top ad image
top ad image
home iconarrow iconফিচার

ইহিতাস

বাউন্টিতে বিভীষিকা!

বাউন্টিতে বিভীষিকা!
শিল্পীর কল্পনায় বাউন্টিতে বিদ্রোহ

ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির একটি যুদ্ধজাহাজ এইচএমএস বাউন্টি। ১৭৮৮ সালের ৪ ডিসেম্বর সেটাকেই তুলে দেওয়া হয় ক্যাপ্টেন ব্লাইয়ের হাতে। উদ্দেশ্য, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের তাহিতি দ্বীপ। সেখানে রুটি ফলের গাছ পাওয়া যায়। সেই গাছগুলোই দারিদ্র্যপীড়িত ব্রিটিশ উপনেবিশ এলাকায় চাষ করতে চায় ব্রিটিশ সরকার।

তাহলে সেখানকার মানুষের ক্ষুধা নিবারণের একটা পথ হয়তো পাওয়া যাবে। ৪৬ জন নাবিকের একটা বহর নিয়ে দীর্ঘ ছয় মাসের যাত্রা শেষে তাহিতি দ্বীপে পৌঁছায় বাউন্টি।

উইলিয়াম ব্লাই অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। নিয়মশৃঙ্খলার ব্যাপারেও বিন্দুমাত্র ছাড় দিতেন না। অবশ্য সেকালে কড়া সমুদ্র আইন মেনে না চললে দূর–দূর সাগরে নির্বিঘ্নে পাড়ি দেওয়ার সাধ্য কোনো ক্যাপ্টেনেরই ছিল না। বিদ্রোহ রুখতে, সীমিত রসদে লক্ষ্যে পৌঁছাতে মাঝেমধ্যে ক্যাপ্টেনদের নিষ্ঠুর আচরণ করতে হতো। নাবিকদের ওপরও প্রয়োজনে চাবুক চালানোর অধিকার ছিল ক্যাপ্টেনদের। কিন্তু উইলিয়াম ব্লাই চাবুকটা একটু বেশিই ব্যবহার করতেন। লঘু পাপে গুরু দণ্ড দিতে আত্মগ্লানীতে পুড়তে কেউ তাঁকে দেখেনি। সামান্য অপরাধে জাহাজের আরোহীদের দিনের পর দিন শিকলবন্দী করে চাবুকপেটা করতেন। তা ছাড়া সারাক্ষণ তালে থাকতেন অধস্তনদের দোষত্রুটি খোঁজার, এমনকি তাঁদের জন্য বরাদ্দ খাবার পর্যন্ত চুরি করত তাঁর এক চামচা।

বিদ্রোহের ছাইচাপা আগুন ধিকি ধিকি জ্বলতে জ্বলতে হঠাৎ একদিন বিস্ফোরিত হয়। তাহিতি দ্বীপ থেকে পর্যাপ্ত রুটি ফলের চারা সংগ্রহ করে দেশের উদ্দেশে জাহাজ ভিড়িয়েছেন মাত্র কয়েকে দিন আগে। জাহাজ যত মাঝসাগরের দিকে এগিয়ে চলেছে, ততটাই নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে ব্লাইয়ের আচরণ। তারপরও ঝড়ের পূর্বাভাস একটু আগেভাগে পাওয়ার অধিকার সবারই থাকে। কিন্তু ব্লাইকে সে সুযোগ দেওয়া হয়নি। একদিন মাঝরাতে আবিষ্কার করেন নিজেকে বন্দী অবস্থায়। এত দিন যেসব নাবিক তাঁর ভয়ে খাবি খেত, সে রাতে তারাই কিনা বন্দুক উঁচিয়ে তাঁকে বন্দী করেছে। হাত-পা বেঁধে রেখেছে তাঁর অনুগামীদেরও। এত দিন যেসব তুচ্ছ নাবিকের সঙ্গে কুকুরের মতো আচরণ করেছেন, আজ তারাই কিনা তাঁর চোখে চোখ রেখে দম্ভভরে গালিগালাজ করছে, তাঁকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে! আর এদের মূল হোতা আপাদমস্তক ভদ্রলোক বলে খ্যাত মাস্টার মেট ফ্লেচার ক্রিশ্চিয়ান। অথচ ব্লাই-ই স্নেহবশত সাধারণ নাবিক থেকে মাস্টার মেটে পদোন্নতি দিয়েছিলেন তাঁকে।

