ডিসেম্বরের দিনলিপি: ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১

‘বাঘ’ এখন বিড়াল: ৭ ডিসেম্বরেই কান্নায় ভেঙে পড়েন জেনারেল নিয়াজি!

নাজমুল ইসলাম হৃদয়

দীর্ঘ ৯ মাস ধরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে ‘অজেয়’ মিথ তৈরি করেছিল, ৭ ডিসেম্বর তা তাসের ঘরের মতো ধসে পড়ে। সামরিক পরিভাষায় দিনটিকে ‘মনস্তাত্ত্বিক মৃত্যু’ বা ‘Psychological Death’-এর দিন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

এ দিনেই পাকিস্তানি ইস্টার্ন কমান্ডের মেরুদণ্ড বা ‘ব্যাকবোন’ পুরোপুরি ভেঙে যায়। একদিকে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো কোনো জেলা সদর বা যশোর শত্রুমুক্ত হওয়ার গৌরব অর্জন করে, অন্যদিকে সিলেটের আকাশে ঘটে এক অভাবনীয় ঘটনা। হেলিকপ্টার থেকে দড়ি বেয়ে হাজার হাজার সৈন্য নামতে থাকে পাকিস্তানি ঘাঁটির ঠিক পেছনের আঙিনায়।

ঢাকায় তখন এক ভিন্ন দৃশ্য। যে জেনারেল নিয়াজি দম্ভভরে বলতেন ‘বাংলার মানুষ আমাকে বাঘের মতো ভয় পায়’, সেই নিয়াজি এ দিনেই গভর্নর হাউজে বসে প্রথমবারের মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন। ৭ ডিসেম্বর কেবল ভূখণ্ড জয়ের দিন ছিল না, এটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর অহংকারের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার দিন।

৭ ডিসেম্বরের প্রভাত শুরু হয় এক অবিস্মরণীয় বিজয়ের সংবাদ দিয়ে। যশোর ক্যান্টনমেন্ট, যা ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি বা ‘ফোর্ট্রেস’, তা এ দিন আনুষ্ঠানিকভাবে যৌথ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আসে। যদিও আগের দিন বিকেলেই পাকিস্তানি ১০৭ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান এক আত্মঘাতী ও কাপুরুষোচিত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

মিত্রবাহিনীর ৯ম ডিভিশন ও ৮ নম্বর সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা যখন যশোর ক্যান্টনমেন্টের তিন দিক বন্ধ করে দেয় এবং ‘বাইপাস’ করে পেছনের দিকে এগিয়ে যায়, তখন হায়াত খান বুঝতে পারেন যে তার বাহিনীর ধ্বংস অনিবার্য। তাই তিনি লড়াই না করে রাতের আঁধারে তার প্রায় ৩০০০ সৈন্য নিয়ে খুলনার দিকে পালিয়ে যান।

এ পলায়ন কতটা বিশৃঙ্খল ও লজ্জাজনক ছিল, তার ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ সংখ্যায় প্রকাশিত সাংবাদিক ড্যান কোগিনের রিপোর্টে। তিনি লিখেছিলেন, ‘পাকিস্তানিরা এতটাই আতঙ্কে পালিয়েছিল যে তারা তাদের সকালের নাস্তা টেবিলে ফেলেই দৌড় দেয়। যশোর ক্যান্টনমেন্টের অফিসার্স মেসে আধা খাওয়া মুরগির মাংস ও গরম ভাত পাওয়া গিয়েছিল, যা তাদের তড়িঘড়ি করে পালানোর সাক্ষ্য দেয়।’

পালানোর সময় অবশ্য ‘পোড়ামাটি নীতি’ অনুসরণ করে শহরের টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও কালেক্টরেট ভবন ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়েই এ দিন বাঙালি তার বিজয়ের নিশান ওড়ায়। হাজার হাজার মানুষ, যারা এতদিন মৃত্যুভয়ে বাংকারে লুকিয়ে ছিল, তারা ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে আকাশ কাঁপিয়ে তোলে।

