top ad image
top ad image
home iconarrow iconমতামত

শ্রদ্ধায় স্মরি তোমারে, সার্জেন্ট জহুরুল

শ্রদ্ধায় স্মরি তোমারে, সার্জেন্ট জহুরুল
সার্জেন্ট জহুরুল হক। ছবি: সংগৃহীত

আজ ১৫ ফেব্রুয়ারি, শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল দিবস। ১৯৬৯ সালের এই দিনে ঢাকা সেনানিবাসে বন্দি অবস্থায় সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে হত্যা করা হয়।

পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণা করেন। এর প্রতি জনসমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে তিনি ব্যাপক প্রচার কার্যক্রম চালান। ছয় দফার প্রতি বিপুল জনসমর্থন ও শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে সামরিক জান্তা স্বৈরশাসক আইয়ুব খান তাকে আটবার গ্রেপ্তার করে। অবশেষে ১৯৬৬ সালের ৮ মে তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়।

পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে আইয়ুব খান ১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি ‘শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের বিচার’ শিরোনামে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করে। ১৭ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে পুনরায় জেলগেট থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেনানিবাসে আটক রাখা হয়।

সার্জেন্ট জহুরুল হক ছিলেন রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে দায়ের করা ওই মামলার অন্যতম আসামি। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন মামলার এক নম্বর এবং সার্জেন্ট জহুরুল হক ছিলেন ১৭ নম্বর আসামি।

মামলার বাকি ৩৩ জন আসামিরা হলেন— কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, সাবেক এলএস সুলতান উদ্দিন আহমেদ, সিডিআই নূর মোহাম্মদ, আহমেদ ফজলুর রহমান সিএসপি, ফ্লাইট সার্জেন্ট মাহফিজউল্লাহ, সাবেক করপোরাল আবুল বাশার, মোহাম্মদ আবদুস সামাদ, সাবেক হাবিলদার দলিল উদ্দিন, রুহুল কুদ্দুস সিএসপি, ফ্লাইট সার্জেন্ট মো. ফজলুল হক, ভূপতিভুষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী, বিধানকৃষ্ণ সেন, সুবেদার আবদুর রাজ্জাক, সাবেক হাবিলদার ক্লার্ক মুজিবুর রহমান, সাবেক ফ্লাইট সার্জেন্ট মো. আবদুর রাজ্জাক, মো. খুরশীদ, খান মোহাম্মদ শামসুর রহমান সিএসপি, হাবিলদার আজিজুল হক, মাহফুজুল বারী, সার্জেন্ট শামসুল হক, শামসুল আলম এএমসি, ক্যাপ্টেন মো. আবদুল মোতালেব, ক্যাপ্টেন এ শওকত আলী মিয়া, ক্যাপ্টেন খন্দকার নাজমুল হুদা এএমসি, ক্যাপ্টেন এ এন এম নুরুজ্জামান, সার্জেন্ট আবদুল জলিল, মো. মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী, লে. এস এম এম রহমান, সাবেক সুবেদার এ কে এম তাজুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলী রেজা, ক্যাপ্টেন খুরশিদ উদ্দিন আহমেদ এএমসি এবং লে. আবদুর রউফ।

মামলার বিচারের জন্য ফৌজদারি দণ্ডবিধি সংশোধন করে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন ৩৫ জনকে আসামি করে পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২১-ক ধারা ও ১৩১ ধারায় ঢাকা সেনানিবাসে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে বিচারকাজ শুরু করা হয়।

মোট ১০০টি অনুচ্ছেদ সম্বলিত মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়। সরকার পক্ষে মামলায় ১১ জন রাজসাক্ষীসহ মোট ২২৭ জন সাক্ষীর তালিকা আদালতে পেশ করা হয়। এর মধ্যে চারজন রাজসাক্ষীকে সরকারপক্ষ থেকে বৈরী ঘোষণা করা হয়।

