top ad image
top ad image
home iconarrow iconখবরাখবর

সীমান্ত আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে, কী প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে?

সীমান্ত আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে, কী প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে?
মংডুর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর আরাকান আর্মির সদস্যরা। ছবি: আরাকান আর্মির ওয়েবসাইট

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান যুদ্ধে দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি মংডু শহরের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের প্রায় পৌনে তিন শ কিলোমিটার সীমানার পুরোটাই এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে।

আরাকান আর্মির মুখপাত্র ইউ খাইং থু খা বিবিসি বার্মিজ সার্ভিসকে বলেছেন, এরই মধ্যে তারা পশ্চিম অঞ্চলের জান্তা বাহিনীর কমান্ড সদর দপ্তর দখলসহ রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিতে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন।

এ অংশের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরই বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী নাফ নদীর মিয়ানমারের অংশে অনির্দিষ্টকালের জন্য নৌ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে আরকান আর্মি। ওই ঘোষণার পর নাফ নদীতে নৌ চলাচলে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে বিজিবির টহল।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, ‘যেহেতু সীমান্তের ওপার বিদ্রোহী আরাকান আর্মির দখলে নিয়েছে, সে কারণে আমরা সীমান্তে সতর্কতা বজায় রেখেছি, যেন কোনো অবৈধ অনুপ্রবেশ না ঘটে।’

আট মাসেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমারের চলমান এই যুদ্ধে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা সহযোগী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি (এআরএ) ও আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিসহ (আরসা) কয়েকটি সংগঠনের অবস্থান ছিল জান্তা বাহিনীর পক্ষে। এ কারণে সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির হাতে চলে যাওয়ায় নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ও বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘এর ফলে বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আরও বেশি জটিল ও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’

এখনো চলছে তুমুল লড়াই

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার মংডু, বুথিডং ও পালেতাওয়া দখলের নেওয়ার দাবি করেছে আরাকান আর্মি। তাদের বরাত দিয়ে বিবিসি বার্মিজ সার্ভিস জানিয়েছে, চলমান যুদ্ধে মিয়ানমানের পশ্চিম অঞ্চলের ব্যাটেলিয়ান সদর দপ্তরসহ সব সীমান্ত চৌকি দখল নিয়েছে নিয়ে নিয়েছে আরাকান আর্মি।

এক বিবৃতিতে আরাকান আর্মি জানিয়েছে, জান্তার শেষ অবশিষ্ট সীমান্ত ঘাঁটি মংডু শহরের বাইরে অবস্থিত বর্ডার গার্ড পুলিশের পাঁচ নম্বর ব্যাটালিয়নও গত কয়েক মাসের টানা লড়াইয়ের পর গত রোববার তারা দখলে নিয়েছে।

এর আগে গত ৭ ডিসেম্বর আরাকান আর্মি এক বিবৃতিতে বলা হয়, রাখাইনের আন অঞ্চলের ৩০টিরও বেশি জান্তা বাহিনীর ক্যাম্প তারা দখল করে নিয়েছে। এ সময় সামরিক জান্তার বিমান ও সামরিক হামলা প্রতিহত করে পালটা হামলাও চালাচ্ছে তারা।

২৮ নভেম্বর এক বিবৃতিতে আরাকান আর্মি জানিয়েছিল, মাগোয়ে অঞ্চলের সামরিক বাহিনীর একটি বহরে হামলা চালাতে গিয়ে আরাকান আর্মির এক শ সৈন্য নিহত হয়েছে।

আরাকান আর্মির সহযোগী স্টুডেন্ট আর্ম ফোর্স এসএএফ বিবিসি বার্মিজকে জানিয়েছে, যেখান থেকে সামরিক বাহিনীর সৈন্য ও রসদ সরবরাহ হয়, সেখানেও এখন যুদ্ধ চলছে। তবে রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির এই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে এখন পর্যন্ত কিছু জানায়নি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী।

বিবিসি বার্মিজের খবরে বলা হয়েছে, এরই মধ্যে জান্তা বাহিনীর একজন পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থুরিন তুনকে আটক করা হয়েছে। থুরিন ছিলেন রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ১৫ নম্বর অপারেশন কম্যান্ডের অধিনায়ক।

Arakan-Army-Patrolling-Photo

নাফ নদীতে অনির্দিষ্টকালের নিষেধাজ্ঞা

চলতি বছরের শুরু থেকেই বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে টানা যুদ্ধ চলছে। সে সময়ই রাখাইন রাজ্যের বেশকিছু এলাকার নিয়ন্ত্রণে নেয় বিদ্রোহী আরাকান আর্মি। বান্দরবনের ঘুমধুম সীমান্ত এলাকার মিয়ানমার অংশের বেশ কিছু এলাকা ওই সময়ে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল আরাকান আর্মি।

সে সময় তীব্র যুদ্ধের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) কয়েক শ সদস্য। পরে তাদের মিয়ানমারে ফেরতও পাঠানো হয়।

টানা যুদ্ধে মংডুসহ এ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর নাফ নদীর মিয়ানমারের অংশে অনির্দিষ্টকালের জন্য নৌ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আরাকান আর্মি। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়, আরাকান আর্মি সফলভাবে রাখাইন রাজ্যের মংডু অঞ্চলের সামরিক জান্তার বর্ডার গার্ড পুলিশ ডিভিশনের (৫ নম্বর) শেষ অবশিষ্ট ফাঁড়িটি দখল করে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।

