top ad image
top ad image
home iconarrow iconফিচার

গল্প

দুর্ঘটনা

দুর্ঘটনা
অলংকরণ: চ্যাটজিপিটি

বনেদি পরিবারের এমন অধ্বপতন নতুন কিছু নয়। তবে, এদের কাহিনী একটু উদ্ভট!

নতুন ওসি কন্সটেবলের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছে। উঠোনের এক কোণায় দাঁড়িয়ে তারা দুজন। বাকি তিনজন পুলিশ সদস্য পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে কথা বলছে নয়তো গ্রাম থেকে উঠে আসা উৎসুক জনতার ভিড় সামলানোর চেষ্টা করছে। ওসি হাসান বলেছিলেন একবার যে সবাই খেদিয়ে বিদায় করতে। কিন্তু কন্সটেবল মানা করলো। নতুন এসেই গ্রামবাসীদের ক্ষোভের পাত্রে পরিণত হওয়া ঠিক নয়। গ্রাম্য রাজনীতি জটিল। ওসির মানসিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শান্তির জন্য সেটা ভালো হবে না।

ওসি তেমন বিরোধ করেনি। এটা তার তৃতীয় পোস্টিং। কেরানীগঞ্জে। আগের দুই পোস্টিংয়ের অভিজ্ঞতায় হাসানের শিক্ষা হলো - অভিজ্ঞতায় অর্জিত বুদ্ধিমত্তা সর্বদাই আহরণ করা উচিৎ। কন্সটেবল বয়সে হাসানের চেয়ে কম করে হলেও সাত বছর বেশি। পুলিশি চাকরির অভিজ্ঞতায়ও হাসানের বেশ সিনিয়র কন্সটেবল রহিম। তাছাড়া, যে পরিবারের বাচ্চাটা নিঁখোজ, সেই পরিবারও এই গ্রামে প্রভাবশালী, যদিও অনেক কুখ্যাতি রয়েছে তাদের।

সাগর নামের সাত বছরের বাচ্চা ছেলে। গতকাল রাতে নিজ ঘরে মায়ের পাশে ঘুমাতে গিয়েছিলো। সকালে মা উঠে দেখে ছেলে তার পাশে শুয়ে নেই। প্রথমে মা ভেবেছিলো বাইরে খেলতে গিয়েছে সাগর। স্কুলের ছুটি চলছে। তবে, এক দুপূর প্রায় আড়াইটা। ছেলের কোনো খোঁজ নেই।

একান্নবর্তী হিন্দু-পরিবার সাগররা। তার বাবা বাড়ীর বড় ছেলে, এখন আর বেঁচে নেই। বাকি তিন চাচাদের দুই তিনজন করে ছেলেমেয়ে। সাগরের জন্ম একটু দেরিতে হয়। তাই চাচাদের কয়েক সন্তান সাগরের চেয়ে বয়সে দুই তিন বছরের বড়। তবে সবাই একসঙ্গেই খেলাধূলা করে। ঠাকুর পরিবার তারা। তাই গ্রামের সবার সঙ্গে মেলামেশার ক্ষেত্রেও কিছু বিধি-নিষেধ রয়েছে। গ্রামের এই এলাকাটা হিন্দুপ্রধান এলাকা।

বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে, বয়সে ছোট যারা তারা পরিবারের মধ্যে বিদ্যমান চাপা উত্তেজনা আর ভয়ে যেন কাবু হয়ে গিয়েছে। তার সঙ্গে বাসার উঠোনে পুলিশ, গ্রামের এতো লোকের সমাগমও তাদের ভয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই কয়েকজন কাঁদছে আর কয়েকজন তাদের মা-বাবাকে আঁকড়ে ধরে বসে রয়েছে। একটু বয়সে বড়দের প্রশ্ন করে তেমন কিছু জানা যায়নি। তবে, তাদের মধ্যেও ভয়ের রেখা পরিষ্কার।