প্রবাসী সরকারের প্রতিনিধি ও স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতারা যশোর টাউন হল ময়দানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। বিদেশি সাংবাদিক সিডনি শ্যানবার্গ নিউইয়র্ক টাইমসে এ উল্লেখ করেন, যশোরের মানুষ ভারতীয় সৈন্যদের জড়িয়ে ধরছিল ঠিকই, কিন্তু তাদের আসল আবেগ ছিল নিজেদের ‘মুক্তিযোদ্ধা ভাই’দের জন্য; তাদের চোখে ছিল নিজস্ব মাটি ফিরে পাওয়ার বন্য আনন্দ।

দক্ষিণ-পশ্চিমে যখন বিজয়ের উল্লাস, তখন উত্তরাঞ্চলের হিলি সীমান্তে চলছিল এক রক্তক্ষয়ী অধ্যায়। মেজর জেনারেল ডি কে পালিতের ‘দ্য লাইটনিং ক্যাম্পেইন’ ও মেজর রফিকুল ইসলামের ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ বই থেকে জানা যায়, পাকিস্তানি ২০৫ ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার তাজাম্মুল হোসেন মালিক হিলিতে শক্তিশালী ঘাঁটি গেড়েছিলেন। কিন্তু এ দিন ভারতীয় ২০ মাউন্টেন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল লছমন সিং হিলিকে পাশ কাটিয়ে পেছনের দিকে অগ্রসর হন। ৭ ডিসেম্বর তার নেতৃত্বে মিত্রবাহিনী ও ৭ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা বগুড়া-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করে ফেলেন। ফলে হিলিতে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনী মূল কমান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর সংঘটিত ‘ব্যাটল অব সিলেট’ শিল্পীর কল্পনায়। ছবি: সংগৃহীত
১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর সংঘটিত ‘ব্যাটল অব সিলেট’ শিল্পীর কল্পনায়। ছবি: সংগৃহীত

ওদিকে উত্তরপূর্বাঞ্চলের সিলেট রণাঙ্গনে ঘটছিল দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক ইতিহাসের প্রথম ও অন্যতম সফল ‘হেলিবোর্ন অপারেশন’ বা হেলিকপ্টার যোগে সৈন্য অবতরণ। পাকিস্তানি বাহিনী সিলেট শহরকে ঘিরে শক্তিশালী ডিফেন্স তৈরি করেছিল। কিন্তু জেনারেল শগৎ সিংয়ের দুঃসাহসী পরিকল্পনায় ভারতীয় বিমান বাহিনীর এমআই-৪ হেলিকপ্টারের একটি বিশাল বহর সিলেট বিমানবন্দরের ঠিক ওপরে হাজির হয়।

মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (বীর বিক্রম) তার ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য’ ও জেনারেল জ্যাকবের ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’ বইয়ের ভাষ্যমতে, এ দৃশ্য দেখে পাকিস্তানি ২২ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা প্রথমে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি সিগন্যাল ইন্টারসেপ্ট করে শোনা যায় তারা উল্লাস করছে এবং বলছে, ‘চাইনিজ হেলপ আ গায়া! বেইজিং সে দোস্ত আ গায়া!’

অর্থাৎ তারা ভেবেছিল তাদের বন্ধু রাষ্ট্র চীন হয়তো প্যারাট্রুপার বা সাহায্য পাঠিয়েছে। কিন্তু যখন হেলিকপ্টার থেকে গুর্খা রেজিমেন্টের (4/5 Gorkha Rifles) দুর্ধর্ষ জওয়ান ও তাদের পথপ্রদর্শক হিসেবে ৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা দড়ি বেয়ে নামতে শুরু করেন এবং আচমকা গুলিবর্ষণ শুরু করেন, তখন পাকিস্তানিদের ভুল ভাঙে।

আকাশ থেকে নামা এই কমান্ডোরা সিলেট বিমানবন্দর দখল করে নেয়। শহরকে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলী ও মেজর সি আর দত্তের নেতৃত্বে স্থলপথে মুক্তিযোদ্ধারা আগেই পালানোর পথ বন্ধ করে রেখেছিলেন।

রণাঙ্গনের এ উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছিল কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও। মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহর ‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ’ গ্রন্থের তথ্যমতে, ৭ ডিসেম্বর ‘এস ফোর্সের’ (S-Force) নেতৃত্বে দ্বিতীয় বেঙ্গল ও একাদশ বেঙ্গলের মুক্তিযোদ্ধারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে ধাবিত হয় এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে আশুগঞ্জের দিকে হটতে বাধ্য করে।