১৯৬৮ সালের ৫ আগস্ট ব্রিটিশ আইনজীবী ও ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য টমাস উইলিয়ম শেখ মুজিবের পক্ষে ট্রাইব্যুনাল গঠন সংক্রান্ত বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনায় তার সহযোগী ছিলেন আবদুস সালাম খান, আতাউর রহমান খানসহ অন্যরা। সরকারপক্ষে প্রধান কৌঁসুলী ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মঞ্জুর কাদের ও অ্যাডভোকেট জেনারেল টি এইচ খান।

তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি এস এ রহমান। তিনি ছিলেন অবাঙালি। বাকি দুজন এম আর খান ও মুকসুমুল হাকিম ছিলেন বাঙালি। সরকারি নির্দেশে মামলাটিকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। মামলার এ নামকরণ করে শেখ মুজিবকে দেশের জনগণের কাছে ভারতীয় চর ও বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারলে জনসমর্থন সরকারের পক্ষে যাবে এবং শেখ মুজিবকে কঠোর সাজা দেওয়া সম্ভব হবে বলে সরকার ধারণা করেছিল।

কিন্তু সরকারি সাক্ষীরা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সরকারের বিপক্ষেই বিষোদ্গার করতে থাকেন। সাক্ষীরা বলেন, সরকার তাদের নির্যাতন করে এ মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করেছে। এ মামলা সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না। ফলে দেশবাসীর কাছে সরকারের এ ষড়যন্ত্র সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি বাস্তবায়ন ও আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের অবসানের ঘটানোর লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকমসু) আট ছাত্রনেতা সম্মিলিতভাবে গঠন করেন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন এনএসএফে ভাঙন ধরে এবং এর একাংশ (মাহবুবুল হক দোলন, ইব্রাহিম খলিল, নাজিম কামরান) সংগ্রাম পরিষদে যোগ দেয়।

১৪ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও সরকারি চক্রান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। ফলে মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবসহ সব বন্দির মুক্তির দাবিতে সারা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ১৯৬৯ সালের আজকের এই দিনে ঢাকা সেনানিবাসে সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।

এ দিন সার্জেন্ট জহুরুল হক ছিলেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট সেলে বন্দি। তাকে পাহারা দেওয়ার দায়িত্বে ছিল অবাঙালি পাকিস্তানি সেনারা। বন্দিদের সঙ্গে প্রায়ই তারা খারাপ আচরণ করত। একই সঙ্গে মানসিক নির্যাতনও চালাত। আসামিদের দেওয়া হতো নিম্নমানের খাবার। ভাতের মধ্যে প্রায়ই কাঁকর মেশানো থাকত। এ কারণে বন্দিরা খুবই কম পরিমাণ খেতেন। বেঁচে যাওয়া খাবার কাঁটাতারের বেড়ার পাশে জড়ো হওয়া শিশুদের মধ্যে বিতরণ করে দিতেন। এই অতি নিম্নমানের খাবারের লোভেই ক্ষুধার্ত শিশুরা জড়ো হতো সেখানে। শিশুদের ভিড় দেখলেই পাকিস্তানি সেনারা গালিগালাজ করে তাদের তাড়িয়ে দিত।

প্রতিদিনের মতো ১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় সেলে আসামিরা খাবার খাচ্ছিলেন। খাবার শেষ হওয়ার একটু আগে উচ্ছিষ্ট সংগ্রহের জন্য অভুক্ত শিশুরা কাঁটাতারের বাইরে ভিড় জমায়। হঠাৎ সেলের পাহারায় নিয়োজিত হাবিলদার মঞ্জুর শাহ অভুক্ত শিশুদের গালাগাল করতে শুরু করে।

এ সময় বন্দিরা প্রতিবাদ করে বলেন, ‘আমরা তো আমাদের খাবার থেকে বাঁচিয়ে ওদের খাবার দিচ্ছি।’ প্রতিবাদ করায় হাবিলদার মঞ্জুর শাহ বন্দিদের সঙ্গে কথা না বলে নিজ নিজ কামরায় ফিরে যেতে আদেশ দেন। একইসঙ্গে মঞ্জুর শাহ কয়েকজন শিশুকে ধরে এনে লাথি মারতে শুরু করেন।