গ্রামের মানুষের উৎসুক হওয়ার কারণ বুঝতে চাইলে রহিম বললো, স্যার, এরা একসময় এই এলাকার জমিদার ছিলো। এখনো অনেক জমির মালিক। কিছু বর্গা দেয়, কিছু দখলদারিত্ব নিয়ে মামলায় আটকে রয়েছে। গ্রামের একমাত্র ঠাকুর পরিবার। পুজো-অর্চনায় তাদেরই নেতৃত্ব দিতে হয়। ধর্মীয় প্রতিপত্তি, রাজনৈতিক প্রভাবও এনে দিয়েছে। আর জমিদারির ইতিহাসের ক্রূর স্মৃতি যেমন পরিবারের প্রতি ক্ষোভ সৃষ্টি করে, তেমনি ধর্মীয় প্রভাব সহমর্মিতা ও সহোদরের সংখ্যাও বাড়িয়ে দেয়। জমি নিয়ে ঝামেলা তো রয়েছেই। তাই পরিবারের যত বন্ধু, ততই শত্রু। গ্রামের কয়েকজনকে আবার উভয় তালিকাভুক্তই করা যায়। আবার এই বাড়ি নিয়েও কুৎসা, কুসংস্কার, প্রেতাত্মা ইত্যাদি গল্পের কোনো কমতি নেই।”

বিষয়টা সম্বন্ধে হাসান আগেও শুনেছে। গ্রামের মধ্যে এই যুগেও এসব গল্প কুসংস্কার প্রচলিত জেনে হাসান যেমন অবাক, তেমনি মুগ্ধ। তবে, সেগুলো নিয়ে আপাতত মাথা ঘামাতে চায় না হাসান। বাচ্চাটাকে খুঁজে বের করতে হবে। ঘরের বাইরে শত্রু আছে পরিবারের। তবে, ঘরের ভেতর থেকে কিছু হয়েছে কিনা সেটা এখনো সুরাহা বা সন্দেহ তালিকা থেকে বাদ দেয়া যাচ্ছে না। আসলে বলতে গেলে সাগর কি আদৌ হারিয়েছে, অপহরণ হয়েছে, নাকি দূর্ঘটনার শিকার, নাকি নিছক খেলাচ্ছলে লুকিয়ে আছে কোথাও - কোনোটাই বলা যাচ্ছে না। উপজেলা চেয়ারম্যানের জোর নির্দেশ, এখনই গিয়ে বিষয়টা দেখতে হবে। তাই ওসি তার দল নিয়ে এখানে। এতেই পরিষ্কার যে সাগরের পরিবার কতটা প্রভাবশালী এই এলাকায়।

উপজেলা চেয়ারম্যানকে ফোন দিয়ে তার দলের দশজনকে সাগরদের ঠাকুরবাড়ীতে পাঠাতে অনুরোধ করলো হাসান। গ্রামের সবদিকে খোঁজ নিতে হবে। অপহরণের বা সেরকম কিছু হলে হয়তো উপজেলা চেয়ারম্যানকেও সন্দেহের তালিকায় নিতে হবে। গ্রাম্য রাজনীতি। বলা যায় না কিছুই।

***

রাত হতে চললো। সাগরের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। গ্রামের প্রায় সব জায়গায়ই চেয়ারম্যানের লোক আর পুলিশ মিলে খোঁজ করেছে। পরিবারের পুরুষ সদস্যরাও, এমনকি গ্রামেরও অনেকে খোঁজ করেছে। মাইকিং থেকে শুরু করে সবই চেষ্টা করা হয়েছে। এলাকায় মসজিদেও ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু কোনো ফল পাওয়া যায়নি। হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সমস্যা বলেও কিছু নেই এই এলাকায়। সেটা এক বিশাল স্বস্তি হাসানের জন্য।