আরাকান আর্মির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, তারা ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর সামরিক জান্তার সশস্ত্র সদস্য, তাদের সহযোগী আরএসও, আরসা, এআরএ সদস্যরা ওই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। তবে তারা অতর্কিত হামলা অব্যাহত রেখেছে। এখনো মংডু অঞ্চলের অন্যান্য অংশেও এমন হামলা হচ্ছে। তাই সামরিক প্রয়োজনীয়তা ও জননিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগের কারণে নাফ নদীতে (রাখাইন প্রান্তে) সব ধরনের নৌ পরিবহণ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সীমান্তে টহল জোরদার

এমন পরিস্থিতিতে নাফ নদীর বাংলাদেশ অংশেও টহল জোরদার করা হয়েছে। কক্সবাজারের স্থানীয় সাংবাদিক আজিম নিহাদ বলেন, সীমান্তে আরাকান আর্মির পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণের খবর আসার পর গত দুই দিনে বেশ সতর্কতা দেখা গেছে টেকনাফ, কক্সবাজারসহ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায়। গত দুই দিন টেকনাফ এলাকায় মাইকিং হয়েছে।

নাফ নদীতে নৌ চলাচলে সতর্কতা জারি করে মাইকিং করা হয় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। এমন অবস্থায় সর্তক অবস্থানে রাখা হয়েছে কোস্ট গার্ড ও বিজিবিকেও।

টেকনাফের ইউএনও এহসান উদ্দিন বলেন, ‘সীমান্তে অযাচিত যাতায়াত বন্ধে সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছি আমরা। সে জন্য সচেতন করতে মাইকিংও করা হচ্ছে। নাফ নদীতে মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে যেন কোনোভাবেই কোনো নৌকা না যায়, সে জন্যও আমরা সতর্কতা জারি রেখেছি। কেউ যেন সীমানা পেরিয়ে এ দিকে না আসে, সে দিকেও আমরা নজর রাখছি।’

এ ক্ষেত্রে ছোট ছোট নৌকাগুলোকে নাফ নদীতে বাংলাদেশ অংশে সর্তকতার সঙ্গে চলাচলের অনুমতি দেওয়া হলেও নাফ নদীতে বড় ট্রলার, বড় জাহাজ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে বলেও জানান ইউএনও।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সীমান্তের নাফ নদীতে টহল তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে। নাফ নদীর ঝুঁকিপূর্ণ স্থান এবং বাংলাদেশের জলসীমায় বিদ্যমান দ্বীপের আধিপত্য বিস্তারের জন্য নৌ টহলও জোরদার করা হয়েছে বলে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশে কী প্রভাব পড়তে পারে?

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ২৭০ কিলোমিটার সীমান্তের পুরোটাই আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে বলে দুই দেশের গণমাধ্যমের খবরেই বলা হচ্ছে। কয়েক মাস ধরে মিয়ানমারের জান্তার সঙ্গে লড়াইয়ের পর রোববার সকালে মংডু শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দাবি করেছে সংগঠনটি।

আরাকান আর্মি বিবৃতিতে দাবি করেছে, তুমুল লড়াইয়ের মুখে জান্তা বাহিনীর মিত্র হিসেবে পরিচিত আরাকান রোহিঙ্গা আর্মির রোহিঙ্গা মিলিশিয়া, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশনের (আরএসও) বিরুদ্ধেও তারা হামলা চালিয়েছে। অব্যাহত হামলার মুখে তারাও ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়েছে।

এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে হামলার মুখে কয়েকটি রোহিঙ্গা সংগঠনের নেতারা অস্ত্রসহ বাংলাদেশে আশ্রয়ের পর তাদের আটক করেছিল পুলিশ। কক্সবাজারের স্থানীয় প্রশাসন বলছে, এমন অবস্থায় নতুন করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের শঙ্কা রয়েছে।

টেকনাফের ইউএনও শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে বাংলাদেশ বর্ডার যেন কেউ অতিক্রম না করে। কোনো অবস্থাতেই যেন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ না ঘটে, সেদিক বিবেচনায় টহল জোরদার করেছি।’

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, এ অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও রোহিঙ্গা নিয়ে সংকট কয়েকটি কারণে দীর্ঘায়িত হতে পারে।

মেজর এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথমত, আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে রোহিঙ্গারা জান্তা বাহিনীর পক্ষ নেওয়ায় এখন এই সংকট আরও বাড়ল। দ্বিতীয়ত, যেসব সশস্ত্র রোহিঙ্গা সংগঠন আরাকান আর্মির সঙ্গে পরাজিত হয়ে পালিয়েছে, তাদেরও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের শঙ্কা রয়েছে।

এর ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশের উদ্যোগও সংকটের মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন মেজর এমদাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘রাখাইন এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। যে কারণে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের ভরসা করতে হবে নেপিডোর ওপর। কূটনৈতিক সম্পর্কের বাইরে এই সংকট সমাধান সম্ভব না। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় এই সংকট আরও দীর্ঘায়িত হলো।’

এই বিশ্লেষক মনে করছেন, বর্তমানে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে। এমন অবস্থায় প্রতিবেশী মিয়ানমারেও সীমান্তে যে অস্থিরতা তৈরি হলো, তাতে সে দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যেও প্রভাব পড়তে পারে।

r1 ad
r1 ad
top ad image