পাকিস্তানি নেতাদের কণ্ঠে যুদ্ধের সুর, এড়াতে চায় সাধারণ মানুষ

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ০৪ মে ২০২৫, ১৩: ১০
পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে নাজামান আব্বাসির পত্রিকা স্টলে দাঁড়িয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলেন জাকির খান। কাশ্মির ঘিরে উত্তেজনায় নাজামান বা জাকিরের মতো পাকিস্তানের বেশির ভাগ সাধারণ মানুষের অবস্থানই যুদ্ধের বিরুদ্ধে। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস

ইসলামাবাদের একটি পত্রিকা স্টলে খবরের কাগজ পড়ছিলেন জাকির খান। পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্টল মালিক নাজামান আব্বাসি। পত্রিকার শিরোনাম— ‘ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা কমাতে পূর্ণ শক্তিতে নেমেছে আমেরিকা।’

ওদিকে সশস্ত্র কনভয় এগিয়ে চলেছে পাকিস্তান-ভারত সীমান্তের দিকে। যুদ্ধবিমান ছুটছে আকাশে। টেলিভিশনের পর্দায় ঘোষণা হচ্ছে যুদ্ধের পূর্বাভাস। পাকিস্তানের সরকারসহ রাজনৈতিক নেতারাও ঘোষণা দিচ্ছেন— যেকোনো সামরিক আগ্রাসনের জবাবে কড়া প্রতিক্রিয়া জানানো হবে।

এ রকম যুদ্ধংদেহী পরিস্থিতির সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ। স্পষ্টতই তাদের অবস্থান যুদ্ধের বিপক্ষে। তাদের কাছে যুদ্ধ হচ্ছে সর্বশেষ বিকল্প, যার ভার বহনের সক্ষমতা তার দেশের আর এখন নেই।

সরকারি বক্তব্য আর সাধারণ মানুষের অবস্থানের মধ্যে এই পার্থক্যই তুলে ধরে এমন একটি দেশকে, যেটি ভেতরে ভেতরে অনেকটাই ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক দুরবস্থা আর রাজনৈতিক নিরুৎসাহ জীবনের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস কিংবা বৈঠকখানা— ভারতের সঙ্গে এমন যুদ্ধপ্রায় পরিস্থিতিতেও পাকিস্তান জুড়ে আলোচনার বিষয় এখন আর যুদ্ধ বা সীমান্ত নয়, বরং মানুষ বলছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকারত্ব, অকার্যকর রাজনৈতিক ব্যবস্থা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা।

‘এ পরিস্থিতি আমাকে অস্থির করে তুলছে,’— বললেন ইসলামাবাদের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ বছর বয়সী শিক্ষার্থী তাহসিন জহরা। যখন তিনি কথাটি বলছিলেন, এর এক সপ্তাহ আগেই ভারতশাসিত কাশ্মিরে এক সন্ত্রাসী হামলা ভারত-পাকিস্তান দীর্ঘদিনের বৈরিতাকে নতুন করে উসকে দিয়েছে।

যুদ্ধকে বিপদ অভিহিত করে তাহসিন বলেন, ‘আমি বুঝি, নেতারা শক্তি দেখাতে চান। কিন্তু যুদ্ধ নিয়ে এত কথা যেন খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের তো আগে থেকেই অনেক সমস্যা রয়েছে। আমাদের দরকার শান্তি, নতুন আর কোনো বিপদ নয়।’

তাহসিন আরও জানান, গত কয়েক বছরে দ্রব্যমূল্য ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ায় তার পরিবারের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা কষ্টকর হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে দেশটির নেতাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘নেতারা অনেক কথা বলেন। কিন্তু তেমন কিছু বদলায় না। মনে হয়, তারা জানেই না মানুষ কী কষ্টের মধ্যে আছে।’

যারা দেশপ্রেমকে ধরে রেখেছেন তারাও আজকের পাকিস্তানের কঠিন বাস্তবতা অস্বীকার করছেন না। ইসলামাবাদের ২৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থী ইনামুল্লাহ যেমন বলেন, ‘আমি মনে করি, অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশ অনেক দুর্বল হয়ে গেছে।’

তবু পাকিস্তানিরা সহজে ভেঙে পড়ছেন না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুদ্ধবিরোধী মিম ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে কখনো ভারতের কথিত যুদ্ধোন্মত্তাকে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে। এ ধরনের ‘ডার্ক হিউমার’কে অনেকে মানসিক চাপ মোকাবিলার এক উপায় হিসেবে দেখছেন।