খোঁজে কোনো সমাধান না পেয়ে হাসান আবার ঠাকুরবাড়িতে এসে হাজির হলো। সাগরকে নিয়ে তার কেন জানি দুশ্চিন্তা হচ্ছে। মনের মধ্যে কিছু একটা খটকা লাগছে হাসানের। কিন্তু, কেন, কি নিয়ে, সেটা ঠিক ধরতে পারছে না হাসান। ফোন দিয়ে কন্সটেবলকে সাধারণ পোশাকে ঠাকুরবাড়িতে আসতে নির্দেশ দিলো হাসান। নিজেও তাই করেছে। একটু নিরিবিলি ও ঠান্ডা মাথায় পরিবারের সবার সঙ্গে কথা বলতে চায় সে। বিশেষ করে সাগরের মায়ের সঙ্গে। প্রৌঢ় বয়স্ক মহিলা। সাত বছরের বাচ্চার মা শুনলে বুঝতে হয়, সন্তানভাগ্য বিয়ের অনেকদিন পরে হয়েছে।

সাগরের মায়ের সঙ্গে তার পরিবারের অন্যান্য কয়েকজনও হাসানের সামনে এসে উপস্থিত। হাসানের কেন জানি বিষয়টা একটু খটকা লাগলো। দিনের বেলা প্রায় সকলের সঙ্গে হাসান একাই কথা বলার সুযোগ পেয়েছে। কেবল বাচ্চাদের সঙ্গে আলাপকালে বয়স্ক কেউ সঙ্গে ছিলো। বিষয়টা কি কেবলই সাগরের মায়ের মানসিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নাকি, তার সঙ্গে হাসানকে একা কথা বলতে দিতে চায় না তারা? প্রশ্নটা যৌক্তিক, কিন্তু আদৌ এই পরিস্থিতিতে এর কোনো ভিত্তি আছে কিনা সেটা ধরতে পারছে না হাসান। রহিমের দিকে তাকাতে চোখাচোখি হলো তাদের। রহিমও যে একই কথা চিন্তা করছে পরিষ্কার। সিগারেট খাওয়ার ভান করে একটু দূরে সরে আসলো হাসান রহিমকে নিয়ে। সাগরের মা ও অন্যান্যদের একটু অপেক্ষা করতে অনুরোধ করলো। রহিমকে সিগারেট ধরানোর কথা বলে, নিজের সিগারেটে আগুন দিলো হাসান। সঙ্গে রহিমের দিকেই জ¦লন্ত লাইটার এগিয়ে দিলো। রহিম বিগলিত ভঙ্গিতে সিগারেট ধরালো। ধোঁয়া ছাড়তেই রহিম বললো, স্যার, আমার কিন্তু বিষয়টা ভালো লাগছে না। দিনের বেলাতেও পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমার কেন জানি খটকা লাগলো। বয়স্কদের ঠিক অতটা বিচলিত মনে হয় নাই। আর বাচ্চাদের...

কথাটা শেষ করার আগে সিগারেটে আরেকটা টান দিলো রহিম। হাসান উৎসুক হয়ে বলল, বাচ্চাদের কি?

আমার চার বাচ্চা স্যার। নানাও হয়েছি, দাদাও হয়েছি। বাচ্চারা কিছু লুকালে যেমন মনে হয়, তেমনই মনে হয়েছিলো আমার। তবে, তখন পরিস্থিতি...ভিড়ভাট্টা, মায়ের, বাচ্চাদের কান্না, চিল্লাচিল্লিতে বিষয়টা তখন অতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। কিন্তু...