অন্যদিকে কুমিল্লায় ভারতীয় ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল আর ডি হিরা ও ব্রিগেডিয়ার সানত সিং ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে ফেলেন। ফেনী সীমান্তে কে ফোর্সের (খালেদ মোশাররফ) চতুর্থ বেঙ্গল ও জেড ফোর্সের (জিয়াউর রহমান) প্রথম বেঙ্গলের সাঁড়াশি আক্রমণে পাকিস্তানি ৫৩ ব্রিগেড পিছু হটতে বাধ্য হয়, যার ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এদিন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

যুদ্ধের এই ডামাডোলের মধ্যে জামালপুর রণাঙ্গনে ঘটে এক অসামান্য নাটকীয় ঘটনা, যা সাহসিকতা ও অহংকারের এক দ্বৈরথ হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। জামালপুর পিটিআই ভবনে ঘাঁটি গেড়েছিল পাকিস্তানি ৩১ বালুচ রেজিমেন্ট, যার নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান মাহমুদ।

১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারাসহ মিত্রবাহিনী জামালপুর চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলার পর মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লের রক্তপাত এড়াতে ৭ ডিসেম্বর সকালে কর্নেল সুলতানের কাছে একটি চিঠি পাঠান। বার্তায় তিনি লিখেন, ‘সুলতান, তোমাদের পালানোর সব পথ বন্ধ। জামালপুর এখন মৃত্যুপুরী। অনর্থক রক্তপাত না করে আত্মসমর্পণ করো। আমরা তোমাদের সৈনিকের মর্যাদা দেব।’

৭ ডিসেম্বর দুপুরে এ চিঠি পাওয়ার পর কর্নেল সুলতান যে জবাব দিয়েছিলেন, তা ছিল চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ। তিনি উত্তরের চিঠির সঙ্গে একটি পয়েন্ট থ্রি-নট-থি রাইফেলের গুলি বা বুলেট মুড়িয়ে ফেরত পাঠান এবং চিঠিতে লিখেন, ‘আশা করি এই বুলেটের মধ্যে তুমি তোমার উত্তর খুঁজে পাবে। আমরা এখানে লড়াই করতে এসেছি, ভিক্ষা চাইতে আসিনি। ইনশাল্লাহ, জামালপুরের মাটিতেই তোমাদের কবর হবে।’

জবাব পাওয়ার পর ৭ ডিসেম্বর বিকেল থেকেই যৌথ বাহিনী জামালপুরের ওপর সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করে। আকাশ থেকে ভারতীয় মিগ বিমানগুলো পিটিআই ভবনের ওপর বৃষ্টির মতো নাপাম বোমা ও রকেট ছুড়তে থাকে। কর্নেল সুলতানের সেই অহংকারই শেষ পর্যন্ত তার বাহিনীর ধ্বংস ডেকে আনে, যা পরে ১০ ডিসেম্বর তাদের অপমানজনক আত্মসমর্পণে বাধ্য করে।

রণাঙ্গনের এ বিপর্যয়ের ঢেউ আছড়ে পড়ে ঢাকায়। অবরুদ্ধ ঢাকার দিনলিপিতে ৭ ডিসেম্বর ছিল এক অদ্ভুত গুমোট ভাব ও গুজবের দিন। শহিদ জননী জাহানারা ইমাম তার কালজয়ী গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে ৭ ডিসেম্বরের ঢাকার চিত্র তুলে ধরেছেন এক নিপুণ ও বেদনার্ত ভাষায়।

ডায়েরিতে লিখেছেন, “আজ মঙ্গলবার। ৭ ডিসেম্বর। আকাশ যুদ্ধের বিরাম নেই। কিছুক্ষণ পর পর সাইরেন বাজছে। আমরা এখন আর বাংকারে যাই না। সিঁড়ির নিচে চুপচাপ বসে থাকি। গুজব ছড়িয়েছে, যশোর মুক্ত হয়েছে। কিন্তু রেডিও পাকিস্তান বা টিভি কিছুই বলছে না। তারা শুধু বলছে, ‘আমাদের বীর জওয়ানরা দুশমনকে হটিয়ে দিচ্ছে।’ কিন্তু দুশমন যদি হঠেই যায়, তবে সাইরেন কেন থামছে না? রুমি কি এসব দেখছে? রুমি কি জানছে তার দেশ স্বাধীন হতে চলেছে?”

