top ad image
top ad image
home iconarrow iconমতামত

ট্রাম্পের শুল্কে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে অশনি সংকেত

ট্রাম্পের শুল্কে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে অশনি সংকেত

বিশ্বজুড়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপ করা নতুন শুল্ক হার নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে সবাই। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন, গত ২ এপ্রিল স্থানীয় সময় বুধবার হোয়াইট হাউজের রোজ গার্ডেনে নতুন করে এই শুল্ক আরোপের ঘোষণা করেন ট্রাম্প, যা বিভিন্ন দেশে সর্বনিম্ন ১০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। ব্যাপক হারে ঢালাও এই শুল্ক আরোপের পর একে ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ হিসেবেও আখ্যায়িত করছে অনেক দেশ।

যুক্তরাষ্ট্রে এই নজিরবিহীন শুল্ক আরোপের ফলে তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে পড়েছে বিরূপ প্রভাব। হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ট্রাম্পের এ ঘোষণায় বিবিসি, সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমসসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উঠে এসেছে বিশ্বনেতাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বলেছে, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বড় ধাক্কা। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার বলেছেন, এ ঘটনার অর্থনৈতিক প্রভাব অনুভূত হবে নিঃসন্দেহে। অস্ট্রেলিয়া বলছে, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত বন্ধুসুলভ নয়।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সর্বশেষ আরোপ করা শুল্কের কারণে তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্ব বাজারে দেখা দিয়েছে চরম বিশৃঙ্খলা। আর তাতেই বিশ্বের শীর্ষ ৫০০ ধনী এক দিনে খুইয়েছেন মোট ২০ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের সম্পদ। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বলছে, ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার্স ইনডেক্সের ১৩ বছরের ইতিহাসে এটি এক দিনে চতুর্থ বৃহৎ পতন, কোভিড-১৯ মহামারির পর যা সর্বোচ্চ।

এ ঘটনার জেরে সবচেয়ে বেশি সম্পদ হারিয়েছেন মেটার স্বত্বাধিকারী মার্ক জাকারবার্গ ও অ্যামাজনপ্রধান জেফ বেজোস। ইলন মাস্কও এক দিনে হারিয়েছেন এক হাজার ১০০ কোটি ডলার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের শেয়ারের দাম কমেছে ৯ শতাংশ। জাকারবার্গ হারান এক হাজার ৭৯০ কোটি ডলার। একইভাবে দরপতনে অ্যামাজনের শেয়ার কমেছে এক হাজার ৫৯০ কোটি ডলার।

এখানেই শেষ নয়। ট্রাম্পের এই নতুন শুল্ক আরোপ প্রভাবিত করেছে সোনার বাজারকেও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের এই পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত শুল্ক আরোপের ঘটনায় অনেকটাই বদলে যেতে পারে বিশ্বে অর্থনীতি ও এর গতি প্রকৃতি। গড়ে উঠবে নতুন অর্থনৈতিক বলয়। ভেঙে পড়তে পারে পুরনো হিসাব।

তালিকা অনুযায়ী, বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তানের ওপর এই হার ২৯ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৬ শতাংশ, চীনের ওপর ৩৪ শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ওপর ২০ শতাংশ। কম্বোডিয়ায় ৪৯ শতাংশ, ভিয়েতনামে ৪৬ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৪৪ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৩৬ শতাংশ, তাইওয়ানে ৩২ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ৩২ শতাংশ, সুইজারল্যান্ডে ৩১ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৩০ শতাংশ ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প।

জাপান ও মালয়েশিয়ায় ট্রাম্প শুল্ক আরোপ করেছেন ২৪ শতাংশ করে, ইসরায়েল ও ফিলিপাইনে ১৭ শতাংশ হারে। সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, ব্রাজিল, চিলি, অস্ট্রেলিয়া ও কম্বোডিয়ায় ১০ শতাংশ করে শুল্ক আরোপের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়াও মিয়ানমারের পণ্যে ৪৪ শতাংশ, লাওসের পণ্যে ৪৮ শতাংশ ও মাদাগাস্কারের পণ্যের ওপর আরোপ করা হয় ৪৭ শতাংশ শুল্ক।

এতদিন বাংলাদেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কহার গড়ে ১৫ শতাংশ থাকলেও ট্রাম্পের নতুন ঘোষণায় বাংলাদেশি পণ্যে শুল্কের হার বেড়ে যায় দ্বিগুণেরও বেশি। বাংলাদেশের প্রধান দুটি রপ্তানি বাজারের একটি যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় প্রায় ৮৪০ কোটি ডলারের। গত বছরও যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানি ছিল ৭৩৪ কোটি ডলার।

বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি ৮০ শতাংশই তৈরি পোশাক, যার একক বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া তৈরি পোশাকের ১৮ শতাংশ রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। নতুন এই শুল্ক কাঠামোতে দেশের পোশাক খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের।

ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকেরা। দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা বলছেন, সব দেশের ওপর পালটা শুল্ক আরোপ হওয়ায় তৈরি পোশাকের দাম বাড়বে। তাতে পোশাকের চাহিদা কমে যেতে পারে। তা ছাড়া শুল্ক বেড়ে যাওয়ায় দাম কমাতে উৎপাদকদের চাপে রাখবে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বিপদে পড়বেন।

অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) তথ্য বলছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ চীন, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, ভারত। এর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে কম শুল্ক আরোপ হয়েছে চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও মেক্সিকোর ওপর। ভারতের ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়ছে ২৬ শতাংশ। এতে সামনের দিকে পোশাক রপ্তানির বাজার হারাতে পারে বাংলাদেশ, যে বাজার দখল করতে পারে ভারত।

এ বিষয়ে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘পালটা শুল্কের কারণে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের পালটা শুল্ক কমাতে বাংলাদেশের উচিত হবে সরকারি পর্যায়ে দ্রুত আলোচনা শুরু করা।’

মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের তুলা আমদানি করে পোশাক তৈরি করছি আমরা। সেই পোশাকের বড় অংশ আবার যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হচ্ছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের কাঁচামাল ব্যবহার করে উৎপাদিত পণ্য তাদের দেশে রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা আদায়ে পদক্ষেপ নিতে পারে সরকার।’

দেশের অর্থনীতি ও তৈরি পোশাক খাতে বিগত সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় এ অভিঘাত কীভাবে সামলাবে সরকার, তা নিয়ে এরই সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে শুরু হয়েছে আলোচনা। যুক্তরাষ্ট্রের এই পরিকল্পনার বিষয়ে সরকারের সুস্পস্ট পরিকল্পনা এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন না হয়ে নতুন শুল্কহার অব্যাহত থাকলে সামনের বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতি কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকেরা।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

r1 ad
top ad image