কিন্তু, পরে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে কি যেন একটা খটকার মতো মনে লেগেছে, হাসান যেন রহিমের বাক্য শেষ করলো। শুনে জোরে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সিগারেটে আরেকটা টান দিলো রহিম। রহিমের কথা বলার ভঙ্গী, স্পষ্টতা, পরিষ্কার চিন্তাভাবনা ও সেটা প্রকাশের দক্ষতা মুগ্ধ করলো তাকে।

হাসান তার চারপাশে নজর বুলিয়ে দেখলো। দিনের বেলা তেমন মনোযোগ দেয়ার সুযোগ হয়নি তার। তবে, ঠাকুর বাড়ি এক কথায় বিশাল। মাঝখানে প্রায় দুটি টেনিস কোর্টের সমান উঠান। তার চারদিকে সাত-আটটি দুই তলা দালান। কয়েকটি কাঠের তৈরি, কয়েকটি কাঠ ও কংক্রিটের। কংক্রিটে পুরোনো আমলের স্থাপত্যের ছাপ পরিষ্কার। পুরো বাড়িটা কি তল্লাশি হয়েছিলো? প্রশ্নটা হঠাৎ মাথায় আসতে ঝট করে রহিমের দিকে তাকালো হাসান। তার তাকাতেই রহিম বললো, পুরো বাড়ি খোঁজা হয়েছে স্যার। পাওয়া যায়নি।

হাসান রহিমকে বললো, বাচ্চাদের সঙ্গে আপনি আবার কথা বলেন। আমি মায়ের সঙ্গে কথা বলি।

বলেই হাসান ঘুরে পরিবারের সদস্যদের দিকে এগিয়ে গেলেন। সাগরের মা ফুঁপিয়েই চলেছে। তাকে জড়িয়ে রয়েছে আরেক মহিলা। তার কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে মহিলাটি। একমাত্র সন্তানকে খূঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার মনের অবস্থা এখন কি সেটা হাসান কল্পনাও করতে পারেনা। তবে, হাসান খেয়াল করলো, পরিবারের বাকিদের চেহারায় তেমন কোনো শোকের ছায়া নেই। কেমন যেন নির্লিপ্ত, স্নায়ু টান টান একটা চাহনি চোখে। বিষয়টা হয়তো হাসান খেয়ালই করতো না। যে মহিলার কাঁধে সাগরের মা হেলে বসে আছে তার চাহনি চেহারা আর বাকিদেরটা এতোটাই পার্থক্য যে সেটা চোখে পড়ে যায় হাসানের। সে একটু কঠিন গলায় সাগরের মা ও সেই মহিলার দিকে ইশারা করে বললো, আপনারা দুজন বাদে বাকিরা ভিতরে যান। আমি পরে ডাকবো আপনাদের।” তার এই কথাটা মনে হয় বিচলিত করলো পরিবারের সবাইকে। পরিবারের এক পুরুষ সদস্য, মেজো ছেলে মনে হয়, বিরোধ করতে নিলে, বয়স্ক মহিলা রীতিমতো বকা দিয়ে থামালো তাকে। এই মহিলার কাঁধেই সাগরের মা হেলে বসে রয়েছেন।

বোঝা গেলো পরিবারের গুরুজন তিনি। পোশাক দেখে যদিও সেটা বোঝার উপায় নেই। তবে, তার কথার পিঠে কথা বললো না আর কেউ। সবাই সরে গেলে হাসান একটা প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে সাগরের মা ও সেই বৃদ্ধ মহিলার একটু কাছে এসে বসলো। তারা মাটিতেই বসে রয়েছেন। একটু নড়ে চড়ে বসলো দুজনেই। হাসান জিজ্ঞেস করলো, আপনার কি মনে হয়, সাগর কোথায় গিয়েছে? কথাটা বলতেই সাগরের মায়ের ফূঁপিয়ে উঠার বেগ বৃদ্ধি পেলো যেন। কিন্তু বৃদ্ধা তার মাথায় আলতো হাত রাখতেই নিজেকে সামলিয়ে নিলেন ভদ্রমহিলা।

