সব সংকট-শঙ্কার মধ‍্যেও বিজয়ের আশা ছাড়িনি

রাশেদা কে চৌধূরী
বিজয় দিবস। গ্রাফিক্স: রাজনীতি ডটকম

এবারের বিজয় দিবসটা আমাদের কাছে আসছে নতুন করে। আমরা তো মুক্তিযুদ্ধের সময়কার প্রজন্ম। তখন একটা প্রত্যাশা থেকে দেশের মুক্তির আন্দোলনে অংশ নিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বয়কট করেছি। উনসত্তরের গণআন্দোলনের যে স্পিরিট, সেই স্পিরিট নিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমরা সারা বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী একাকার হয়ে গেছি।

তখন আমাদের চিহ্নিত শত্রু ছিল হানাদার বাহিনী। তাদের সঙ্গে আরও চিহ্নিত হয়েছিল তাদের এ দেশীয় ‘কোলাবোরেটর’ বা সহযোগীরা, যারা ছিল মূলত রাজাকার, আলবদর বা আল শামস বাহিনীর। এরাও চিহ্নিত ছিল। এদের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ একাট্টা হয়ে সংগ্রাম করেছে। সেই সংগ্রাম রক্তক্ষয়ী ছিল, বহু মানুষ অকাতরে শহিদ হয়েছে।

মুক্তির আনন্দের পাশাপাশি জাতি হিসেবে একতাবদ্ধ থাকার সেই স্পিরিট নিয়ে আমরা প্রতিবছর বিজয় দিবস উদ্‌যাপন করি। এবারের বিজয় দিবসটা অন্য পরিসরে, অন্য আঙ্গিকে এসেছে। কারণ আমরা দীর্ঘদিন দেখেছি, দুই দশকের কাছাকাছি, কীভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র ধীরে ধীরে স্বৈরতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সেখান থেকে উত্তরণ ঘটেছে একটি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে।

সাধারণ জনগোষ্ঠীর অসম্ভব রকমের একটা আকাশছোঁয়া প্রত্যাশা ছিল, স্বপ্ন ছিল— স্বৈরতান্ত্রিক অস্বস্তিকর পরিবেশের সমাপ্তি ঘটবে। কেবল গণতন্ত্রে ফেরার স্বপ্নই না, সাধারণ মানুষের রুটি-রুজি, সম্মান-মর্যাদা নিশ্চিত হবে— এই প্রত্যাশা নিয়ে আমরা পার করেছি গত বছর। এ বছরও প্রায় শেষ হতে চলল।

এই প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে এসে এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি— যে রাজনীতি শেষ পর্যন্ত সবকিছুর মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে, সেই রাজনীতি ধীরে ধীরে সহিংস হয়ে উঠছে। এখানে আমাদের চিহ্নিত শত্রু কারা, আমরা বুঝতে পারছি না। কিন্তু যেটি বুঝতে পারছি— সবকিছুর মধ্য দিয়ে নানা ধরনের অপশক্তির উত্থান ঘটছে।

আমরা বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের মধ্যেও পড়ে গেছি। কাজেই এবারের বিজয় দিবসে আমাদের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো এসেছে, সেটা আগামীর ভাবনাটাকেও সামনে নিয়ে আসছে। এই আগামীর ভাবনার মধ্যে প্রত্যাশার জায়গাটা যেমন আছে, একই রকমভাবে রয়েছে হতাশার জায়গাও।

Victory-Day-Write-Up-01-Highlights-16-12-2025

জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে মানুষের প্রত্যাশা ছিল বিপুল। কর্তৃত্বপরায়ণ শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে একে একে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। জনমানুষের প্রত্যাশা ছিল, এসব সংস্কার কমিশনের হাত ধরে সংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে লাগবে পরিবর্তনের ছোঁয়া।

এসব সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ও সুপারিশ নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, সেটি ভিন্ন আলোচনা। কিন্তু আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, যে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কমিশনগুলো গঠন করল, সেই সরকারই আবার বেশির ভাগ কমিশনের প্রতিবেদন গ্রহণই করল না। সোজা কথায় সংস্কার প্রতিবেদন ও সুপারিশ এই সরকার বাস্তবায়ন করেনি। এ জায়গাটিতে আমরা বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছি। যে স্বপ্নটা দেখানো হলো, সেটা বাস্তবায়নের পথটা হারিয়ে গেল।

মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের একজন হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি আমার কাছে মনে হয় সেটি হলো আত্মত্যাগ। ওই সময়ে দেশ স্বাধীন করার জন্য আমরা লাখো মানুষকে প্রাণ বিসর্জন দিতে দেখেছি। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানেও আমরা একই জিনিস দেখলাম, তরুণরা আত্মোৎসর্গ করল নিজেদের। কিন্তু এই সংগ্রামটা ছিল আমাদের দেশেই প্রতিষ্ঠিত স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে, বাইরের কোনো হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে না।

তরুণ প্রাণের এই আত্মত্যাগে নতুন প্রজন্মের প্রতি প্রত্যাশার পারদটা অনেক উঁচু হয়ে গিয়েছিল। আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, এরাই আমাদের পথ দেখাবে। কিন্তু আমরা কী দেখলাম? সবখানে অস্থিরতা। রাজনীতিতে অস্থিরতার কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। এর সঙ্গে বিশেষ করে যোগ হলো শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা, ঠিক যে জায়গাটিই তরুণ শিক্ষার্থীদের। এই অস্থিরতা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করল আমাদের নতুন প্রজন্ম, তরুণ-কিশোরদের।

এর মধ্যে আমরা দেখলাম, আমাদের নারীরা পিছিয়ে পড়ল। নারীকে পোশাক নিয়ে কথা শুনতে হলো, রাস্তাঘাটে রীতিমতো আক্রমণের শিকার হতে হলো। নারীর মর্যাদায় আঘাত করা হলো। কর্মজীবী নারীর কর্মঘণ্টা কমিয়ে দেওয়া নিয়ে কথা হলো। গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে নারী শিক্ষা ও অগ্রগতির পথিকৃৎ যে বেগম রোকেয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাকেই আখ্যা দিলেন ‘কাফের’, ‘মুরতাদ’। রাষ্ট্রীয় আয়োজনে যেখানে ‘আমি-ই রোকেয়া’, তারই সমান্তরালে সেই ‘রোকেয়া’কে তথা ‘আমাকে’ই ‘মুরতাদ-কাফির’ ঘোষণা করা হলো। এত প্রতিক্রিয়াশীলতার মাঝে আমি কী করে নিরাপদ থাকব?

নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের নিরাপত্তা চাওয়া হয়েছে। সরকার ঘোষণা করেছে, তাদের নিরাপত্তা দেবে। নির্বাচনের সময় সংবাদমাধ্যমকেও নিরাপত্তা দেবে। কিন্তু নারীর নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, জানি না।

Victory-Day-Write-Up-02-Highlights-16-12-2025

এই প্রশ্ন কেবল আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে যাওয়া সরকারের না, যতদিন ক্ষমতায় আছে অন্তর্বর্তী সরকারকেও বিবেচনা করতে হবে। আমিই ‘মুরতাদ’, আমিই ‘কাফির’, তাহলে আমি কোথায় যাব? রাস্তাঘাটে, বাজারহাটে, মাঠেময়দানে, কর্মস্থলে-শিক্ষাঙ্গনে কোথাও কি আমি নিরাপদ আছি— এই প্রশ্নটা সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে, সরকারের কাছে এবং সর্বোপরি সবার কাছেই রাখছি।

সব মিলিয়ে জুলাই আন্দোলনে সামনের সারিতে থাকা নারীশক্তি যেন গত দেড় বছরে অনেকটাই ম্রিয়মাণ। তরুণীদের অনেকেই অনলাইন-অফলাইন কোথাওই নিরাপদ বোধ করছেন না। বিশেষ করে সাইবার স্পেসে ‘বট বাহিনী’র আক্রমণ তাদের ভার্চুয়াল জীবনকে অতীষ্ঠ করে তুলছে।

চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের সূচনাবিন্দু যেখানে, সেটি বৈষম্যের বিরোধিতা। সেই আন্দোলনে আমাদের সন্তানরা আত্মাহুতি দিলো। কিন্তু বৈষম্য কমলো কি? শিক্ষাঙ্গনে আমরা দেখলাম ক্রমশ বৈষম্য বাড়ছে। স্বাস্থ্য, সামাজিক উন্নয়ন, সামাজিক সুরক্ষা— সব ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়ছে।

পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, এখন তো মনে হচ্ছে তাদের পিছিয়ে রাখা হয়েছে। মূলধারার শিক্ষা থেকে আমাদের শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ছে, বাল্যবিবাহ বাড়ছে, মাতৃমৃত্যুর হার বাড়ছে, জন্মহার বাড়ছে। সব দিক থেকে এবারের বিজয় দিবসটা আমাদের কাছে এক নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে উঠে আসছে।

এখন আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে। আমরা আশা করছি, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সরকার ক্ষমতায় আসবে। সে সরকারের আমলেও যে সহিংসতা হবে না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় শঙ্কিত হয়ে পড়ছি, বিশেষ করে ওসমান হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার পরে।

কিন্তু একটি বিষয় নীতিনির্ধারকদের, বিশেষ করে এখন যারা ক্ষমতায় আছেন বা অন্তর্বর্তী সরকারের নীতি নির্ধারণ করছেন (তারা রাজনীতিবিদ না) তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে নিরাপত্তা দেওয়া হবে বলা হচ্ছে। গণমাধ্যমকেও নিরাপত্তা দেওয়ার ঘোষণা আমরা শুনছি। কিন্তু নারীর নিরাপত্তা কে দেবে?