ঢাকার গভর্নর হাউজে (বর্তমান বঙ্গভবন) তখন চলছিল পাকিস্তানি শাসনামলের শেষ অঙ্কের নাটক। পাকিস্তানি বাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে এ দৃশ্যের এক রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন।

৭ ডিসেম্বর বিকেলে গভর্নর ডা. মালিক ও ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন। রণাঙ্গনের একের পর এক পতনের খবর, যশোরের পতন, সিলেটের দুরবস্থা, ফেনী ও নোয়াখালী হাতছাড়া হওয়া এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কোনো সাহায্য না পাওয়ার হতাশায় দুর্ধর্ষ জেনারেল নিয়াজি কান্নায় ভেঙে পড়েন।

সিদ্দিক সালিক লিখছেন, “জেনারেল নিয়াজি তার মুখ দুই হাতে ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। ঘরের ভেতর পিনপতন নীরবতা। উপস্থিত অফিসাররা হতভম্ব হয়ে দেখলেন, তাদের সেনাপতি কাঁদছেন। যে নিয়াজি বলতেন ‘আমি বাংলার বাঘ’, আজ তিনি বিড়ালের মতো অসহায়।”

রাওয়ালপিন্ডি থেকে সেনাপ্রধান জেনারেল আব্দুল হামিদ খান এ দিনও নিয়াজিকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বলছিলেন, ‘তোমরা মাটি কামড়ে পড়ে থাকো, সাহায্য আসছে।’ কিন্তু নিয়াজির কান্না প্রমাণ করছিল, তিনি বুঝে গেছেন তাদের ‘ফ্রন্টিয়ার ডিফেন্স’ কৌশল ব্যর্থ হয়েছে এবং ঢাকার পতন এখন কেবল সময়ের ব্যাপার।

এ দিন থেকেই গভর্নরের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী বুঝতে পারেন, খেলা শেষ এবং তিনি আল-বদর বাহিনীকে সংগঠিত করে বুদ্ধিজীবী হত্যার জঘন্য নীলনকশা চূড়ান্ত করতে শুরু করেন।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও ৭ ডিসেম্বর ছিল টানটান উত্তেজনার দিন। আগের দিন ভারত ও ভুটানের স্বীকৃতির পর পাকিস্তান মরিয়া হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সাহায্য ভিক্ষা চায়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে টেলিফোনে এক আতঙ্কিত বার্তা পাঠান, ‘পূর্ব পাকিস্তান আমাদের হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে। আপনারা যদি এখনই কিছু না করেন, তবে পাকিস্তান ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।’

মঈদুল হাসানের ‘মূলধারা ’৭১’ বইয়ের তথ্যমতে, ৭ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে হেনরি কিসিঞ্জার ও প্রেসিডেন্ট নিক্সন এক গোপন বৈঠকে বসেন এবং পাকিস্তানকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে বঙ্গোপসাগরে তাদের পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরী ‘ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ’ (Task Force 74) পাঠানোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভারতকে ভয় দেখানো এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মানসিকভাবে দুর্বল করা। কিন্তু রণাঙ্গনের বাস্তবতা তখন এতটাই দ্রুত পালটাচ্ছিল যে আমেরিকার এই নৌ বহর পৌঁছানোর আগেই ঢাকায় পাকিস্তানের পতন নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছিল।

৭ ডিসেম্বর দেশের অন্যান্য রণাঙ্গনেও বিজয়ের পতাকা উড়তে থাকে। ৯ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ভোমরা সীমান্তে তুমুল যুদ্ধের পর সাতক্ষীরা শহরে প্রবেশ করেন। মৌলভীবাজারের শমশেরনগর বিমানবন্দর দখল করার পর মিত্রবাহিনীর বিমানগুলো সেখান থেকে অপারেশন চালানো শুরু করে।