**

পরিবারের মধ্যে সমস্যা অনেক। বৃদ্ধা সাগরের দাদি। দাদা মারা গিয়েছেন। তার পর বড় ছেলে, অর্থাৎ সাগরের বাবাই বাড়ির কর্তা। বেশ অনেক বছর সন্তানহীন ছিলেন। কিন্তু সাগরের প্রথম জন্মদিনের আগেই এক দূর্ঘটনায় মারা যান তিনি। দূর্ঘটনার কোনো সঠিক সুরাহা হয়নি। হত্যার আশঙ্কা এখনো সাগরের মা ও দাদির মনে রয়েছে। বিষয়টা যে বিষয়সম্পত্তি সম্পর্কিত তা পরিষ্কার।

মা বৃদ্ধ। হিন্দু সম্প্রদায়। মহিলা মানুষের খুব বেশি কিছু করারও সুযোগ নেই। কিন্তু পরিবারের মধ্যে সাগরের মা ও বৃদ্ধার মধ্যে যে সম্পর্ক, অন্যান্যদের সঙ্গে বৃদ্ধার সেই সম্পর্ক যে নেই তা বৃদ্ধা পরিস্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন। বাকি তিন ছেলেই নয়, তিনজনেরই স্ত্রী ও সন্তানদের সমালোচনার কোনো অভাব নেই বৃদ্ধার। সাগরের মা তাকে যতই না করলো এগুলো বলতে, মহিলা ততই আরো জোর দিয়ে কথাগুলো বলে গেলো। হাসান বুঝলো পারিবারিক কোন্দলের বিষয়টা তার আগেই আঁচ করা উচিত ছিলো।

হাসান উঠে গিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরালেন। উঠোনে সীমানায় এক কাঁচাপাকা দালান থেকে রহিম হন্তদন্ত করে বেরিয়ে এলো। কিছু একটা পেয়েছে বলেই মনে হলো হাসানের। সিগারেট ধরানোর কথা ভুলে গেলো হাসান। রহিম কাছে আসতেই বললো, স্যার, একটা ঘর চেক করা হয়নি।

হাসান ভ্রু কুঁচকাতেই রহিম বললো, ঘরটা বলতে গেলে গুপ্ত একটা ঘর। তালা দেয়া থাকে। বাচ্চাদের একজন বললো বিষয়টা। সেটা নাকি তাদের দাদার ঘর। দাদির ঘরের সঙ্গেই সেটা। দাদির ঘর, সাগরের মায়ের ঘর একই দালানে। ঐ একতলাটায়।’ কথাটা বলে রহিম উঠোনের এক কোণে ইশারা করলো। হাসান খেয়াল করলো কোণায় যে ঘরটাকে সে রান্নাঘর হিসেবে ভুল করেছিলো সেটা আসলে দাদির ও সাগরের ঘর। তাহলে রান্না হয় কোথায়? প্রশ্নটা হাসানের মাথায় আসতেই সেটা ঝেড়ে ফেলে দিলো। সেটা আপাতত গুরুত্বহীণ।

রহিম বললো, ঐ গুপ্তঘরটা নাকি মাটির নিচে।” কথাটা শুনে হাসানও অবাক। আন্ডারগ্রাউন্ড ঘরও আছে এখানে। রহিম বলে গেলো, ঘরটা নিয়ে পরিবারের, মানে বাচ্চাদের মনে আতঙ্কের ও কুসংস্কারের কোনো শেষ নেই। আন্ডাবাচ্চাগুলো বললো যে সেখানে নাকি তাদের দাদুর ভূত থাকে। দাদি আর সাগরের মা ছাড়া ঐ ভূত আর কাউকে পছন্দ করে না। সবাই দাদুর ভুত ভয় পায়।”

‘‘সাগরও?” হাসানের মুখ থেকে ফট করে প্রশ্নটা বেরিয়ে গেলো, অতর্কিতেই। রহিম প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে হাসান বললো ঐ বাচ্চাদের একজনকে দাদি ও সাগরের মায়ের সামনে এনে হাজির করতে। সবচেয়ে বেশি যাকে ভীত মন হয়েছে, তাকেই নিয়ে আসার কথা বললো হাসান।

