বিজ্ঞান-প্রযুক্তি
যেভাবে পাওয়া গিয়েছিল তুতানখামেনের মমি
পিরামিডের কারণেই মূলত মিশরীয় সভ্যতার প্রতি এত আগ্রহ মানুষের। তবে আরেকটা কারণও ছিল। পিরামিডের ভেতরের প্রচুর ধনরত্ন পাওয়ার আশা। মিশরীয় মনে করত, মৃত্যুর পর শরীর অসাড় হলেও আদতে মানুষের মৃত্যু হয় না। তাই মৃত্যুর পরের জীবন যাতে নির্বিঘ্নে কাটে, এজন্য প্রচুর খাবার-দাবার, অস্ত্র, পোশাক ও ধনস্পম্পত্তি কফিনের সঙ্গে সমাধিস্ত করা হতো। প্রতিটা সম্ভ্রান্ত মিশরীয় ধন-রত্ন জমাতেন মৃত্যুর পরের কফিনের সঙ্গে নেওয়ার জন্য। রাজাদের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ হতো বিপুল সোনা-দানা, দামি রত্ন, জহরৎ। আর এসব ধনরত্ন ভোগ করার জন্য যাতে দেহটা অক্ষত থাকে, এজন্য বিশেষ প্রক্রিয়ায় মৃতের লাশ মমি করা হতো।
এটাই ছিল দস্যু-ডাকাতদের জন্য পোয়াবারো। ফারওদের শাসনকালে এবং পরবর্তীতে দস্যুরাই প্রথম পিরামিডে ঢুকেছে, বেশিরভাগ ধনসম্পদ লুট করে নিয়ে গেছে। তাই প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময় বেশিরভাগ সমাধিতে মেলেনি কোনো ধন-রত্ন। কিন্তু গবেষকদের কাছে ধনরত্নের চেয়ে প্রাচীন ইতিহাসের মূল্য অনেক বেশি। তাই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে মাটি খুঁড়ে বের করে এনেছেন প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে একে একে যখন পিরামিডের ভেতরকার ইতিহাস বেরিয়ে এলো, জানা গেল মহাপরাক্রমশালী সব ফারাওদের ইতিহাস, তখন গবেষকেরা মনে করেছিলেন, নতুন কিছু আর বাকি নেই। কিন্তু পিরামিডই যে শেষ কথা নয়, তা বুঝেছিলেন গোটা কয়েক গবেষক।
১৮৯১ সাল। এক তরুণ প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক হাওয়ার্ড কার্টার মিশরে আসেন গবেষণা করার জন্য। থিওডোর ডেভিস নামের আরেক প্রত্নতত্ত্ববিদ তাকে এই কাজে নিযুক্ত করেন। বিশেষ করে মিশরীয় স্থাপন্য যেসব শিল্পকর্ম আছে, সেগুলো ভীষণভাবে আকর্ষণ করে কার্টারকে। রানি হাতসেপসুতের মন্দিরের দেয়ালে প্রচুর শিল্প কর্ম ছিল। কার্টার সেগুলোর প্রতিলিপি তৈরি করেন। এজন্য তিনি একটানা ছয়বছর কাজ করেন।
শুধু পিরামিড নয় ফারাওদের সমাধি আছে কিংস ভ্যালিতে পাহাড়ের নিচে। কার্টারের আগে বহু গবেষক এই কিংস ভ্যালি চষে ফেলেছেন। কিন্তু কিস্যু মেলেনি। আসলে তারা খুঁজিছিলে ফারাওদের ধন-রত্ন। চল্লিশ জন ফারওয়ের সমাধির সন্ধান মেলে। কিন্তু কোনো ধনরত্নের খোঁজ মেলেনি। বহু আগেই হয়তো দস্যুর দল ওইসব সমাধিতে ঢুকে ধন-রত্ন সরিয়ে ফেলেছে। স্বাভাবিকভাবেই এর পেছনে যারা অর্থলগ্নি করছেন, তারা হতাশ পড়েন। প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার খনন কাজ। এই অবস্থায় শংকায় পড়ে যান কার্টার। তার একমাত্র আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেলে যে না খেয়ে মরতে হবে!