‘হ্যাঁ, এটি এক ধরনের সহনশীলতা। কিন্তু এটি এক ধরনের মানসিক গা-ছাড়া ভাবও বটে,’— বললেন লাহোরের মনোচিকিৎসক জাবেরিয়া শহজাদ।

গত কয়েক বছরে তার রোগীদের মধ্যে এক ধরনের দীর্ঘস্থায়ী হতাশা লক্ষ করছেন বলে জানালেন এই চিকিৎসক। এই হতাশার নেপথ্যে রয়েছে রাজনৈতিক দমন-পীড়নের কারণে সংকুচিত হয়ে আসা স্বাধীনতা এবং দেশের অর্থনীতির গভীর সংকট। ফলে মানুষ খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য জাবেরিয়া শহজাদের।

ঐতিহাসিকভাবেই পাকিস্তানে সেনাবাহিনী কেবল সীমান্ত পাহারা দেয় না, বরং পর্দার আড়াল থেকে রাজনীতিতেও ব্যাপক প্রভাব রাখে। অতীতে বহুবার, ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বা জাতীয় সংকটের সময়, সেনাবাহিনীকে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার শক্তি হিসেবে দেখা হয়েছে।

২০১৯ সালে যখন জঙ্গিরা কাশ্মিরে বহু ভারতীয় নিরাপত্তা সদস্যকে হত্যা করে এবং যার জের ধরে দুই দেশের জনগণের মধ্যে আবেগ তুঙ্গে ওঠে, তখনো পাকিস্তানের সেনাবাহিনী জনসমর্থন ধরে রেখেছিল। কিন্তু আজকের দিনে সেই আবেগগুলো আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি আনুগত্য এখনো আছে বটে, কিন্তু তাতে ক্ষোভ ও হতাশার ছাপও রয়েছে।

২০২২ সালে ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুতি এবং তার সমর্থকদের ওপর দমন অভিযান, হাজার হাজার কর্মীর গ্রেপ্তার, অনেক নেতা গা ঢাকা দেওয়া বা দলত্যাগ— এই প্রক্রিয়া সমাজে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। ইমরান খান একসময় সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টদের পছন্দের নেতা ছিলেন। পরে জেনারেলদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে ক্ষমতাচ্যুত হন তিনি।

ইমরান খানের শাসনামলে এক প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী মোহসিন লাঘারি বলেন, ‘মানুষের মধ্যে যে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আর আপনভাব ছিল, তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রত্যেকেই কাউকে না কাউকে চেনে যে নির্যাতনের শিকার হয়েছে।’

ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) সাবেক সংসদ সদস্য আলিয়া হামজাও গ্রেপ্তার, পুলিশি নির্যাতন ও গৃহবন্দিত্বের শিকার হয়েছিলেন। তিনি বলছেন, ‘যদি সেনাবাহিনী জনসমর্থন হারায়, তাহলে জাতীয় সংকট মোকাবিলা কঠিন হয়ে যাবে। কারণ আপনার যদি জনসমর্থন না থাকে, তাহলে আপনি কীভাবে চলবেন?’

আলিয়া মনে করেন, ইমরান খান জেলে থাকলেও জাতীয় আলোচনায় তাকেও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। অনেক বিরোধী নেতাও একই পরামর্শ দিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত সরকারের তরফে এমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।

সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনির ও ইমরান খানের সম্পর্ক এখনো বৈরী। ২০১৯ সালের ভারত-পাকিস্তান সংকটের সময় মুনির ছিলেন আইএসআইয়ের প্রধান। ইমরান খান তাকে কয়েক মাস পর সে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেন এবং সেনাপ্রধান পদে তার নিয়োগের বিরোধিতা করেন।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, মুনির ভারতের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন এবং তার নেতৃত্ব গঠিত হয়েছে সামরিক গোয়েন্দা অভিজ্ঞতা থেকে। সমালোচকদের মতে, তার নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক প্রভাব আরও বেড়েছে, বিপরীতে আলোচনা ও ভিন্নমতের পরিসর সংকুচিত হয়েছে।

এই রাজনৈতিক বিভক্তি এমন সময় ঘটছে, যখন পাকিস্তান নানাবিধ সংকটের মুখোমুখি। পশ্চিম সীমান্তে পরিস্থিতি অস্থির, সেখানে পাকিস্তানি তালেবান ও আফগান তালেবান জঙ্গিরা হামলা বাড়িয়েছে। এ সপ্তাহেও পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী জানিয়েছে, আফগান সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে দুই রাতের অভিযানে তারা ৫৪ জঙ্গিকে হত্যা করেছে। দক্ষিণ-পশ্চিমেও দীর্ঘদিন ধরে চলা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সম্প্রতি আরও প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে।

