‘জুলাই সনদ প্রশ্নবিদ্ধ’

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক

গত ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় 'জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর'-এর আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়। মহাসমারোহে এর প্রচার চালানো হলেও, সনদ তৈরির প্রক্রিয়া ও পরিসর নিয়ে জনমনে প্রশ্ন থাকায় স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে জনপরিসরে উল্লেখযোগ্য আগ্রহ ছিল না। অভ্যুত্থানোত্তর অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন সংস্কার ও ঐকমত্য কমিশন গঠন, সংস্কার নিয়ে আলোচনা এবং সর্বোপরি জুলাই সনদ প্রস্তুতের যে পদ্ধতিতে অগ্রসর হয়েছে, তা গণঅভ্যুত্থানের অনেক অংশীজনকেই হতাশ করেছে। এমনই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।

সরকার জনবিমুখ হয়ে পড়েছে উল্লেখ করে এতে বলা হয়েছে যে, বহু অংশীজনের মতামত ও শিক্ষা-স্বাস্থ্যখাতসহ জনগণের বহু প্রকৃত আকাঙ্ক্ষা সংস্কারের সুপারিশমালা ও চূড়ান্ত জুলাই সনদে প্রতিফলিত হয়নি। বিশেষত নারী, লিঙ্গসংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের বিষয়ে এই সনদে কোনো আশার আলো নেই। নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে প্রসন্ন করার উদ্দেশ্যে এবং বহুপক্ষকে প্রক্রিয়া থেকে দূরে রেখে—অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় অংশীদার শিক্ষার্থীদের অভিপ্রায় উপেক্ষা করে—যে ‘ঐক্য’-এর প্রচার করা হয়েছে, তার ফাঁক আমরা সনদ স্বাক্ষরের দিনই দেখেছি। জুলাই যোদ্ধাদের একটি অংশ বিক্ষুব্ধ হয় এবং তাদের ওপর পুলিশ ন্যাক্কারজনক হামলা চালায়।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক মনে করেন, শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রণীত এই সনদের স্বাক্ষর দিবসে সব রাজনৈতিক দল উপস্থিত না থাকলেও সরকার ও ঐকমত্য কমিশন সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত ছিল বলে মনে হয়েছে। এমতাবস্থায় জুলাই সনদ ঐক্যের ডাক দিতে ব্যর্থ হওয়ার পাশাপাশি প্রশ্নবিদ্ধও হয়েছে—যা অদূর ভবিষ্যতে নতুন রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করবে।

তারা বলেন, এই অনৈক্যের প্রতিফলন দেখা গেছে খোদ ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রায় ৩০ মিনিটের বক্তৃতায়। জুলাই সনদের গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে তিনি অনেক অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেছেন। তাঁর এই বক্তৃতায় আলঙ্কারিক বাহুল্য ও শ্রেষ্ঠত্ববাদী অহমিকার পুনরাবৃত্তি ছাড়া তেমন কোনো বিষয়বস্তু ছিল না। মোটাদাগে তাঁর অন্তঃসারশূন্য বক্তব্য জাতিকে আশার আলো দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। উল্টো তিনি এমন এক আপত্তিজনক ও বিতর্কিত বিষয় তুলে ধরেছেন, যা রাজনৈতিকভাবে তো বটেই, সমাজতাত্ত্বিক ও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল। বক্তৃতায় তিনি দুইবার ‘বর্বরতা’ ও ‘সভ্যতা’-র মেরুকরণ ঘটিয়েছেন—যা নিন্দনীয় ও বিদ্বেষমূলক বলে আমরা মনে করি।

প্রথমবার তিনি বলেছেন,“এই সনদের মাধ্যমে আমরা একটা বড় কাজ করলাম। আমরা বর্বরতা থেকে সভ্যতায় এলাম। আমরা এক বর্বর জগতে ছিলাম, যেখানে আইনকানুন ছিল না—মানুষের যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারত। এখন আমরা সভ্যতায় এসেছি এবং এমন সভ্যতা আমরা গড়ে তুলব, মানুষ ঈর্ষার চোখে আমাদের দেখবে।”

বক্তৃতার শেষে তিনি আরও বলেন,“ঐক্যমতের মাধ্যমে যে কঠিন কাজগুলো সম্পন্ন করা যায়, আমরা যে বর্বরতা থেকে সভ্যতায় এসেছি—তার প্রমাণ রাখতে হবে, কার্যে প্রমাণ করতে হবে। কাগজে তো আমরা প্রমাণ করলাম যে সেই সভ্যতা আমরা নিয়ে এসেছি, এখন কাজে প্রমাণ করতে হবে যে আমরা সেই সভ্যতা অর্জন করেছি।”

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক মনে করে, এই বক্তব্য সম্পূর্ণভাবে ঔপনিবেশিক বিদ্যায়তনিক বয়ান ও পশ্চিমা শ্রেষ্ঠত্ববাদী সূত্র মেনে উপস্থাপিত হয়েছে। ব্রিটিশ ও পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো উপনিবেশিত জাতিগুলোকে ‘অসভ্য’ ও ‘বর্বর’ সাব্যস্ত করে তথাকথিত Modernity (আধুনিকতা), Enlightenment (আলোকায়ন), Civilization (সভ্যতা) ও White Supremacy (শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ) চাপিয়ে দিয়েছিল। এই করুণ অভিধা আমাদেরও জুটেছিল, যার ফল ছিল ১৯০ বছরের ব্রিটিশ উপনিবেশিক শোষণ।

