‘অপারেশন সিঁদুর’— নামেই বার্তা?\n
পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এই হামলাকে ‘যুদ্ধ ঘোষণার শামিল’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পাকিস্তানও এর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। তারা হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং পালটা হামলার হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবর, নিয়ন্ত্রণ রেখা ও আন্তর্জাতিক সীমান্তে উভয় দেশের সেনাদের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি ও পালটাপালটি হামলার ঘটনা ঘটেছে।
আল জাজিরার তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জানিয়েছেন যে তারা বেশ কয়েকটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে এবং কিছু ভারতীয় সেনাকে বন্দি করেছে। এ দাবির সত্যতা নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা যায়নি।
এ পরিস্থিতিতে উভয় দেশই তাদের সামরিক শক্তি প্রদর্শন করছে। পাকিস্তান তাদের স্বল্প-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে, যা আঞ্চলিক উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারতের নৌ বাহিনীও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে বলে জানা যায়।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এই সাম্প্রতিক সংঘাত বাংলাদেশের জন্য কিছু সম্ভাব্য প্রভাব ফেলতে পারে।
ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব: দক্ষিণ এশিয়ায় যেকোনো বড় ধরনের সংঘাতের আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে সবসময় শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার নীতিতে বিশ্বাসী। তবে দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হলে তা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতির ওপর চাপ তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশকে একটি নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখতে হতে পারে, যা বেশ কঠিন হতে পারে।
অর্থনৈতিক প্রভাব: ভারত ও পাকিস্তান বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার না হলেও এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এ উত্তেজনা যদি দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি করে, তবে তা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা বয়ে আনতে পারে। তেমনটি হলে প্রভাব পড়বে বাংলাদেশেও।
এ ছাড়াও এ অঞ্চলের সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে, যার ফলে কিছু পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেতে পারে। ভারত ও পাকিস্তানের অর্থনীতি একে অন্যের সঙ্গে সরাসরি গভীরভাবে যুক্ত না হলেও এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে।
বাণিজ্য: যদিও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য খুব বেশি নয়, তবে আঞ্চলিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। সীমান্ত বন্ধ বা কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে পণ্যের সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে।
বিনিয়োগ: বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সাধারণত আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে। যদি এই অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতা দেখা দেয়, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
জ্বালানি খাত: বাংলাদেশ তার জ্বালানি চাহিদার একটি অংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করে। যদি এই সংঘাতের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশে এর সরাসরি প্রভাব পড়বে।
পরিবহন ও সরবরাহ: আঞ্চলিক অস্থিরতা পরিবহন ও সরবরাহকে ব্যাহত করতে পারে, যার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বেড়ে যেতে পারে।
মানবিক প্রভাব: যদিও সরাসরি কোনো সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা বাংলাদেশে নেই, তবে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা একটি উদ্বেগের কারণ হতে পারে। যদি ব্যাপকসংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়, তার একটি পরোক্ষ চাপ প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ওপরও পড়তে পারে।
কূটনৈতিক প্রভাব: এই সংঘাতের কারণে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশ আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করার সুযোগ পেতে পারে, যদিও এর বাস্তবতা নির্ভর করে উভয় পক্ষের সম্মতির ওপর। এই সংঘাতের আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
সাধারণত, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়লে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানায়। তবে এবারের প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন। পহেলগামের সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা বিভিন্ন দেশ জানিয়েছে, যা ভারতের পদক্ষেপের প্রতি কিছু আন্তর্জাতিক সমর্থন এনে দিতে পারে।
অন্যদিকে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ভারতের অভিযানকে ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মহলে তাদের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা।
জাতিসংঘের ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান এ সংঘাতের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশের উচিত হবে আন্তর্জাতিক ফোরামে শান্তির পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখা এবং যেকোনো ধরনের উত্তেজনা প্রশমনে সহযোগিতা করা।
সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব: এ সংঘাতের একটি পরোক্ষ সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে পারে। বিশেষত, সামাজিক মাধ্যমে এই সংঘাত নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ভুল তথ্য ও গুজব ছড়াতে পারে, যা জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।
ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুরে’র প্রকৃতি ও এর প্রভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভারতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এটি ছিল ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’, অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা। তবে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া এবং তাদের আকাশসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ থেকে বোঝা যায় যে এই অভিযান হয়তো আরও ব্যাপক ছিল।
নিরপেক্ষ সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর উভয় দেশের সামরিক শক্তি যথেষ্ট শক্তিশালী। পাকিস্তানের রয়েছে একটি সুসজ্জিত সেনাবাহিনী ও পারমাণবিক অস্ত্রাগার, যা ভারতকে যেকোনো বড় ধরনের সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার আগে ভাবতে বাধ্য করবে।
অন্যদিকে ভারতের সামরিক শক্তিও কোনো অংশে কম নয় এবং তাদের সাম্প্রতিক অভিযান দেখিয়েছে যে তারা সীমান্ত পেরিয়ে আঘাত হানতে দ্বিধা করবে না। এই সংঘাতের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো উভয় পক্ষের আকাশসীমার ব্যবহার।
পাকিস্তানের দাবি অনুযায়ী, তারা ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। যদি এই দাবি সত্যি হয়, তবে তা ভারতের জন্য একটি বড় ধাক্কা হতে পারে। আকাশপথে শ্রেষ্ঠত্ব যেকোনো সামরিক সংঘাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য কিছু সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি—
কূটনৈতিক তৎপরতা: আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শান্তি বজায় রাখার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা;
সীমান্ত নিরাপত্তা: বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা, যেন কোনো দরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা: দেশের অর্থনীতিকে সম্ভাব্য ধাক্কা থেকে রক্ষা করার জন্য আগাম প্রস্তুতি নেওয়া এবং বিকল্প বাণিজ্য পথের সন্ধান করা;
জনসচেতনতা: গণমাধ্যমের মাধ্যমে জনগণকে সঠিক তথ্য সরবরাহ করা এবং গুজবের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করা;
যদি এই সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে এর অনেক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এটি শুধু ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও অগ্রগতিকে ব্যাহত করবে। অস্ত্র প্রতিযোগিতা বাড়বে , যা এই অঞ্চলের উন্নয়ন বাজেটকে কমিয়ে দেবে। দারিদ্র্য ও বেকারত্বের মতো সমস্যা আরও প্রকট হতে পারে।
এই মুহূর্তে পরিস্থিতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। বাংলাদেশের উচিত হবে ধৈর্য ধরে পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা এবং জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখে একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অনুসরণ করা। আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত।
ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার সময় বাংলাদেশে সরাসরি সামরিক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা খুব কম হলেও কূটনৈতিক ও আঞ্চলিক নীতিতে চাপ বাড়বে। দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে বাংলাদেশকে খুব সতর্কভাবে অবস্থান নিতে হবে, বিশেষ করে বিবৃতি বা রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে। অযাচিত মন্তব্য বা পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান বাংলাদেশকে অপ্রয়োজনে দ্বিপাক্ষিক জটিলতার মুখে ফেলতে পারে।
উপমহাদেশে সংঘাতময় আবহে বাংলাদেশে নানা রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও নাগরিক সমাজের ভেতর প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। ভারতের মুসলিমবিরোধী রাজনীতি বা যুদ্ধমনস্ক অবস্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হতে পারে, আবার কোনো পক্ষ সরকারের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। অতীতে দেখা গেছে, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার সময় বাংলাদেশে রাজনৈতিক মেরুকরণও তীব্র হয়।
আঞ্চলিক উত্তেজনার সময় বিভিন্ন জঙ্গি বা উগ্রপন্থি সংগঠন এ পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে আবেগতাড়িত প্রচারণা চালাতে পারে। ফলে নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবে। সীমান্ত অঞ্চলেও নজরদারি জোরদার করা দরকার, কারণ উত্তেজনার মধ্যে অবৈধ অনুপ্রবেশ বা অস্ত্র ও চোরাচালান বাড়ার আশঙ্কা থাকে।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান এই উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য একটি অশনি সংকেত। আমরা আশা করি, উভয় পক্ষই সংযম প্রদর্শন করবে এবং আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করবে। বাংলাদেশের সরকার এবং জনগণের পক্ষ থেকে সর্বদা শান্তি ও স্থিতিশীলতার পক্ষে জোরালো সমর্থন থাকবে। এই অঞ্চলের শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য।
এরই মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে দুই দেশকে শান্ত ও সংযত থাকা এবং পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে— এমন কোনো পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। বুধবার এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ আহ্বান জানিয়েছে। আমার মনে হয় বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় প্রতিটি মানুষ এই আহবানের সঙ্গে একমত হবেন।
লেখক কোম্পানি সচিব, সিটি ব্যাংক পিএলসি