top ad image
top ad image
home iconarrow iconফিচার

শিল্প-সাহিত্য

ডাকঘরের কথা

ডাকঘরের কথা
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের ভারতবর্ষের একটি ডাকঘর

সন্দেশের ধাঁধার উত্তরের চিঠিগুলি সেদিন দেখছিলাম। কেউ আধ মাইল দূর থেকে লিখেছে চিঠি, কেউ লিখেছে ১৫০০ মাইল দূর থেকে—কিন্তু ১ পয়সার পোস্টকার্ডে প্রায় সকলেই লিখেছে। ১ পয়সা খরচে ১৫০০ মাইল চিঠি পাঠান, এই কম সস্তা হল? হঠাৎ মনে হতে পারে অত কম মাশুলে এতদূর চিঠি পাঠাতে ডাকঘরের বুঝি লোকসান হয়; কিন্তু তারা কি ২/১ খানা চিঠি পাঠায়? প্রতিদিন লাখে লাখে চিঠি আর পার্সেল তারা পাঠায়; তাতেই তাদের খরচে পুষিয়ে যায়।

ডাকঘরের বন্দোবস্তই বা কি কম আশ্চর্যরকম! তুমি হয়ত কলকাতায় বসে একটা পোস্টকার্ডে চিঠি লিখে ডাকবাক্সে সেটাকে ফেলে দিলে। কিছুক্ষণ পরে ডাকঘরের লোক এসে ডাকবাক্সের চাবি খুলে চিঠিগুলো ছাপ ডাকঘরে নিয়ে গেল। সেখানে অনেকগুলি লোকে মিলে চিঠির উপর ডাকঘরের ছাপ মারে, আর এক একটা থলিতে এক একটা রেলে পাঠাবার চিঠিগুলি ভরে ফেলে—যেমন দার্জিলিং মেলে দার্জিলিং, খরসান জলপাইগুড়ি, কুচবিহার, এইসব জায়গার চিঠি; পঞ্জাব মেলে বর্ধমান, মধুপুর, পাটনা, বাঁকিপুর, এলাহাবাদ, দিল্লী, এইসব জায়গার চিঠি। তারপর সব ছোট ডাকঘর থেকে বড় ডাকঘরে থলেগুলি পাঠিয়ে দেয়।

সেখান থেকে স্টেশনে চলে যায়। রেলের গাড়ির মধ্যে আবার ডাকঘরের বন্দোবস্ত আছে। সেখানে থলিগুলো খুলে প্রত্যেক জায়গাকার চিঠি আলাদা করে এক একটা খোপে ভরে রাখে। তারপর সব চিঠি বাছা হয়ে গেলে এক-এক জায়গার চিঠি এক একটা আলাদা থলিতে ভরে ফেলে। সেখানে যখন রেল পৌঁছায় তখন রেলের ডাকঘর থেকে সেই সেই জায়গার চিঠিগুলো নামিয়ে দেয়। তারপর আবার ডাকঘরে সেই থলি নিয়ে গিয়ে, তার থেকে চিঠি বের করে, বেছে, পিয়ন দিয়ে বাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এত হাঙ্গামার পরেও চিঠি যে ঠিকমত গিয়ে পৌঁছায় এই আশ্চর্য—ক্বচিৎ ডাকঘরের কোন লোকের দোষে হারাতে পারে। পৃথিবীর যে-কোন জায়গার একজন লোকের ঠিকানা খুঁজে বের করে তার ঠিকানায় একখানা চিঠি লিখে দাও; তারপর বাস্‌, তোমাকে আর ভাবতে হবে না—সেটা ঠিক সেই লোকের কাছে হাজির হবে।

সব সময়ই যে রেলে ডাক যায় তা নয়। রেলে যায়, জাহাজে যায়, ছোট স্টিমারে যায়, নৌকায় যায়, গাড়িতে যায়, মানুষের পিঠে যায়, কুকুরে-টানা গাড়িতে যায়—এমনকি এরোপ্লেনে করে আকাশ দিয়েও যায়। এমন জায়গাও ত আছে যেখানে ডাকঘর নেই। সেখানের ঠিকানাতে চিঠি লিখলেও চিঠি ঠিকই পৌঁছায়। তবে সেখানে চিঠি যেতে কিছু দেরি লাগে। ইউরোপে যেসব সৈন্য যুদ্ধ করছে তাদের কাছেও চিঠি যাবার উপায় আছে। সে যেখানেই থাকুক না কেন তার নাম আর তার সৈন্য দলের নাম, এইটুকু জানলেই লড়াইয়ের ডাকঘরোয়ালারা ঠিক তার কাছে চিঠি কিংবা পার্সেল পৌঁছে দেবে। আমাদের দেশে অনেক জায়গায় 'রানার'-এর ডাকের বন্দোবস্ত আছে। একজন লোক কাঁধে করে চিঠির থলি নিয়ে এক ডাকঘর থেকে অন্য ডাকঘরে পৌঁছে দেয়। হাজারিবাগে আগে ঐরকম বন্দোবস্ত ছিল। তখন অনেক 'রানার' বাঘের মুখে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে। অনেক সময় দুষ্টু লোকে নির্জন রাস্তায় পেয়ে 'রানার'কে মেরে চিঠিপত্র খুলে টাকাকড়ি নিয়ে চলে যায়।

