রাখাইনে সংঘর্ষ, অর্ধলাখের বেশি রোহিঙ্গা ঢুকেছে উখিয়া-টেকনাফে\n
চলতি মার্চ মাস পর্যন্ত কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে অবস্থানরত প্রত্যেক রোহিঙ্গা নাগরিকের জন্য মাসে ১২ দশমিক ৫০ মার্কিন ডলার এবং ভাসানচরে অববস্থানরত রোহিঙ্গাদের জন্য মাসে ১৫ মার্কিন ডলার করে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। শারীরিক ন্যূনতম চাহিদা ও পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার কেনার জন্য এ অর্থ সহায়তা যথেষ্ট নয়।
চিঠিতে বলা হয়েছে, তবে তহবিল সংকটের কারণে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেওয়ার ঝুঁকির সম্মুখীন। তাৎক্ষণিকভাবে তহবিল সংগ্রহ করা সম্ভব না হওয়ায় এই সহায়তা উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে দিতে হচ্ছে।
এ অবস্থায় আগামী ১ এপ্রিল থেকে ডব্লিউএফপি কক্সবাজার ও ভাসানচরে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তার পরিমাণ মাসে ৬ মার্কিন ডলারে নামিয়ে আনতে বাধ্য হচ্ছে।
খাদ্য সহায়তার পরিমাণ এর চেয়ে কমে গেলে তা তাদের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম খাদ্যের জোগান মেটাতে সক্ষম হবে না, মৌলিক পুষ্টি চাহিদাও পূরণ করতে ব্যর্থ হবে— চিঠিতে বলছে ডব্লিউএফপি।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির একজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি রাজনীতি ডটকমকে বলেন, পরবর্তী সময়ে এ বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।
রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দিতে ডব্লিউএফপির চিঠি। ছবি: সংগৃহীত
রোহিঙ্গাদের জন্য আরও তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা চালিয়েও সাড়া পায়নি বলে জানিয়েছে ডাব্লিউএফপি। চিঠিতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন দাতা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিত করতে বিভিন্নভাবে খাদ্য সহায়তার পরিমাণ ঠিক রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা পর্যাপ্ত তহবিল সংগ্রহ করতে পারিনি। ফলে খাদ্য সহায়তা কমানো ঠেকানোর জন্য অন্য ব্যয়সাশ্রয়ী পদক্ষেপগুলো যথেষ্ট নয়।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোর প্রধান কর্মকর্তা (শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘বিষয়টি আমাকে গতকাল (মঙ্গলবার) মৌখিকভাবে জানানো হয়েছিল। আজ (বুধবার) এ সংক্রান্ত চিঠি পেয়েছি। এতে নিশ্চিত করা হয়েছে যে আগামী ১ এপ্রিল থেকে রোহিঙ্গাদের খাবার বাবদ মাসিক বরাদ্দ সাড়ে ৬ ডলার করে কমানো হবে।’
ডাব্লিউএফপির চিঠি অনুযায়ী, একজন রোহিঙ্গার জন্য মাসে ৬ মার্কিন ডলার খাদ্য সহায়তা বরাদ্দ হলে বাংলাদেশি টাকায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৭২০ টাকা (প্রতি ডলার ১২০ টাকা দর হিসাবে)। সে হিসাবে প্রতিদিন একজনের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ ২৪ টাকা। এই টাকায় একজন ব্যক্তির একদিনের জন্য পর্যাপ্ত খাবার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের মিজানুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা বাবদ ডাব্লিউএফপির বরাদ্দ যা ছিল, সেটিই পর্যাপ্ত ছিল না। নতুন করে বরাদ্দ কমে অর্ধেকে নেমে আসলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।
মিয়ানমারের সরকারি ও সামরিক বাহিনীর হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের জুলাইয়ে বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। টানা কয়েক মাসের সহিংসতার শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ছিল ১০ লাখেরও বেশি। মানবিক বিবেচনায় বাংলাদেশের কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী এলাকায় আশ্রয় শিবির বানিয়ে আশ্রয় দেওয়া হয় এসব রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোহিঙ্গা ঢলের প্রায় আট বছর পর আশ্রয় শিবিরে তাদের সংখ্যা এখন ১৩ লাখেরও বেশি।
এদিকে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নানা সময়ে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কোনো উদ্যোগে মৌখিকভাবে সাড়া দেওয়া হলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমি তাদের জন্য নিরাপদ নয়, এমন কারণ দেখিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া থামিয়ে রাখা হয়েছে।
এর মধ্যে নোয়াখালীর ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ সরকার। সেখানে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে রাখার উপযোগী আবাসন তৈরি করা হয়েছে সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে। তবে এখন পর্যন্ত ধারণক্ষমতার অর্ধেকের মতো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সেখানে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
ওদিকে মিয়ানমারে সরকারি ও সামরিক বাহিনীগুলোর সঙ্গে স্থানীয় বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর যুদ্ধ চলছেই। রাখাইনের এ পরিস্থিতির কারণে গত মাস ছয়েক ধরে ফের সীমান্ত পেরিয়ে রোহিঙ্গারা আসতে শুরু করেছে বাংলাদেশে।
স্থানীয় প্রশাসনের তথ্য বলছে, গত বছরও প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে।
রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা কমে গেলে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা মানবাধিকার কর্মীদের। ছবি: ব্র্যাক
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকলেও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সহায়তা কমে যাওয়াকে বড় ধরনের উদ্বেগ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর নেপথ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনের বৈশ্বিক সহায়তা কর্মসূচি কমিয়ে দেওয়ার প্রভাব নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মিজানুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য যারা অর্থ সহায়তা দিয়ে আসছিল তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার পরিমাণই সর্বোচ্চ। ফলে তাদের সহায়তা কমে যাওয়াও রোহিঙ্গাদের খাদ্যের জন্য মাসিক বরাদ্দ কমে যাওয়ার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করলে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস তাৎক্ষণিকভাবে রয়টার্সের কাছে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান রয়টার্সকে বলেছেন, ট্রাম্প প্রশাসন দায়িত্ব নেওয়ার পর ইউএসএইডের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশকে দেওয়া সহায়তার পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ার প্রভাব আরও আগে থেকেই পড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে হাসপাতাল ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো পরিষেবাগুলোতে চাপ তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে অর্থায়নে পরিচালিত হাসপাতালে পরিষেবা সীমিত করতে হয়েছে।