১৯০৩ সাল। এক গাড়ি দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হন ব্রিটিশ ধনকুবের লর্ড কার্নাভান। কিছুটা সেরে উঠতেই বায়ু পরিবর্তনের জন্য যান পিরামিডের দেশ মিশরে। সেখানে তখন প্রত্মতাত্ত্বিক খননকাজের মহাযজ্ঞ চলছে। গবেষকেরা চষে ফেলছেন কিংস ভ্যালি। এই ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনিও। জানতে পারেন থিওডর ডেভিসের খননকাজের কথাও।
অগাধ সম্পদ কার্নাভানের ছিল। তাই নতুন করে মিশরীয় সম্পদের প্রতি তার কোনো আগ্রহ ছিল না। কিন্তু খ্যাতির লোভ, ইতিহাসের অংশ হওয়ার লোভ কার না থাকে? সেই আগ্রহ থেকেই তিনিও মিসরীয় প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ইতিহাসের অংশ হতে চান।
মিসর সরকারের ওপর মহলের সঙ্গে কার্নাভানের যোগাযোগ ছিল। তাদের জানান, নিজের আগ্রহের কথা। হাওয়ার্ড কার্টারের সঙ্গে তারাই পরিচয় করিয়ে দেন কার্নাভানকে।
কার্টার হিয়ারোগ্লিফিক লিপি পড়তে পারতেন। সবাই যখন ধরে নিয়েছে কিংস ভ্যালিতে আবিষ্কারের আর কিছুই নেই, কার্টার তখনো নিশ্চিত একটা সমাধির সন্ধান এখনো মেলেনি। সেই সমাধিটা তুতেনখামেনের। তুতেনখামেনের নামটা তিনি পেয়েছেন বেশ কয়েকটি হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে। বালক রাজা তুতানখামেন। নয় বছর বয়সে প্রাচীন মিশরের ফারাও হন। মারা যান আঠার বছর বয়সে। তার মৃত্যু নিয়ে সাড়ে তিন হাজার পরে এসেও ধোয়াশা কাটেনি। বিশেষজ্ঞরা দুটি মতে বিভক্ত। কেউ কেউ মনে মনে করেন তাকে হত্যা করা হয়েছিল। কেউ কেউ মনে করেন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রন্ত হয়ে মারা যান। তার মৃত্যুরহস্যের মতো, তাঁর সমাধিক্ষেত্র আবিষ্কারটাও ছিল বিস্ময়কর।
এত এত সমাধি আবিষ্কারের পরও কেন তুতানখামেনের সমাধির আবিষ্কার হয়নি?
ব্যাপারটা ভাবায় কার্টারকে। তিনি অনুমান করেন, অত সহজে তার সমাধি যখন মেলেনি হয়তো দস্যুর দলও সেটা খুঁজে পায়নি। তাই সেটার সন্ধান যদি পাওয়া যায়, তাহলে হয়তো পাওয়া যাবে প্রচুর ধন-রত্নও।
কার্নাভানের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯১৭ সালে কিংস ভ্যালিতে আবার খননকাজ শুরু করেন। কিন্তু টানা পাঁচ বছর খোঁড়াখুঁড়ি করলেন কার্টার। কাজের কাজ হলো না, পাওয়া গেল না তুতেনখামেনের মমি। হতাশা গ্রাস করল কার্টারকে, ওদিকে অধৈর্য হয়ে পড়লেন কার্নাভান। তিনি কার্টারকে বললেন, আর নয়, পাততড়ি গুটিয়ে যেন ফিরে আসেন কার্টার। এ কাজে পয়সা ঢালতে আর ইচ্ছুক নন কার্নাভান। কার্টার খাঁটি একজন প্রত্নতাত্ত্বিক। অন্য কোনো কাজে তার মন বসে না। এ পর্যায়ে এসে যদি কাজ থামাতে হয়, ব্যর্থদের খাতায় তার নাম উঠে যাবে। তাছাড়া অন্য আয়ও বন্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং তিনি কার্নাভানকে অনুরোধ করে আরও একটা বছর খননকাজ চালিয়ে যেতে রাজি করালেন।
এবার অবশ্য ফল মিলল, এক বছরের পুরোটা সময় লাগেনি। কয়েক দিনের মধ্যেই পাওয়া গেল সেই কাংখিত সমাধি। ১৯২২ সালের ৪ নভেম্বর। কার্টারের এক শ্রমিক একটা সিঁড়ির খোঁজ পেল। ছুটে গিয়ে খবর দিল কার্টারকে। তিনি দলের সবাইকে নিয়ে সেই জায়গাটা খনন শুরু করলেন। বড় বড় পাথর সরানোর পর সেখানে একটা দরজার সন্ধান পেলেন। দরজার রাজকীয় সিল আঁটা। কার্টারের বুঝতে বাকি রইল না, এতদিন ধরে যে সমাধিটাকে হন্যে হয়ে খুঁজছিলেন, অবশেষে সেই তুতেনখামেনের সমাধিটার দেখা মিলেছে!