সুনামগঞ্জে ৫ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ মোত্তালিবের নেতৃত্বে ছাতক ও সুনামগঞ্জ শহর মুক্ত হয়। উত্তরাঞ্চলে লালমনিরহাট পুরোপুরি মুক্ত হওয়ার পর যৌথ বাহিনী রংপুরের দিকে অগ্রসর হয়। রংপুরের পীরগঞ্জ ও পলাশবাড়ী এলাকায় এদিন তুমুল যুদ্ধ হয়, যেখানে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ও বগুড়ার দিকে সরে যেতে থাকে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ ছিল সেই দিন, যে দিন পাকিস্তানি বাহিনীর ‘মর‍্যাল’ বা মনোবল পুরোপুরি ভেঙে যায়। আকাশ থেকে নামা কমান্ডোরা যখন সিলেটে পাকিস্তানিদের ঘিরে ফেলছে, তখন হিলি-ফেনী আর যশোরে উড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয়ের পতাকা। জামালপুরে পাকিস্তানি কমান্ডারের বুলেটের জবাব ফিরে আসছে বোমার আঘাতে, আর ঢাকায় জেনারেল নিয়াজির অশ্রু বলে দিচ্ছিল— ‘খেলা শেষ’।

এ দিন প্রমাণিত হয়, আধুনিক অস্ত্র আর দম্ভ থাকলেই যুদ্ধে জেতা যায় না, যদি না বুকে থাকে সাহস আর পায়ের নিচে থাকে জনগণের সমর্থন। ৭ ডিসেম্বরের সূর্যাস্ত দেখার সময় বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা জানতেন, তাদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি এবং বিজয়ের সূর্যোদয় এখন কেবল সময়ের ব্যাপার।

তথ্যসূত্র

  • উইটনেস টু সারেন্ডার (Witness to Surrender) – ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক (পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পিআরও)
  • একাত্তরের দিনগুলি – জাহানারা ইমাম
  • টাইম ম্যাগাজিন আর্কাইভ (২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ সংখ্যা) – The War: The Bengal Tiger and His Cubs
  • দ্য নিউইয়র্ক টাইমস আর্কাইভ (৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ – সিডনি শ্যানবার্গের রিপোর্ট)
  • এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য – মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী বীর বিক্রম
  • দ্য লাইটনিং ক্যাম্পেইন (The Lightning Campaign) – মেজর জেনারেল ডি কে পালিত
  • সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা (Surrender at Dacca) – লেফট্যানেন্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব
  • লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে – মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম
  • মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ – মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ বীর উত্তম
  • মূলধারা ’৭১ – মঈদুল হাসান
  • বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র (ত্রয়োদশ খণ্ড) – তথ্য মন্ত্রণালয়
  • একাত্তরের রণাঙ্গন – শামসুল হুদা চৌধুরী
  • বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ – এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ
ad
ad

সাত-পাঁচ থেকে আরও পড়ুন

বিজয়ের মাসে ৩১টি যাত্রাপালা দেখাবে শিল্পকলা একাডেমি

সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই উৎসব পরিণত হয়েছে গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির এক অনন্য মিলনমেলায়।

৩ দিন আগে

‘পাকিস্তান আজ মৃত’— এক ভেটো ও আকাশজয়ের আখ্যান

পাকিস্তানি ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল কামাল ও তার সৈন্যরা এই প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আখাউড়া স্টেশনের দখল নেয় মুক্তিবাহিনী।

৩ দিন আগে

অবরোধের নিখুঁত কৌশলে পতন ‘দুর্ভেদ্য দুর্গে’র, মুক্ত ঢাকার প্রবেশদ্বার

কামালপুর কেবল একটি বিওপি বা বর্ডার আউটপোস্ট ছিল না, এটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর অহংকারের প্রতীক এবং ঢাকা বিজয়ের চাবিকাঠি। এ যুদ্ধের কাহিনি কোনো সাধারণ যুদ্ধের বিবরণ নয়; বারুদ, কাদা, রক্ত ও মানুষের অকল্পনীয় জেদের এক মহাকাব্যিক উপাখ্যান।

৪ দিন আগে

কী কী সুবিধা আছে কাতার আমিরের এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে

সব প্রস্তুতি শেষ হলে আজ মধ্যরাত অথবা শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) সকালের মধ্যে খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য প্রফেসর ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন।

৪ দিন আগে