**

পুতুল সোনা, বল তো ঠিক করে।” দাদির আদুরে গলা শুনে কিছুটা আশ^স্ত বোধ করলো বৃদ্ধার সেজো ছেলের তৃতীয় সন্তান। বয়স চার। হাসান লক্ষ্য করলো সাগর সম্বন্ধে বৃদ্ধার যত দরদ, ততটা অন্য কারো জন্য না থাকলেও, শিশুদের প্রতি তার তেমন কোনো বিদ্বেষ নেই। বয়সে একটু বড় যারা সেসব নাতিনাতনিদের নিয়ে তার যত ক্ষোভ। আর হবেই বা না কেন। তারা যে পরিবারের বড়দের কানপড়ায় হিংসুটে ও সম্পত্তির ভাগাভাগির বিষয়টা সম্বন্ধে কিশোর বয়সেই সচেতন, বিষয়টা দাদির একেবারেই পছন্দ নয়।

হাসানেরও মনে হলো, বয়স্কদের মনে তিক্ত শিশুদের মনে প্রতিস্থাপিত করার মতো খারাপ কাজ অবশ্যই ঘৃণ্য। তবে, এখন সেটা সবাই করে মনে হয়। বিষয়টা কেবল গ্রামের রক্ষণশীল সমাজে কিংবা পুরোনো আমলের কোনো বিষয় তা নয়। এটা আধুনিক সমাজ ও শহরেও প্রচলিত। শিশুদের মনে পরিবারের পক্ষ থেকেই অন্যদের জন্য তিক্ততা, হিংসা, বিদ্বেষ অনেকটা সচেতনভাবেই ভরে দেয়া হয়।

পুতুল দাদির কোলে উঠে বসলো। পুতুলের বাবা-মা দাদির ঘরের দরজায়ই দাঁড়িয়ে। তাদেরকে কথা না বলতে কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছেন দাদি। হাসানও সুর মিলিয়েছে। তাই তারা উদ্বিগ্ন হয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে। পুতুলকে প্রশ্নটা আবার করায়, বাচ্চা মেয়েটা ভয়মিশ্রিত কন্ঠে বললো, ”দিদা, আমি বললে যে দাদুর ভুতছড়ি আমাকে মারবে।” কথাটা শুনে ঘরের কেউই কিছু বুঝলো না। কিন্তু দাদি বিষয়টা পুতুলকে বুঝতে না দিয়ে বললেন, দাদুর ভুতছড়ি কোথায় তুই জানিস?’

পুতুল বললো, ”ওই যে তোমার গুপ্তধনের ঘরে।” হাসান আর রহিম পরস্পরের দিকে তাকালো। কিছুই বুঝতে পারছে না তারা। কিন্তু ধৈর্য্যহারা হলে হবে না। দাদিকে আলোচনা চালিয়ে যেতে দিতে হবে। দাদি একবার আড়চোখে হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ”পুতুল সোনা, দাদুর ভূতছড়ি তোকে কিছুই করবে না। আমি আছি না। আমি থাকতে তোর দাদু কি, তোর দাদুর ভুতেরও সাহস নেই কিছু করার।”

আমরা জানি দিদা। তাই তো তুমি থাকলেই আমরা এই ঘরে ঢুকি। তুমি না থাকলে ভয় লাগে আমাদের।” পুতুল কিছুটা সহজ হয়ে বললো কথাটা। তার ভয় ধীরে ধীরে ভাঙছে। পুতুল হঠাৎ করে বললো, এজন্যই তো দাদারা সাগরদাকে সাহস দেখাতে দাদুর ছড়ি নিতে বলেছিলো।” কথাটা শুনেই হাসান আর রহিমের টনক নড়লো। কোনো একটা ক্লু মনে হয় চোখের সামনে ভেসে উঠছে এখন।