প্রায় ৭০ বছর আগে কোন দেশে পোস্টকার্ড অথবা টিকিট ব্যবহারের নিয়ম ছিল না। তখন চিঠিপত্র পাঠাতে অত্যন্ত বেশি খরচ হত। ইংলন্ডের সার রোল্যান্ড হিল প্রথমে টিকিট ব্যবহারের প্রস্তাব করেন। সে সময়ে চিঠির মাসুল এত বেশি ছিল যে গরীব লোকের পক্ষে চিঠি পাওয়া মুশকিলের কথা ছিল। যার কাছে চিঠি যাবে তাকেই মাশুল দিতে হত; আর অনেক সময় মাশুল দিতে না পারায় অনেক গরীব লোককে দরকারি চিঠিও ফেরত দিতে হত। লন্ডন থেকে মাত্র ৪ মাইল দূরে একটা জায়গায় একটা চিঠি পাঠাতে ১৲ টাকারও বেশি খরচ হত। পার্লামেন্ট সভার সভ্যেরা বিনা পয়সায় চিঠি পাঠাতে পারতেন—চিঠির উপর তাঁর একটা নাম সই থাকলেই হল। তাঁরা অনেক সময় তাঁদের বন্ধুদের চিঠির উপরও সই করে দিতেন আর বন্ধুরা সব বিনা পয়সায় চিঠি পাঠাতেন। কেবল চিঠি নয়, অনেক বড় বড় জিনিসও তাঁরা ঐরকম সই করে বিনা পয়সায় পাঠাতেন। গরীব লোকেরই বড় মুশকিল হত। তারা নিরুপায় হয়ে শেষে নানারকম ফাঁকি দিতে আরম্ভ করল। একজন তার বোনকে বলল যে সে যখন তাকে চিঠি লিখবে তার উপরের ঠিকানার পাশে কতগুলি চিহ্ন থাকবে; সেই চিহ্ন দেখে বোঝা যাবে সে ভালো আছে কি অসুস্থ হয়েছে। বোনও সেইরকম চিহ্ন দিয়ে ভাইকে চিঠি লিখত। চিঠির ভিতরে কিন্তু কেবল সাদা কাগজ। চিঠি যখন পৌঁছাত তখন তার উপরের চিহ্নগুলি দেখে নিয়ে তারা চিঠিটা ফেরত দিত আর বলত,"অত মাশুল দিয়ে চিঠি নেবার ক্ষমতা আমার নেই।" এইরকম আরও কত উপায়ে লোকেরা ডাকঘরকে ঠকাত।

রোল্যান্ড হিল যখন টিকেট ব্যবহারের প্রস্তাব করেন তখন বিলাতের পার্লামেন্ট সভায় ভয়ানক আপত্তি হয়। কিন্তু অনেক খবরের কাগজওয়ালা তাঁর প্রস্তাবের সপক্ষে লেখেন আর সাধারণ লোকেও অনেক সভা সমিতি করে তাঁর হয়ে বলেন। রোল্যান্ড হিল ছেলেবেলায় গরীব লোক ছিলেন; তিনি গরীবের কষ্ট ভাল করে বুঝতেন আর তাদের জন্য খাটতেও সর্বদাই প্রস্তুত ছিলেন। তাঁর মনে ছিল, ছেলেবেলায় একদিন তাঁকে চিঠির মাশুল জোগাড় করার জন্য রাস্তায় ঘুরে ছেঁড়া কাপড় বিক্রি করতে হয়েছিল। তিনি চিঠি পাঠাবার খরচ সম্বন্ধে অনেক হিসাব করে বললেন, "চিঠি পাঠাবার খরচ অত্যন্ত সামান্য; বেশি খরচ ডাকঘরেরই হয়। আর অনেক চিঠি লোকে নেয় না বলে ডাকঘরের বিস্তর টাকা লোকসান হয়। বড় লোকেরা ত বিনা পয়সায়ই অনেক চিঠি পাঠান। এর চেয়ে ভাল বন্দোবস্ত হয় যদি নিয়ম করা যায় যে, চিঠি পাঠাবার আগে মাশুল দিতে হবে। আর মাশুল দেওয়া হয়েছে কিনা বুঝবার জন্য চিঠির উপর একটা টিকিট লাগিয়ে দিতে হবে। কত মাশুল দেওয়া হল তা টিকিটেই লেখা থাকবে।" অনেক আপত্তির পর পার্লামেন্ট একবার এ উপায়টা পরীক্ষা করতে রাজী হলেন। রোল্যান্ড হিলের উপরেই সব বন্দোবস্তের ভার পড়ল। কয়েক বৎসর পরীক্ষা করে দেখা গেল যে, এই ডাকটিকিটের বন্দোবস্ত এত সুবিধাজনক যে এর বিরুদ্ধে আর কোন আপত্তিই টেঁকে না। তখন থেকে বিলাতে টিকিটের চল আরম্ভ হল আর দেখতে দেখতে সমস্ত পৃথিবীময় টিকিটের ব্যবহার আরম্ভ হল। ডাকঘরের বন্দোবস্তও রোল্যান্ড হিলের বুদ্ধিতেই অনেকটা হয়েছে।

r1 ad
r1 ad