পুরো ঘটনাটি প্রথম থেকেই দেখছিলেন সার্জেন্ট জহুরুল হক। মঞ্জুর শাহের এমন দুর্ব্যবহারে প্রচণ্ড রেগে যান তিনি। সার্জেন্ট জহুরুল কথা বলতে গেলে তার দিকে রাইফেল তাক করে মঞ্জুর শাহ এগিয়ে যান। মঞ্জুর শাহর হাত থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে জহুরুল হক বলেন, ‘তোমাদের হাতে অস্ত্র আছে তাই এত ক্ষমতা দেখাচ্ছ। চাইলে আমরা খালি হাতে এই ক্যান্টনমেন্ট দখল করতে পারি।’ এরপর তিনি রাইফেলটি মঞ্জুর শাহের দিকে ছুড়ে দেন। নিরস্ত্র বাঙালি আসামি এভাবে প্রতিবাদ করে রাইফেল ছুড়ে মারবেন, মঞ্জুর শাহ কল্পনাও করতে পারেননি। এতে তীব্র অপমানিত বোধ করেন তিনি।

১৫ ফেব্রুয়ারি ভোরে অন্য বন্দিদের সঙ্গে জহুরুল হক তার সেল থেকে বের হলে মঞ্জুর শাহ রাইফেল তাক করে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলেন, ‘কাল তোর সাহস দেখেছি। কিন্তু আজ আমি তোদের মেরে ফেলব।’ সার্জেন্ট জহুরুল হক বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে মঞ্জুর শাহর দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু কোনো দেরি না করে গুলি চালান মঞ্জুর শাহ। সার্জেন্ট জহুরুল হক পেটে গুলিবিদ্ধ হন এবং লুটিয়ে পড়েন।

আরেকটি গুলিতে লুটিয়ে পড়েন তার সঙ্গের বন্দি ফজলুল হক। গুলিবিদ্ধ হয়েও ফজলুল হককে ডেকে জহুরুল হক বলেন, ‘ফজলু, শক্ত হও। গত রাতের সেই বর্বর সেনারা আমাদের মেরে ফেলতে চাচ্ছে। আমাদের উঠতে হবে, বাঁচতে হবে।’ মঞ্জুর শাহ ক্ষিপ্ত হয়ে জহুরুল হকের পেটের ওপর উঠে বেয়নেট নিয়ে খোঁচাতে শুরু করেন। একই সঙ্গে চলে শক্ত বুটের আঘাত। বুটের আঘাতে সার্জেন্ট জহুরুল হকের কলার বোন ভেঙে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে রাত ৯টা ৫৫ মিনিটে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যু সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুদ্ধ জনতা রাস্তায় নেমে আসে। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ও সরকারি নানা অফিসে তারা হামলা চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে। অতিথি ভবনে (বর্তমানে বাংলা একাডেমি) ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এস এ রহমান ও প্রধান সরকারি কৌঁসুলি মঞ্জুর কাদের অবস্থান করতেন। জনতা ভবনটিতে আগুন দিলে দুজনই প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যান।

চেয়ারম্যান এস এ রহমান শুধু গেঞ্জি গায়ে পালিয়ে বিমানবন্দর থেকে সোজা পাকিস্তান চলে যান। অতিথি ভবনে আগুন দেওয়ায় মামলার কিছু নথিপত্রও পুড়ে যায়। এ সময় লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকে। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার ও প্রক্টর ড. মুহম্মদ শামসুজ্জোহাকে সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করে। আন্দোলন আরও তীব্রতা লাভ করে এবং সরকার দিশেহারা হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ১৯ ফেব্রুয়ারি সরকার সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করে। ২২ ফেব্রুয়ারি কথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মাললা সরকার রদ করে এবং শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দিকে মুক্তি দেয়।

সার্জেন্ট জহুরুল হক ১৯৩৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালি সদর উপজেলার সোনাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ মেধাবী ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক। আজকের এই দিনে তার প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন জাতি এই বীর শহিদকে স্মরণ করবে।

লেখক: সাবেক মহাপরিচালক, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর

r1 ad
r1 ad
top ad image