এর মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক সংকট আরও উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। সরকার সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে আরেকটি বেলআউট পেয়েছে এবং জনগণকে স্বস্তির আশ্বাস দিচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ পাকিস্তানির কাছে এই প্রতিশ্রুত পরিবর্তন এখনো অনেক দূরের ব্যাপার।

অর্থমন্ত্রী মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব বলেছেন, ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা এই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার জন্য ‘সহায়ক নয়’। বহু মানুষের কাছে এখন জীবনধারণের লড়াই ও সম্ভাব্য যুদ্ধ— দুটোই এক হয়ে গেছে। পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে এ সংকট আরও বেশি অনুভূত হচ্ছে।

নিলম ভ্যালির পর্যটন শহর কেরান এখন জনশূন্য। অতিথিশালাগুলো ফাঁকা। স্থানীয়দের মতে, ভারতীয় কাশ্মিরে সাম্প্রতিক হামলার পর পর্যটকরা আর আসছেন না।

পর্যটন ব্যবসায়ী রাজা আমজাদ বলেন, সরকার পর্যটকদের আনুষ্ঠানিকভাবে নিষেধ করেনি, কিন্তু সেটা প্রয়োজনও হয়নি। কারণ মানুষ ঝুঁকি নিতে চায় না। তাই কেউ আসছে না।

বাড়ির পেছনের বাংকার পরিষ্কার করছিলেন লাইন অব কন্ট্রোলের পাশে অবস্থিত অথমাকাম শহরের সাদিয়া বিবি (৪০)। তিনি বলেন, ‘এখনো গোলাগুলি শুরু হয়নি, কিন্তু হতে কতক্ষণ। আমি আমার ছেলেমেয়েদের জন্য জায়গাটা প্রস্তুত করছি।’

দেশ জুড়ে বহু তরুণ পাকিস্তানি এখন আশার আলো খুঁজছেন কেবল এক জায়গায়— দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া। ইসলামাবাদের একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ৩১ বছর বয়সী জারা খান যেমন বলছিলেন, ‘আমাদের বেশির ভাগের জন্য সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হচ্ছে— এমন দমবন্ধ করা একটা দেশে স্বাধীনভাবে বাঁচার চেষ্টা করতে হচ্ছে।’

‘আমাদের কাছে পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। চাকরির বাজার ভেঙে পড়েছে। পরিবার গড়ার চিন্তা শুধু স্বপ্ন। এখানে থাকা মানেই পুরোপুরি হতাশা,’— বলেন জারা খান।

[নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অবলম্বনে]

ad
ad

বিশ্ব রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে ১৫ দেশের যৌথ বিবৃতি

ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে সবার প্রতি আহবান জানিয়ে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে ১৫টি দেশ। তারা হামাসের হাতে থাকা সব জিম্মির মুক্তি ও গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতিরও আহ্বান জানিয়েছে।

৭ ঘণ্টা আগে

এবার ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির ঘোষণা কানাডার

গাজায় চলমান ইসরাইলি নৃশংসতার মধ্যে এবার ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়ার ঘোষণা দিল কানাডা। এ নিয়ে বিগত কয়েক দিনে উন্নত সাত দেশের জোট জি-৭-এর তিন সদস্য ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলো।

৭ ঘণ্টা আগে

ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করলেন ট্রাম্প

তিনি লেখেন, ভারত আমাদের বন্ধু হলেও, বছরের পর বছর ধরে তারা আমাদের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে অনেক কম বাণিজ্য করেছে। কারণ, তাদের শুল্ক বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ। শুধু তাই নয়, ভারতে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অ-শুল্ক বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা।

১৯ ঘণ্টা আগে

হিউয়েন সাংয়ের ভারত ভ্রমণ

৬০২ খ্রিষ্টাব্দে চীনের হেনান প্রদেশে জন্ম নেওয়া হিউয়েন সাং ছোটবেলা থেকেই বৌদ্ধধর্মের প্রতি গভীর আগ্রহী ছিলেন। বড় হয়ে তিনি 'তাং' (Tang) সাম্রাজ্যের বিখ্যাত বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হয়ে ওঠেন। সে সময় চীনে পালি ও সংস্কৃত ভাষার বহু বৌদ্ধ গ্রন্থ অনুবাদিত হলেও, তাঁদের অনেকগুলোতেই অস্পষ্টতা ও ভুল ছিল। সেই সমস্যাগুলো

২১ ঘণ্টা আগে