top ad image
top ad image
home iconarrow iconমতামত

সিন্ধু নদীর পানি নিয়ে কেন এত দুশ্চিন্তায় পাকিস্তান?

সিন্ধু নদীর পানি নিয়ে কেন এত দুশ্চিন্তায় পাকিস্তান?
সিন্ধু নদীর পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করেছে ভারত। ছবি: সংগৃহীত

কাশ্মিরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা ঘিরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনার পারদ চড়ছেই। এর মধ্যে সিন্ধু নদীর পানি চুক্তি স্থগিত করেছে ভারত। পালটা ব্যবস্থা হিসেবে পাকিস্তান স্থগিত করেছে ১৯৭২ সালের শিমলা চুক্তি। এ পরিস্থিতিতে দুপক্ষের উত্তেজনা এখন চরমে। বলা যায়, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এখন রীতিমতো যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

গত মঙ্গলবার ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ পর্যটক নিহত হওয়ার পর ভারত সিন্ধু পানি চুক্তি (আইডব্লিউটি) স্থগিত করেছে। পাকিস্তান একে যুদ্ধ ঘোষণার মতোই দেখছে। কিন্তু সিন্ধু নদীর পানিবণ্টন চুক্তিকে কেন এত বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে পাকিস্তান? দেশটির জন্য কি এটি জীবন-মরণ প্রশ্ন?

পাকিস্তানের প্রধান কৃষিভিত্তিক অঞ্চল পাঞ্জাব। এখানকার মাঠ-ঘাট, খেত-খামার বাঁচিয়ে রাখে সিন্ধু ও এর শাখা নদীগুলোর পানি। পুরো দেশের খাদ্য উৎপাদনের বড় অংশ আসে এই এলাকা থেকে। পাঞ্জাবের সেচব্যবস্থার প্রায় ৮০ শতাংশ নির্ভর করে সিন্ধু চুক্তির অধীনে পাওয়া পানির ওপর। ভারত যদি পানি বন্ধ করে দেয়, তাহলে শুকিয়ে যাবে এই এলাকা। পাকিস্তানের খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি ব্যবস্থা আর অর্থনীতি— সব ধসে পড়বে।

সিন্ধু চুক্তি হয়েছিল ১৯৬০ সালে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের মধ্যে সই হয় এই চুক্তি। ৯ বছর ধরে আলোচনার পর তারা এই চুক্তির ধারাগুলো নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছেন।

চুক্তি অনুযায়ী, পূর্ব দিকের তিনটি নদী— বিপাশা, ইরাবতী ও শতদ্রুর ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে ভারতের। অন্যদিকে পশ্চিম দিকের তিন নদী— সিন্ধু, চন্দ্রভাগা ও বিতস্তার পানি ব্যবহার করতে পারবে পাকিস্তান। পানির নিরিখে সিন্ধু এবং তার শাখা ও উপনদী মিলিয়ে ৩০ শতাংশ ভারত ও ৭০ শতাংশ পাবে পাকিস্তান।

পাশাপাশি ভারত পশ্চিম দিকের নদীগুলোর পানি স্থানীয় সেচ, বিদ্যুৎ, মাছ চাষ, নৌ চলাচলের জন্য ব্যবহার করতে পারবে বলেও চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়।

Indus-Wster-Treaty-Signed-56-04-2025

১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও তৎকালীন পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খানের মধ্যে সিন্ধু নদীর পানি বণ্টন নিয়ে চুক্তি সই হয়। ছবি: সংগৃহীত

চুক্তি যতই থাকুক, গত কয়েক বছরে ভারতের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছিল। দেশটি মনে করে, পাকিস্তান একদিকে শান্তির কথা বলে, আরেকদিকে সন্ত্রাসবাদে মদত দেয়। ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পরও নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ‘রক্ত আর পানি একসঙ্গে বইতে পারে না।’ সেই থেকেই সিন্ধু নদীর পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে ভারতের মধ্যে আলোচনা চলে আসছিল।

২০২৩ সালে ভারত প্রথম চুক্তি পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব নিয়ে পাকিস্তানকে নোটিশ পাঠায়। সাড়া না পেয়ে আবার নোটিশ যায় ২০২৪ সালে। গত বছর ৩০ আগস্ট ভারতের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠানো হয় পাকিস্তানকে। তাতে বলা হয়, এই চুক্তির মৌলিক কিছু পরিবর্তন দরকার। ভারতের ভাষায়, সন্ত্রাসবাদের প্রভাব পানি চুক্তির ওপর পড়ছে।

অবশেষে গত ২২ এপ্রিল পেহেলগাম হামলায় পাকিস্তানের জড়িত থাকার অভিযোগ এনে ভারত সিন্ধু চুক্তি স্থগিত করে। ভারত বলছে, ওই হামলায় মদত ও সহযোগিতা দিয়েছে পাকিস্তানিরা। তবে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া পর্যটক হত্যাকাণ্ড ছিল ভারতের পরিকল্পিত ঘটনা।

পাকিস্তান তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, পেহেলগাম হামলার পর সিন্ধু নদীর পানি বন্ধ করা তাদের কাছে যুদ্ধ ঘোষণার মতো। এর জের ধরেই পাকিস্তান শিমলা চুক্তি স্থগিত করে। এই শিমলা চুক্তিতেই কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণরেখা তৈরি হয়েছিল।

শিমলা চুক্তি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। ১৯৭১ সালে যুদ্ধে পরাজয়ের পরই পাকিস্তান এই চুক্তিতে সই করে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যতে সব দ্বিপাক্ষিক সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং যুদ্ধের পথ এড়িয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া।

