বাংলাদেশ-পাকিস্তান পররাষ্ট্রনীতি: নতুন পথে যাত্রা?

ডয়চে ভেলে
আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ১০: ২৮

ঢাকায় বাংলাদেশ-পাকিস্তান পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেখছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। একাত্তরে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাইতে আবারও পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের কাছে পাওনা ৪২০ কোটি ডলারও চাওয়া হয়েছে।

বৃহস্পতিবার ঢাকায় বাংলাদেশ-পাকিস্তান পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিষয়গুলো তোলা হয়। ১৫ বছর পর বৃহস্পতিবার ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন।

বিকালে এক ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘একাত্তরে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে বলেছে বাংলাদেশ। এছাড়া স্বাধীনতা-পূর্ব সম্পদ হিসেবে ৪২০ কোটি ডলার ফেরত চেয়েছে ঢাকা।’ ইসলামাবাদ এ বিষয়ে আলোচনায় রাজি হয়েছে বলেও জানান পররাষ্ট্র সচিব।

ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ বাড়িয়ে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে এগিয়ে নেয়ার আলোচনাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে উভয়পক্ষ। বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধির বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়েছে, আলোচনা হয়েছে যোগাযোগ, পরিবহণ, শিক্ষা ও কৃষিসহ অন্যান্য ইস্যু নিয়েও৷

বৈঠক শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় গণমাধ্যমকর্মীদের আলোচনা ফলপ্রসূ হওয়ার বার্তা দেন আমনা বালুচ। কেমন আলোচনা হয়েছে- গণমাধ্যমকর্মীদের এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি সংক্ষেপে জবাব দিয়েছেন, ‘নাইস।’

বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের ভবিষ্যৎ

বৃহস্পতিবার আমনা বালুচ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনা অনুসন্ধানে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে। এসব কাটিয়ে ওঠার উপায় আমাদের খুঁজে বের করতে হবে এবং সম্পর্ক সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’

এ সময় অতীতের বিষয়গুলো স্বীকার করে আমনা বালুচ বলেন, ‘বাংলাদেশ ও পাকিস্তাানকে অবশ্যই দুই দেশের মধ্যে সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর উপায় খুঁজে বের করতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের নিজেদের আয়ত্তে বিশাল আন্তঃবাজার সম্ভাবনা আছে এবং আমাদের এটি ব্যবহার করা উচিত। আমরা প্রতিবার ‘বাস মিস’ করতে পারি না।’

দুই দেশের বেসরকারি খাতের মধ্যে নিয়মিত পারস্পরিক যোগাযোগ এবং সব পর্যায়ে দুই দেশের মধ্যে সফর আয়োজন করা প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেন তিনি। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আশা করেন, এপ্রিলের শেষ দিকে দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দারের আসন্ন সফর দুই দেশের সম্পর্ক আরো জোরদার করবে।

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের ফাঁকে এবং ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে কায়রোয় ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফের সঙ্গে তার বৈঠকের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অগ্রগতির ক্ষেত্রে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সার্ক, ওআইসি ও ডি-৮-এর মতো বহুপাক্ষিক ও আঞ্চলিক ফোরামে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাবে।’

চলতি মাসের শেষ দিকে পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার-এর ঢাকা সফর করার কথা। তার এই সফরটি হতে যাচ্ছে ২০১২ সালের পর কোনো পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম ঢাকা সফর।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কে পরিবর্তন আসে। পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানি শুরু হয়। পাকিস্তানের পণ্যবাহী জাহাজ আসে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন,‘একটি দেশের সঙ্গে আমাদের সমস্যা আছে, তাই বলে সম্পর্ক থাকবে না?’

তিনি আরো বলেন, ‘দুই পরারাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে বলেই আমরা আমাদের পাওনা এবং গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানাতে পেরেছি।’ তার কথা, ‘ভারত এখন আমাদের সাথে যে আচরণ করছে, সেখানে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো হলে আমাদের জন্য নতুন স্পেস তৈরি হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা দিকে সুযোগ তৈরি হতে পারে,’ বলে অভিমত তার।

এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জাহেদ উর রহমান বলেন, ‘আমাদের যে একটা স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি আছে, সেটা স্পষ্ট করতে হবে। আমরা চীনের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করছি। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করছি।’

