবর আসে, শেখ হাসিনা তার ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে হেলিকপ্টারে করে ঢাকা ছেড়েছেন, গন্তব্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভারত।
দুপুর ২টার পর সেনাপ্রধান টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে নিশ্চিত করেন শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার খবর। জানান, ছাত্র-জনতা প্রতিনিধিসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে।
ততক্ষণে ছাত্র-জনতার দখলে গণভবন, সংসদ ভবন থেকে শুরু করে গোটা ঢাকা। সহস্রাধিক প্রাণহানির শোকের পথ বেয়ে ১৬ বছরের কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাচারকে হঠিয়ে বিজয় অর্জনের এক অনন্য দৃশ্যপট রাজপথে। একাত্তরের জনযুদ্ধ মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৫৪ বছর পর নব্বইয়ে গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পতনের সাক্ষী হয়েছিল মানুষ। ৩৫ বছর পর আরেক স্বৈরশাসনের অবসানের সাক্ষী হলো জাতি।
এর আগে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন জোট সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া ৮৫ জন কর্মকর্তাকে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেয়ার অভিযোগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর চাকরিচ্যুত করা হয়।
১১ ঘণ্টা আগেআবহাওয়া অফিস জানায়, উত্তর অন্ধ্রপ্রদেশ ও দক্ষিণ ওড়িষ্যার উপকূলের অদূরে পশ্চিমমধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন উত্তরপশ্চিম বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত লঘুচাপটি সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়ে পশ্চিমমধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন উত্তরপশ্চিম বঙ্গোপসাগর এবং উত্তর অন্ধ্রপ্রদেশ-দক্ষিণ ওড়িষ্যার উপকূল এলাকায় অবস্থান করছে
১২ ঘণ্টা আগেএতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মধ্যে বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৬৭ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৭০ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৬৬ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৩১ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৭৪ জন, খুলনা বিভাগে (সিটি করপোর
১২ ঘণ্টা আগে