শিমলা চুক্তির সবচেয়ে বড় দিক ছিল নিয়ন্ত্রণরেখা প্রতিষ্ঠা। কাশ্মীর সীমান্তে এই সীমা মান্য করে দুই দেশ সেনা মোতায়েন করে আসছে। বিশ্ব এরই মধ্যেই এই চুক্তিকে দুই দেশের মধ্যে শান্তি ও সীমান্ত ব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে মেনে নিয়েছে।

পাকিস্তান শুধু এখন নয়, আগেও পানি নিয়ে যুদ্ধ করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, ১৯৪৭-৪৮ সালে প্রথম ভারত-পাক যুদ্ধের পেছনেও ছিল নদীর পানি। তাই আবারও এই ইস্যু বড় ধরনের সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দিতে পারে দুই দেশকে।

সিন্ধু নদীর উৎস তিব্বতের মানস সরোবরের পাশে। সেখান থেকে কাশ্মীর হয়ে পাকিস্তানে ঢুকে করাচির কাছে গিয়ে আরব সাগরে মিশেছে। এই নদীর তীরেই বহু আগে গড়ে উঠেছিল মহেঞ্জোদারো, হরোপ্পার মতো সভ্যতা। শুধু আধুনিক কৃষি নয়, ঐতিহাসিকভাবেও এই নদী দুই দেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।

এত বছর ধরে পাকিস্তান তিনবার ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। অথচ ভারত কখনোই সিন্ধু চুক্তি বাতিল করেনি। বরং প্রতি বছর পাকিস্তানকে নিয়ম মেনে পানি দিয়ে এসেছে। কিন্তু পরিস্থিতি এখন বদলে গেছে। ভারত এখন শক্ত অবস্থানে। পাকিস্তানের জন্য এটা শুধু কূটনৈতিক ইস্যু নয়, এটা তাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন।

কারণ খুব সহজ— যদি পানি বন্ধ হয়, তাহলে পাঞ্জাবের খেত-খামার শুকিয়ে যাবে। খাদ্য উৎপাদন বন্ধ হবে। অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। দেশের ভেতরেই অসন্তোষ ছড়াবে। সেটা রাজনৈতিক অস্থিরতায় গড়াতে পারে। সেখান থেকে গৃহযুদ্ধ বা শরণার্থী সংকট তৈরি হতে পারে।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পানিবণ্টন-সংক্রান্ত বিরোধের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বিশ্বব্যাংক। পাকিস্তানের সঙ্গে সই হওয়া এই চুক্তি একতরফা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বিশ্বব্যাংককে কিছু জানায়নি ভারত। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বিশ্বব্যাংক।

যদিও বৃহস্পতিবার ভারতের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব দেবশ্রী মুখার্জি পাকিস্তানের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব সৈয়দ আলী মুর্তজাকে চিঠি দিয়ে জানান, ভারত ওই চুক্তি স্থগিত করছে এবং অবিলম্বে তা কার্যকর হবে।

ভারত অনেক দিন ধরেই বলছে, এই চুক্তিতে বৈষম্য রয়েছে। বিশ্বব্যাংক এতে মধ্যস্থতা করলেও ভারত চায় সালিশি আদালত ভেঙে দেওয়া হোক। যদিও এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বড় কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।

সিন্ধু পানি চুক্তি বাতিলের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে ভারত ও পাকিস্তানের গণমাধ্যমে। পাকিস্তানের সাবেক আইনমন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আহমের বিলাল সুফি দ্য ডনে শুক্রবার প্রকাশিত প্রবন্ধে লেখেন, “চুক্তিতে ‘স্থগিতকরণ’ নিয়ে কোনো ধারা নেই। ভারত একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা ভিয়েনা কনভেনশনের ৪২ ও ৫৭ নম্বর অনুচ্ছেদের স্পষ্ট লঙ্ঘন। এমনকি ৬০ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, শুধু অন্য পক্ষ চুক্তি ভাঙলে তবেই স্থগিত করা যাবে। ভারতের সিদ্ধান্ত এমন কোনো লঙ্ঘনের অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে নয়।’

অন্যদিকে ভারতের হয়ে ছয় বছরের বেশি সময় সিন্ধু পানি কমিশনার থাকা প্রদীপ কুমার সাক্সেনা বুধবার পিটিআইকে বলেন, ‘সরকার চাইলে এটি হতে পারে চুক্তি বাতিলের দিকে প্রথম পদক্ষেপ। যদিও পানি চুক্তিতে বাতিলের নির্দিষ্ট ধারা নেই, তবে ভিয়েনা কনভেনশনের ৬২ নম্বর অনুচ্ছেদ বলছে— চুক্তি সইয়ের সময়কার পরিস্থিতিতে যদি মৌলিক পরিবর্তন ঘটে, তাহলে তা বাতিলের আইনি ভিত্তি তৈরি হতে পারে।

সিন্ধু পানি চুক্তি পাকিস্তানের জন্য শুধু পানি নয়, এটি বাঁচার অধিকার। আর ভারত চাইছে সেই জায়গাতেই চাপ তৈরি করতে। এখন দেখার বিষয়, এর পর কোন দিকে এগোয় দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক।

দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা একেবার উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশ্লেষকেরা। বিশেষ করে যখন দুই দেশই পরমাণু শক্তিধর, তখন সিন্ধুর মতো জনগুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্থগিত হওয়া থেকে অনেক বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা তাদের।

r1 ad
top ad image