**

সাগরের মা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে যেন। দাদিও বুক চাপড়ে কাঁদছে। বাড়ীর পাঁচ কিশোর - মেজো ও সেজো চাচার তিন ছেলে ও দুই মেয়ে - তাদের মনের অবস্থা অনেকটাই জটিল। তাদের কারণেই সাগরের এই পরিণতি। কিন্তু বিষয়টা যে এতোটা দূর গড়াবে ভাবতে পারেনি তারা। ভয়, শোক, আতঙ্ক - সবমিলিয়ে হাতপা শীতল হয়ে কাঠ হয়ে বসে রয়েছে তারা। শিশুরা কিছু বুঝতে পারছে না যে কেন দাদি আর সাগরের মায়ের এরকম পরিস্থিতি। তারা তাদের মায়ের কোলে উঠে স্তব্ধ হয়ে আছে। পুতুল মেয়েটাই কোনো কারণে তার কান্না থামাতে পারছে না। সে বুঝতে পারছে বড় কোনো দূর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে বাসায়।

ঠাকুর বাড়ির পিছনেই ঘন ঝোপঝাড়। প্রায় ক্ষুদ্র একটা জঙ্গলই বলা চলে। সেই জঙ্গলের মাঝখানে খালি একটা জায়গা। সেখানেই গ্রামের শ্মশান। ঠাকুরবাড়ির জমির ওপরই শ্মশানটা। অনুমতি ছাড়া সেদিকে কেউ যায় না। সাগর যে সেদিকে যাবে সেটা কেউ চিন্তাও করেনি। দিনের বেলা সেদিকটা খোঁজা হয়েছিলো কিনা হাসান জানতে চাইলে বোঝা গেলো, কিশোর কিশোরিরাই সাগরকে খোঁজার কথা বলে শ্মশানে সে নেই বলে ঘোষণা দেয়। আসলে তারা নিজেরাও সেদিকটায় আর যায়নি। ভয়েই যায়নি তারা, বোঝা গেলো।

সাগরের প্রতি হিংসেই ছিলো তাদের মনে। দাদির প্রিয় সে। দাদির ঘরের গুপ্তঘরে রাখা গুপ্তধন যে দাদি তাকেই দিয়ে দিবে, এমনটাই তাদের বিশ^াস। আর বাবা-মাদের মতে বাড়ির সয়সম্পত্তির অধিকাংশই সাগর আর তার নামেই যাবে এমনটাই বিশ^াস তাদের। তাই বিষয়টা সাগরের প্রতি বাচ্চাদের মনে আরো বিদ্বেষ তৈরি করে।

তারা সবাই একসঙ্গেই খেলা করে, গল্প করে, মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু সবকিছুতেই সাগরের প্রতি কিঞ্চিৎ বিদ্বেষ তাদের আচরণে বদ্ধমূল হয়ে যায়। তাই সাগরকে তারা সবসময়ই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবেই দেখতো। গতরাতেও তাই হয়। স্কুল ছুটি। রাতে উঠোনে বসেই গল্প করছিলো তারা। কার শ্মশানে এই রাতের বেলা যাওয়ার সাহস আছে না নেই ইত্যাদি নিয়ে ছেলেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মতো শুরু হয়। বাকিরা সাগরকে তার সাহস প্রমাণের জন্য তার দাদার হাঁটার ছড়ি নিয়ে রাতের অন্ধকারে শ্মশানে গেঁথে দিয়ে আসার কথা বলে। ভাইদের সম্মান পাওয়ার জন্য একসময় সাগর রাজিও হয়ে যায়।

রহিমের একনাগাড়ে কথা বলায় হাত তুলে বাধা দিলো হাসান। জিজ্ঞেস করলো, এই হাতছড়ির কাহিনী কি?

