top ad image
top ad image
home iconarrow iconফিচার

বিজ্ঞান

পাস্তুর ও জলাতঙ্কের টিকা

পাস্তুর ও জলাতঙ্কের টিকা
পাগলা নেকড়ের কামড়ে বালক লুই পাস্তুরের এক প্রতিবেশী মারা গিয়েছিলে

ফরাসী বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর তখন খুব ছোট। স্কুলে পড়েন। একদিন রাস্তায় একটা দৃশ্য তাঁকে নাড়া দিল। একটা পাগলা নেকড়ে হানা দিয়েছে লোকালয়ে। লোকজন সব পালাচ্ছে। তিনিও পালিয়ে বাঁচলেন। কিন্তু পরে জানতে পারলেন, এক প্রতিবেশীকে কামড় দিয়েছে সেই পাগলা নেকড়ে। লোকটা পরে জলাতঙ্গে আক্রান্ত হন। ভয়ংকর মৃত্যু হয় তাঁর।

এই মৃত্যু নাড়িয়ে দেয় বালক লুই পাস্তুরকে। বড় হয়ে তিনি যখন জীবাণু নিয়ে কাজ শুরু করেন, তখন জলাতঙ্কের টিকাও আবিষ্কার করেন। কিন্তু এই কাজটা সহজ ছিল না। কারণ, থকনো জীবাণু নিয়ে সাধারণ মানুষ এমনকী চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মধ্যেও ছিল অজ্ঞতা। পাস্তুর একে একে সেই অজ্ঞতা দূর করার চেষ্টা করেছেন। দেখিয়েছেন খাবার ওজিনিসপত্র পচে যাওয়ার পেছনে রয়েছে ব্যাকটেরিয়া। এদের হাত থেকে খাবার সুরিক্ষত করার জন্য আবিষ্কার করেছেন পাস্তুরায়ন পদ্ধতি। এমনকী কলেরা ও অ্যানথ্রাক্সের টিকাও আবিষ্কার করে ফেলেছেন।

এজন্য ব্যববহার করেছেন কাঁটা তোলার পদ্ধতি। অর্থাৎ কোনো রোগের জীবাণুকে দুর্বল করে, সেই জীবাণুকেই ব্যবহার হয়েছে টিকা হিসেবে। তাতে কাজও হয়েছে। কিন্তু পাস্তুর যে দুটো টিকা আবিষ্কার করেছেন, দুটোই পশুপাখিদের জন্য। কলেরার টিকা মুরগির জন্য। আর অ্যানথ্রাক্সের টিকা প্রয়োগ করা হয়েছিল গবাদিপশুদের ওপর।

এরপরই আসলে ছেলেবেলার সেই দুর্ভাগা লোকটার কথা মনে পড়ে যায় পাস্তুরের। যাকে পাগলা নেকড়ে কামড় দিয়েছিল। জলাতঙ্কে ধুকে ধুকে মরেছিল লোকটা। এবার এই রোগের টিকা আবিষ্কারের চ্যালেঞ্জ নিয়ে বসেন।

কারণ, এই রোগটা বড় ভয়াবহ। মানুষকে বড্ড কষ্ট দিয়ে মারে। জলাতঙ্ক রোগিরা মারা পড়ে পানির অভাবে। রোগীদের প্রচণ্ড পানি পিপাসা হয়। কিন্তু পানি দেখলেই শরীরে ভয় ধরে। আতঙ্কে ভোগে রোগী। পাাগলা কুকুরের মতোই আচরণ শুরু করে এ সময়। খিঁচুনি হয়। পানির জন্য বুক ফেটে যায়। কিন্তু সেই পানিই আর খেতে পারে না। শিগগির মারা পড়ে ভূক্তভোগী। মানুষকে এই ভয়াবহ মৃত্যের হাত থেকে বাঁচাতে চান পাস্তুর।