‘৫ আগস্টের পর যখন পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের জাহাজ যোগাযোগ শুরু হয়, তখন ভারতে প্রচুর শোরগোল হয়েছে। এটা আমরা চাই না। আমরা কোনো উত্তেজনাকর সম্পর্ক চাই না। আমরা ভারতের সঙ্গেও সম্পর্ক চাই। কিন্তু অন্য কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বাদ দেয়ার শর্তে নয়। বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে আর্টিলারি শেল কিনেছে। আমরা যদি চীনের থেকে পাকিস্তানে সস্তায় পাই, তাহলে সমস্যা কোথায়,’ বলেন তিনি।

সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) মো. শহীদুল হক বলেন, ‘একসময় জাতীয় স্বার্থের ওপর ভিত্তি করে আমাদের একটা স্বাধীন পরাষ্ট্রনীতি ছিল। কিন্তু গত ১৫ বছরে সেটা ভারতকেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছিল।’

তার কথা, ‘আসলে সবার সাথেই আমাদের সম্পর্ক রাখতে হবে। চীনের সাথে, পাকিস্তানের সাথে- ভারতের সঙ্গেও আমরা ভালো সম্পর্ক চাই। তবে সব হবে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তিতে।’

এদিকে, শেখ হাসিনার আমলেও পাকিস্তানের সঙ্গে একরকমের যোগাযোগ দেখা গেছে। ২০২৩ সালে শেখ হাসিনা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফকে শুভেচ্ছা উপহার হিসাবে আম পাঠিয়েছিলেন। ২০১৯ এবং ২০২০ সালে পাকিস্তানের তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান শেখ হাসিনাকে ফোন করেন। তখন তাদের মধ্যে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে কথা হয়। তবে সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) মো. শহীদুল হক একে জোরালো কূটনৈতিক সম্পর্ক হিসেবে দেখছেন না।

তিনি বলেন, ‘আম পাঠানোর বিষয়টি হলো, তখন বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ এশিয়ার আরো কয়েকটি দেশে আম পাঠানো হয়। পাকিস্তানে আম পাঠানো ছিল তারই অংশ। লোক দেখানো। আর ইমরান খান ব্যক্তি হিসেবে বাংলাদেশের অনেক প্রশংসা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ঘটনায় ক্ষমা চাওয়ার বিষয়েও কথা বলেছিলেন।’

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

বাংলাদেশে ভেজাল খাদ্য: মানবতার নীরব বিশ্বাসঘাতকতা

ক্ষুধা ধীরে হত্যা করে, ভেজাল নীরবে হত্যা করে। খাদ্যে ভেজাল কেবল বাংলাদেশের সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক সংকট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, প্রতি বছর ৬০ কোটি মানুষ খাদ্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে চার লাখ ২০ হাজার মানুষ মারাও যায়।

৭ দিন আগে

ইতিহাসের সাক্ষী আহমদ রফিক

এ জাতির মুক্তির মন্দিরের সোপানতলে কে হবেন কান্ডারী? আমরা কি সেই ইতিহাসের ভারবাহী নতুন প্রজন্ম তৈরি করতে পেরেছি? না পারার দায় কার? লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক

৮ দিন আগে

তিন শূন্যের পৃথিবী গড়া জাতিপুঞ্জের সকলের স্বপ্ন হোক

গত আট দশক ধরে জাতিসংঘ ধারাবাহিকভাবে তার কর্মপরিধি সম্প্রসারিত করেছে এবং নানা ক্ষেত্রে আরো গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়েছে । বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা, মানবাধিকার, বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন, ন্যায়বিচার, ন্যায্যতা ও সমতা প্রসারে জাতিসংঘ অনস্বীকার্য ভূমিকা রেখেছে। জাতিসংঘের কারণেই আজ বিশ্বের ১২০ টি দে

১৫ দিন আগে

‘রূপালী ক্যাশ’, ডিজিটাল জালিয়াতি ও গ্রাহকের অসহায়ত্ব

এসব গ্রাহকের কাজ ছিল টাকা ওঠানো থেকে শুরু করে আয়কর রিটার্ন দাখিল করার জন্য ব্যাংক স্টেটমেন্ট প্রভৃতি সংগ্রহ। কিন্তু সেজন্য কেন তারা দীর্ঘক্ষণ ধরে অপেক্ষমান ছিলেন? কারণ ব্যাংকের ‘সার্ভার ডাউন’, তাই কোনো কাজই করা যাচ্ছিল না!

১৫ দিন আগে