বাচ্চাদের ভুতুড়ে কুসংস্কার স্যার। দাদার সেই গুপ্তঘর নিয়ে তো রহস্য-রটনার কোনো শেষ নেই। বাচ্চাদের কল্পনা সেটাকে আরো অতিরঞ্জিত করে। তাদের বিশ^াস, দাদি সামনে না থাকলে এ ঘরে ঢুকার চেষ্টা করলে, কিংবা দাদির সঙ্গে কোনো দুর্ব্যবহার করলে তাদের দাদার সেই ভুতুড়ে ছড়ি তেড়ে এসে বাচ্চাদের পিটাবে, বা কোনো অনিষ্ট করবে।” হাসান কথাটা শুনে আলতো করে মাথা ঝাঁকালো।

**

সাত বছরের পুরুষ শিশু সাগরের মৃত্যু হয় হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে। শারীরিকভাবে তার আগে থেকে হৃৎযন্ত্রের কোনো সমস্যা ছিলো না বলেই অস্ত্রোপচারে জানা যায়। তার মাও বিষয়টা নিশ্চিত করে। পরিবারের কিশোর-কিশোরীদের খেলাচ্ছলে সাগরের দাদার একটি পুরোনো হাতছড়ি শ্মশানে গেঁথে দিয়ে আসার প্রতিযোগিতা লাগে তাদের মধ্যে। সাগরের কাজ ছিলো রাতের অন্ধকারে তার দাদার গুপ্তঘর থেকে সেই হাতছড়ি তুলে নিয়ে শ্মশানে গেঁথে দিয়ে আসা। কুসংস্কার, ভূতুড়ে কল্পনা, রাতের অন্ধকার, প্রতিযোগিতার উত্তেজনা এবং শিশু মনের কল্পনার অতিরঞ্জন - এসবই সাগরের স্নায়বিক পরিস্থিতির ওপর চাপের সৃষ্টি করে। সাগর রাতের অন্ধকারে তার দাদার কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছড়ি গুপ্তঘর থেকে নিয়ে সবার অগোচরে শ্মশানে নিয়ে যায়। বাসার কিশোর-কিশোরিরা তার এই যাওয়াটা সাক্ষ্য করলেও কেউই তার পিছু পিছু শ্মশান পর্যন্ত যায়নি। হয়তো ভয়েই যায়নি। সাগর সফলভাবেই তার দাদার সেই ছড়ি শ্মশান পর্যন্ত নিয়ে শ্মাশানের মাটিতে গেঁথে দেয়। কিন্তু পরক্ষণেই তার হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। ভয়ে। তার লাশ মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলো, আর তার ধুতি ছড়ির সঙ্গে আটকে মাটিতে গেঁথে যায়। বিষয়টা রাতের অন্ধকারে খেয়াল করেনি সাগর। গেঁথেই সেখান থেকে দৌড়ে পালানোর সময় তার ধুতিতে টান পড়ে গেঁথে যাওয়া অংশটির কারণে। পরিস্থিতি দেখে মনে হয়েছে যে বিষয়টা সাগরের মনে এতটাই আতঙ্কের সৃষ্টি করে যে ভয়ে তার হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। শিশুমনে ভুতের একটা ভয় আগে থেকেই ছিলো। রাতের অন্ধকারে তার ধুতি আটকে যাওয়াকে সে হয়তো কোনো অশরীরী স্বত্তার কান্ড মনে করে। যার ফলে সে ভয় পেয়ে মারা যায়। তার মৃত্যু শিশু-কিশোরদের খেলা ও কল্পনা কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতির এক অনাকাঙ্খিত দূর্ঘটনা হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায়।

পুলিশ প্রতিবেদন লেখা শেষ করলো হাসান। কিন্তু শেষের বাক্যটা লিখে মনের ভিতরের খচখচানি কেন জানি বেড়ে গেলো তার।

r1 ad
top ad image