তখনো মানুষের ধারণা ছিল, জলাতঙ্ক হয় পাগলা কুকুর বা নেকড়ের বিষ থেকে। কিন্তু পাস্তুর ভাবলেন, এর পেছনেও নিশ্চয়ই জীবাণুর কারসাজি আছে। পাগলা কুকুরের মুখ থেকে লালা ঝরে। সেই লালা সংগ্রহ করলেন পাস্তুর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। ঝুঁকি, কারণ, পাগলা কুকুর সামনে যাকে পায়, তাকেই কামড়ে দেয়। এমনকী জড় পদার্থকেও কামড়ে ফালা ফালা করে ফলে কখনো কখেনা। পাস্তুর খুব সাবধানে লালা সংগ্রহ করেন। তারপর সেই সেই লালা পুশ করেন খরগোশের দেহে। খরগোশটিও এক সপ্তাহের মধ্যে জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়।

আগেই বলেছি, পাস্তুর কিন্তু বিষ সংগ্রহ করেননি, করেছিলেন কুকুরের লালা। লালাতে নিশ্চয়ই জলাতঙ্কের জীবাণু ছিল! তাই খরগোশও জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়েছে। যদি কুকুরের বিষ জলাতঙ্কের কারণ হতো, তাহলে লালাতে কিছু হত না খরগোশের। মাইক্রোস্কোপের নিচে জীবাণু দেখবেন সে উপায়ও ছিল না। কারণ, জলাতঙ্ক রোগের জন্য দায়ী র‌্যাবিজ ভাইরাস। আর এই ভাইরাস আকারে অনেক ছোট। এত ছোট জীবাণু দেখার মতো শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ তখন ছিল না। তাই অনুমান করেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো পাস্তুকে। কিন্তু শতভাগ প্রমাণ পেতে হলে করতে হবে পরীক্ষা। টিকা তৈরি করে জলাতঙ্কের হাত থেকে বাঁচাতে পারলেই কেবল প্রমাণ হবে তাঁর অনুমান ঠিক।

তার আগে জলাতঙ্কের জীবাণুকে দুর্বল করে টিকা বানালেন। সেই টিকা পুশ করলেন ৫০ টা কুকুরের ওপর। তারপর কুকরগুলোকে জলাতঙ্কে আক্রান্ত কুকুরের সঙ্গে মিশতে দেওয়া হলো। অথবা পাগলা কুকুরের লালা নিয়ে সংগ্রহ করে তাদের গায়ে পুশ করা হলো। একটা কুকুরও জলাতঙ্কে আক্রান্ত হলো না।

পাস্তুর আরও নিশ্চিত হলেন তাঁর টিকার ব্যাপারে। কিন্তু মানুষকে সুস্থ না করা পর্যন্ত শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই। তখন পাস্তুর নিজেই গিনিপিগ হওয়ার চিন্তা করলেন। শিগগির হয়তো নিজের শরীরেই পুশ করতেন জলাতঙ্কের টিকা। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো তাঁর।

জোসেফ মেইস্টার নামে এক নয় বছরের শিশুকে পাগলা কুকুর কামড়ে দিল। মেইস্টারের মা তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলেন। চিকৎসক জানালেন, এর কোনো চিকিৎসা তাঁর হাতে নেই। এর জলাতঙ্ক অবিসম্ভাবী। মৃত্যুও অনিবার্য।

মায়ের মন বলে কথা। সন্তানের মৃত্যু কে দেখতে চাই। চারপাাশে ছুটে বেড়াচ্ছেন। সে সময় জানতে পারলেন পাস্তুরের জলাতঙ্ক গবেষণার কথা। ছুটে গেলেন তাঁর কাছে। পাস্তুরও হাঁতে চাঁদ পেলেন যেন। মেইস্টারের শরীরে পুশ করলেন জলতঙ্কের টিকা। পর পর তেরদিন তেরোটা। টিকা কাজে এলো। জলাতঙ্ক আর ছুঁতে পারল না মেইস্টারকে। তারপরও পাস্তুর তিনমাস পর্যবেক্ষণে রাখলেন মেইস্টারকে। কিছুই হলো না। তখন চিকিৎসকের কাছে পাঠানো হলো ছেলেটাকে। চিকিৎসক মেইস্টারকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালেন, সে সম্পূর্ণ সুস্থ্।

১৮৮৫ সালের সেই দিনে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক নতুন মাইলফলক রচিত হলো সেদিন।

r1 ad
r1 ad