top ad image
top ad image
home iconarrow iconখবরাখবর

গণঅভ্যুত্থান নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদন

মেরে লাশ গুম করে ফেলো— নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা

মেরে লাশ গুম করে ফেলো— নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান দমন করতে শেখ হাসিনা নিজে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে উঠে এসেছে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে আন্দোলনের সংগঠক ও সমন্বয়কদের হত্যা করে তাদের লাশ গুম করে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সমন্বয়কদের গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাও তিনিই অনুমোদন করেছিলেন।

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে গণহত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মানবতাবিরোধী অপরাধ নিয়ে জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য। প্রতিবেদন বলছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আন্দোলন দমন করতে সহিংসতা ও অতিরিক্ত বল প্রয়োগের আশ্রয় নেয়। আর এই কার্যক্রমের পুরোটাই প্রত্যক্ষভাবে সমন্বয়ের নেতৃত্ব দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে।

বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর)। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাই-আগস্টে ১৪ শতাধিক মানুষ নিহত হয়ে থাকতে পারেন। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। নিহতদের মধ্যে ১২ থেকে ১৩ শতাংশই শিশু।

প্রতিবেদনে জুলাই-আগস্ট গণআন্দোলন চলাকালে বিভিন্ন দিনের ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরা হয়েছে। এসব দিনে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রমের কথা বলা হয়েছে। আন্দোলন নিয়ে শেখ হাসিনা কী করেছেন ওই সময়গুলোতে, সেগুলোও উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি ‘কোর কমিটি’র বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি প্রধান ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সামনে বিজিবি কমান্ডারকে আরও দ্রুত প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল যেসব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তারা নিজেদের বক্তব্যে বলেছেন যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই আন্দোলন দমন করতে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন। ১৯ জুলাই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা ঝামেলা করছে, আন্দোলনের সেই মূল হোতাদের গ্রেপ্তার করো। ওদের মেরে ফেলো এবং লাশ গুম করে ফেলো।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্য এক বৈঠকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক আন্দোলনাকারীদের থেকে মুক্ত রাখতে সহিংসতার আশ্রয় নেওয়ার কথা নিজেই বলেছিলেন শেখ হাসিনা। শুধু তাই নয়, শেখ হাসিনার সম্মতিতেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের নির্বিচারে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) হেফাজতে রাখার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয় বলে জাতিসংঘের তদন্ত দলকে জানিয়েছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

আন্দোলন চলাকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ডিবি। বেশ কয়েকদিন তাদের আটকে রাখা হয় ডিবি হেফাজতে। এরপর একদিন ডিবি কার্যালয়ে ছয় সমন্বয়ক এক ভিডিও বার্তায় জানান, তারা আন্দোলন স্থগিত করছেন। তখনই এ নিয়ে তুমুল সমালোচনা হয়। সবার ধারণা ছিল, ডিবি হেফাজতে জোর করে তাদের দিয়ে এ ঘোষণা দেওয়ানো হয়েছে। পরে সমন্বয়করা ডিবি হেফাজত থেকে বেরিয়ে এসেও সে কথা বলেন।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এ ঘটনার জন্য ডিবির দায়িত্ব থেকে হারুন অর রশিদকে সরিয়ে দিতে বলেছিলেন শেখ হাসিনা। ২৯ জুলাই মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে তিনি এ নির্দেশ দেন। ৪ আগস্ট সকালে শেখ হাসিনা জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক করেন, সন্ধ্যায় নিজ বাসভবনে আরও এক বৈঠক করেন তিনি। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে ছাত্রদের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি দমন করতে ব্যাপক বল প্রয়োগের সিদ্ধান্ত হয়।

জাতিসংঘের প্রতিবেদন বলছে, ওই পরিকল্পনা অনুযায়ী পুলিশ এবং অন্তত একটি ঘটনাতে সামরিক বাহিনীও বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালায়, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশ ও র‍্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ১১ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি মানুষকে ওই সময় গ্রেপ্তার ও আটক করা হয়। নিহতদের মধ্যে প্রায় ১২ থেকে ১৩ শতাংশ ছিল শিশু। পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী শিশুদের টার্গেট করে হত্যা করেছে, ইচ্ছাকৃতভাবে পঙ্গু করেছে, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, অমানবিকভাবে আটক-নির্যাতন এবং অন্যান্য ধরনের নিপীড়ন করেছে।

বিশেষ করে, শুরুর দিকে বিক্ষোভের সম্মুখসারিতে থাকা নারীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকরা মারাত্মকভাবে আক্রমণ করেছে। নারীরা যৌন ও লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ছিল লিঙ্গভিত্তিক শারীরিক সহিংসতা ও ধর্ষণের হুমকি। কিছু নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য এবং ছবি ও ভিডিও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে, ওএইচসিএইচআর নিশ্চিত হয় যে, বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র আওয়ামী লীগ সমর্থকদের একটি দল পুলিশের সঙ্গে যৌথভাবে বা ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কাজ করেছিল। তারা বিক্ষোভ দমনের জন্য সরকারের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে ব্যাপকভাবে বেআইনি সহিংসতায় লিপ্ত হয়েছিল।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ পুলিশ ওএইচসিএইচআরকে পুলিশ সদস্য, আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের ৯৫ জন সদস্যের নাম ও তাদের ভূমিকা কী ছিল তার বিস্তারিত সরবরাহ করেছে। পুলিশের মতে, এই ব্যক্তিরাই বিক্ষোভের সময় সহিংস হামলায় ব্যবহারের জন্য নাগরিকদের অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। অস্ত্র সরবরাহ যাদের করা হয়েছিল তাদের মধ্যে ১০ জন তৎকালীন সংসদ সদস্য, ১৪ জন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, ১৬ জন যুবলীগ নেতা, ১৬ জন ছাত্রলীগ নেতা ও সাতজন পুলিশ সদস্য।

জাতিসংঘের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে—

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বলেন, এই নৃশংস প্রতিক্রিয়া ছিল সাবেক সরকারের একটি পরিকল্পিত ও সমন্বিত কৌশল, যা জনতার বিরোধিতার মুখে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে চেয়েছিল। বিক্ষোভ দমন করার কৌশলের অংশ হিসেবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে এবং তাদের সমন্বয় ও নির্দেশনায় শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ব্যাপক পরিসরে নির্বিচারে গ্রেফতার ও আটক এবং নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে।

ভলকার তুর্ক আরও বলেন, আমরা যে সাক্ষ্য ও প্রমাণ সংগ্রহ করেছি তা ব্যাপক রাষ্ট্রীয় সহিংসতা এবং লক্ষ্যভিত্তিক হত্যাকাণ্ডের (টার্গেটেড কিলিং) এক উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর এবং যা আন্তর্জাতিক অপরাধের আওতায় পড়তে পারে। এ পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ও ভবিষ্যতের জন্য দায়বদ্ধতা ও ন্যায়বিচার অপরিহার্য।

r1 ad
r1 ad
top ad image