Victory-Day-Write-Up-03-Highlights-16-12-2025

গত দেড় বছরে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা যেভাবে বেড়েছে, আরেক ধরনের সহিংসতা বাল্যবিবাহও যেভাবে বেড়েছে, আমরা তো এগুলোর লাগাম টানতে পারছি না। তাহলে এবারের বিজয় দিবসের সূর্যটা আমাদের জন্য কী নিয়ে আসবে, সেই প্রশ্নই থেকে যাচ্ছে। তারপরও একজন নাগরিক হিসেবে নিশ্চয়ই আশা করব, দেশের মানুষ আন্দোলন-সংগ্রামে যেভাবে জীবন দিয়েছে, সেভাবে দেশটাকে নতুনরূপে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যও কাজ করবে।

এই দেশের মানুষকে নিয়ে আমি এ কারণেই আশাবাদী যে এখানে সব খাতে শত শত প্রতিবন্ধকতা থাকলেও অন্য-বস্ত্র-বাসস্থানের সংস্থান করতে মানুষ নিজেরাই সংগ্রাম করছে। এখনো ১৮ কোটি মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছে আমাদের কৃষকরা। এখনো অসংখ্য ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা শুধু নিজেদের জীবন-জীবিকাই নির্বাহ করছেন না, শ্রমজীবী মানুষেরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছেন।

Victory-Day-Write-Up-04-Highlights-16-12-2025

বিজয় দিবসের নতুন সূর্যের সঙ্গে নতুন প্রত্যাশা থাকবে— যে সরকারই আসুক, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যে স্লোগান ছিল, সমতা-ন্যায্যতা-মানবাধিকার— এগুলো সমুন্নত রেখে যেন আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারি। চব্বিশের অভ্যুত্থানের স্লোগান ছিল— ‘বৈষম্য থাকবে না’, আমরা যেন সেদিকে যেতে পারি।

বাস্তবতা যেমনই হোক, যত প্রতিবন্ধকতাই থাকুক, আশা-আকাঙ্ক্ষা ছোট করলে হবে না। কারণ মানুষের বেঁচে থাকার উপকরণ তো এটিই। আমাদের সাধারণ জনগোষ্ঠীর যেভাবে সংগ্রাম করে, এত ঝড়-ঝঞ্ঝা, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, সবকিছুর মধ্য দিয়েই দেশটাকে যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যায়, তাতে এই দেশের পিছিয়ে থাকা উচিত না। এবারের বিজয় দিবসে প্রত্যাশা এটুকুই।

Rasheda-K-Chowdhury-Writers-Photo-16-12-2025

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বিজয়ের মাস

মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বর এবং ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে এ মাসের ১৬ তারিখে চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে গৌরবের অধ্যায় রচিত হয়। ৩০ লাখ শহীদ আর অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল এ বিজয়।

১১ দিন আগে

বাংলাদেশের রাজনীতি ও চাঁদাবাজি: একজন ভোটারের উক্তি

আমি বুঝি— ‘সহায়তা’ মানে চাঁদা, আর ‘সফল জনসভা’ মানে আমার টাকা দিয়ে অন্যের মাইক বাজবে। তাই আমি হাসিমুখে বলি, ‘ঠিক আছে ভাই, কত লাগবে?’ তিনি বলেন, ‘যত মন চায় দেন, তবে কম দিলে মন খারাপ হয়।’

১২ দিন আগে

প্রাথমিক শিক্ষকদের আন্দোলনে অনৈক্য, শিক্ষার্থীরা জিম্মি

১২ দিন আগে

তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে ব্যাখ্যার দায় সরকারের

এখানে সরকারের ব্যাখ্যা দেওয়ার দায়িত্ব আছে। তার মন্তব্যের কারণ কী, সেটি সরকার জানতে চাইতে পারে এবং পরিষ্কার করতে পারে। কারণ এর বাইরে অন্য কোনো বিশেষ জটিলতা আছে বলে আমার মনে হয় না।

১৬ দিন আগে