top ad image
top ad image
home iconarrow iconফিচার

ফেরিওয়ালা ও নিলামওয়ালা

ফেরিওয়ালা ও নিলামওয়ালা

ফেরিওয়ালা ও নিলামওয়ালা
চ্যাটজিপিটির চোখে ফেরিওয়ালা

বেশিদিন আগের কথা নয়, নব্বই দশকেও গ্রামবাংলার মানুষের দিন শুরু হতো ফেরিওয়ালার হাঁকডাকে, ভেঁপু বাঁশির আওয়াজে কিংবা ডুগডুগির তালে তালে। ফেরিওয়ালা আজও আছে, কিন্তু বদলেছে তাদের স্বরূপ, বদলেছে পণ্যের ধরন।

সাতসকালে আসে মিষ্টিওয়ালা, কেউ বা সন্দেশ, কেউ হাওয়াই মিঠাই, কেউ শনপাপড়ি, কেউ বা পাপড়ভাজা নিয়ে হাজির। কেউ হাঁক দিয়ে ফেরি করে, কেউ বাজায় টিনের বাঁশি, কারও হাতে ডুগডুগি।

ছেলেমেয়েরা ফেরিওয়ালার বাঁশি শুনে, হাঁক-ডাকে কিংবা ডুগডুগির আওয়াজে ঘর ছাড়ে। পিছু নেয়। কারও হাতে পয়সা আছে, কারও নেই। তবুও পিছু নেয়, অন্যের কেনা দেখে, খাওয়া দেখেই তাদের সুখ।

বিভুতি ভূষণের কালজয়ী উপন্যাস; সত্যজিতের বিশ্বজয়ী সিনেমা পথের পাঁচালীতে এ দৃশ্য পাঠককে, দর্শককে নস্টালজিক করে তোলে।

সাতসকালে আরও আসে মাছওয়ালা। বড় বড় বোয়াল, টাকা না থাকলেও চলে। ঘরের ধানটা-চালটা দিলেও বিনিময়ে মণ্ডমিঠাই মেলে। বর্ষা বা শরতে পাট, শীতে কার্পাস তুলার বিনিময়ে সদাইপাতি চলে ফেরিওয়ালাদের সঙ্গে।

বাবা-মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসবের বিনিময়ে মণ্ডমিঠাই কেনার চল ছিল দেড় দশক আগেও।

সকাল যখন গাঢ় হয়, পুরুষের দল মাঠে-ক্ষেতে কাজে বেরিয়ে গেছে, ছোটরা স্কুলে, তখনই আসে আরেক দল ফেরিওয়ালা। এরা আলতা, স্নো, পাউডার, বেচে, কাপড় বেচে, বেচে কমদামি গয়নাগাটিও। কর্তার চোখ ফাঁকি দিয়ে গাঁয়ের মায়েরা-বউয়েরা এসব কেনাকাটা করে, মুষ্টির চাল বেচা টাকা দিয়ে।

দুপুর যখন ঘন হয়, শিশুরা স্কুল থেকে ফেরে, তখন শোনা যায় আইসক্রিমওয়ালার বাঁশি। টিনের তৈরি সেই বাঁশি মাইলখানেক দূর থেকেও শোনা যায়।

বিকেলের দিকে আসে বাদামওয়ালা, ফুলুরিওয়ালা। সন্ধ্যার আগেই অবশ্য সব শেষ করে বাড়ি ফেরে তারা। আগের যুগে ফেরিওয়ালার প্রধান বাহন ছিল বাঁক আর ঝুড়ি। পিঠের দুইপাশে বাঁকের দুই মাথায় ঝোলে বাঁক। এ ছাড়া মাথায় ঝুড়ি বা হাঁড়ি নিয়ে ফেরিওয়ালা ফেরি করত। তারপর আসে সাইকেল, সাইকেলের পেছনের রডে ঝোলানো হয় মালসামানের ঝুলি। আইসক্রিমের বাক্সটা সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারেই জায়গা নেয়। এরপর আসে রিকশাভ্যান। তবে ভ্যানের ব্যবহার গ্রামের চেয়ে শহরে বেশি।

ফেরিওয়ালাদের একটা বিশেষ ভার্সন ছিল নিলামওয়ালা। এদের একটা কমন হাঁক ছিল, মাইকে বা খালি গলায়। ‘যা নেবে তা ছটাকা। এদের সাইকেল বা ভ্যানে থাকত নিত্যপণ্য, খেলনা থেকে বাসনকোসন নির্ধারিত দামে, যা যা দেয়া সম্ভব সব থাকত। সময়ের সঙ্গে টাকার মানের ওপর বদলেছে নিলামের জিনিসের দর, কিন্তু সদাইপাতি একই রকম।

পৃথিবী আমারে চায় সিনেমায় মহানায়ক উত্তম কুমারকে দেখা যায় এমন এক নিলামওয়ালার চরিত্রে, যেখানে তার লিপে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত গানটি আজও নিলামওয়ালাদের ট্রেডমার্ক হয়ে আছে, ‘নিলামওয়ালা ছ আনা/ যা নেবে তাই ছ আনা।’ এই গানের দ্বিতীয় স্তবকে নিলামওয়ালাদের পরসায় কী কী জিনিস থাকত তার একটা ধারণা পাওয়া যাবে, ‘এই তো আছে রঙিন ফিতা মাথার কাঁটা কানের দুল... এই তো আছে স্নো-পাউডার কসমেটিক আর লিপস্টিক, আলতা সিঁদুর মা-বোনেদের নাজরানা।’ এই গানে নিলামওয়ালা খুকির দুঃখ ঘোচাতে বিক্রি করছেন ঝুমঝুমি আর খেলার বল, হাতি, ঘোড়া, বাঘ-ভাল্লুক, ময়না-টিয়া পাখির দল, খেলাঘরের জলি পুতুল। গরিব ভাইয়ের ঘর সাজাবার জন্য তার পসরায় আছে হাতাবেড়ি, খুনতি-কড়াই, থালা-বাসন, কাপ-ডিশ, চা-ছাঁকনি, ঘটি, বাটি গ্লাস। তবে সব কিছুর ওই একই দাম।

ফেরিওয়ালারা এখনো আসে। কিন্তু ডুগডুগি বাজিয়ে বা টিনের বাঁশিতে ফুঁ দেয়া ফেরিওয়ালা এখন আর আসে না। মিষ্টি, মণ্ডা মিঠাই এখন ঘরের পাশের দোকানটিতে মেলে। এখন ফেরিওয়ালা আসে মাইক বাজিয়ে। মাইকে গান চলে ধুম-ধাড়াক্কা, মাঝে মাঝে ফেরিওয়ালার হাঁকডাক। কেউ কেউ হাঁকডাকের কসরতও করতে চায় না, রেকর্ড করা হাঁকডাক চালিয়ে ফেরি করে বেড়ায়। নিলামওয়ালাদের পদচারণা শহরে কিছুটা থাকলেও গ্রামে একদম কমে এসেছে।

r1 ad
r1 ad