এর ২৪ বছর পর, পাকিস্তানের নব্য-ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীকে পরাজিত করে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি। এই স্বাধীনতা শুধু সার্বভৌমত্বই নিশ্চিত করেনি, বরং সমস্ত শ্রেষ্ঠত্ববাদী অহংবোধকেও সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে। সত্য যে, গত ৫৫ বছরে রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণে আমরা এখনো জনগণের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র ও আইনি কাঠামো গড়ে তুলতে পারিনি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে আমরা এতদিন ‘বর্বর’ ছিলাম, কিংবা প্রশ্নবিদ্ধ ও অনৈক্যপূর্ণ এই জুলাই সনদ আমাদের ‘সভ্য করা’র কোনো মহাপ্রকল্প হয়ে উঠেছে বা উঠবে।

বস্তুত তথাকথিত ‘সভ্যতা’-র ধারণা প্রচারের মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক প্রকল্পের পক্ষেই সাফাই গাওয়া হয়। কাউকে ‘বর্বর’, ‘অসভ্য’, ‘পাশবিক’, ‘দাস’, ‘চাকর’, ‘ব্ল্যাক’, ‘রেড’ ইত্যাদি বলে চিহ্নিত করা শ্রেষ্ঠত্ববাদী ঔপনিবেশিক মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ। জ্ঞানজগতে উত্তর-ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিক ও চিন্তকেরা নানাভাবে উপনিবেশিত জাতিগোষ্ঠীর মুক্তির সংগ্রাম বিশ্লেষণ করেছেন এবং ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদের অপরায়ন প্রকল্পের কঠোর সমালোচনা করেছেন। এই ঐতিহাসিক ও বিদ্যায়তনিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় প্রধান উপদেষ্টা ক্ষমতার মসনদে বসে অবিবেচনাপ্রসূত ঔপনিবেশিক অপরায়নের ছাঁচেই কথা বলেছেন।

মনে রাখা দরকার, তিনি একটি সরকারের প্রধান নির্বাহী হলেও এটি তাঁর অস্থায়ী পরিচয়। সারা বিশ্বেই তিনি একজন স্বনামধন্য একাডেমিশিয়ান ও সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে সমাদৃত। এমন এক বর্ণিল একাডেমিক পরিচয় থাকা সত্ত্বেও তিনি কীভাবে উপনিবেশজাত শব্দসম্ভারে বক্তৃতা দিতে পারলেন, তা আমাদের কাছে বিস্ময়কর লেগেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক এমন শব্দচয়নের বিরোধিতা করে তাঁর এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে। পাশাপাশি প্রশ্নবিদ্ধ জুলাই জাতীয় সনদ প্রসঙ্গে খুব শিগগিরই একটি আনুষ্ঠানিক পর্যালোচনা প্রকাশের অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

কেন আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে পারছি না

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী) ও বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (বাংলাদেশ জাসদ) স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা এ সনদে সই করবে না৷

৩ দিন আগে

বদলাচ্ছে চাকরির বাজার— প্রয়োজন বাস্তব দক্ষতা

যুক্তরাষ্ট্রের আইটি খাত আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে— দক্ষতা থাকলে ডিগ্রি নয়, কাজই কথা বলে। তাই এখনই সময় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, চাকরি সংস্কৃতি ও সামাজিক মানসিকতাকে পুনর্গঠন করার। কারণ, এ শতাব্দীর অর্থনীতি আর ডিগ্রির ওপর দাঁড়িয়ে নেই, এটি দাঁড়িয়ে আছে শেখার সক্ষমতার ওপর।

৬ দিন আগে

হিংসা এমন আগুন যা নিজেকেই দগ্ধ করে

হীনমন্যতায় আক্রান্তরা মনে করছে, অন্যের যোগ্যতা ও দক্ষতা তাদের পথে বাধা হবে। ফলে হিংসা-বিদ্বেষের অসুস্থ চর্চায় নিজেদের কর্ম ও সামাজিক অনুষ্ঠানে বিরূপ আচরণ ছড়াচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রিয় বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও বন্ধুত্বের অবমাননা হচ্ছে এবং সুন্দর সম্পর্ক ধরে রাখার চেষ্টা হচ্ছে না।

৮ দিন আগে

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম— অনির্বাণ আলো হয়ে জেগে থাকবে সমাজে-সাহিত্যে

অন্ধকার সময়েও সে ছিল আমাদের আলোকবর্তিকা, যে দেখিয়েছে— সাহিত্য কেবল নান্দনিকতার নয়, নৈতিক সাহসেরও একটি ক্ষেত্র। অন্যায় ও অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে সে ছিল দৃঢ়, কিন্তু তার ভাষা ছিল সবসময় কোমল, গভীর ও আলোকিত।

৯ দিন আগে