ক্যাপ্টেন ব্লাইয়ের সামনে তখন দুটি পথ খোলা। হয় তাঁকে ছোট্ট নৌকায় উঠে উত্তাল সাগর পাড়ি দিতে হবে, নইলে মরতে হবে তাঁরই অধীন নাবিকদের কাছে। তিনি প্রথম সুযোগটাই বেছে নিলেন। অবশ্য বেশির ভাগ বিদ্রোহী এই সুযোগও দিতে রাজি নয়। মৃত্যুই ব্লাইয়ের একমাত্র শাস্তি বলে মনে করে ওরা। কিন্তু ক্রিশ্চিয়ান অতটা নিষ্ঠুর নন। তিনি ব্লাইকে একটা সুযোগ দিতে চান। একটা ছোট্ট নৌকায় যখন অনুগামীদেরসহ ব্লাইকে উঠিয়ে দেওয়া হয়, তখন দেখা গেল আরও কিছু লোক স্বেছায় সেই নৌকায় চড়ে বসেছে। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও ব্লাইয়ের সঙ্গ নিলেন সমুদ্র আইনের প্রতি সম্মান দেখিয়ে!

১৮ জন আরোহী যখন চড়ে বসলেন, ছোট্ট সেই নৌকার তখন ডুবু ডুবু অবস্থা। পানি থেকে মাত্র ছয় ইঞ্চি উঁচুতে নৌকার কিনার। দয়া করে প্রাণভিক্ষা দেওয়া হয়েছিল ব্লাইকে। কিন্তু প্রয়োজনীয় রসদ দেওয়া হয়নি। কয়েক বস্তা রুটি, কিছু শুকনো মাংস আর সামান্য পানীয়। বিদ্রোহীদের কাছে কিছু অস্ত্র চেয়েছিলেন ব্লাই। কিন্তু তার বদলে জুটেছিল বিদ্রূপ। অবশ্য ক্রিশ্চিয়ান কিছুটা সদয় হয়েছিলেন। বন্দুক কিংবা গোলাবারুদ না দিয়ে দিয়েছিলেন মাত্র চারটি তলোয়ার।

উইলিয়াম পার্সেল নামে একজন ছুতোর মিস্ত্রি ছিলেন বাউন্টিতে। বেশি কথা বলতেন, তেমনি বদমেজাজি। ক্যাপ্টেন ব্লাই তাঁকে শিকলে বন্দী করে রেখেছিলেন বহুদিন। অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছিলেন তাঁর ওপর। অথচ যে দোষে পার্সেলকে সাজা দেওয়া হয়, সেই দোষ তাঁর ছিল না; বরং পার্সেলই ঠিক ছিলেন, ব্লাই অন্ধ আক্রোশে তাঁকে অত্যাচার করেছিলেন। সেই পার্সেলই বিদ্রোহের সময় ব্লাইয়ের পক্ষ নেন, তাঁর সঙ্গে স্বেচ্ছায় নৌকায় ওঠেন বিদ্রোহীদের লোভনীয় প্রস্তাব উপেক্ষা করে। পার্সেল খুব ভালো মিস্ত্রি। বিদ্রোহীরা ভয় পায়, কোনো দ্বীপে যদি নৌকা ভেড়াতে পারে ব্লাইয়ের অনুগামীরা, পার্সেল ঠিকই ভালো একটা জাহাজ বানিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে পারবে। সুতরাং তাঁর সব যন্ত্রপাতি কেড়ে নেয় বিদ্রোহীরা। অনেক অনুনয়ের পর সামান্য কিছু পেরেক আর হাতুড়ি দেওয়া হয়। সেই পেরেক আর হাতুড়ি দিয়েই অসাধ্য সাধন করেন পার্সেল। দুর্নিবার ঝড়ে আর প্রবল ঢেউয়ে ছত্রখান হওয়া নৌকাটিকে তিনিই বারবার জোড়াতালি দিয়ে চালিয়ে নিয়েছিলেন।

উত্তাল সাগরে শুরু হয় ব্লাইয়ের অনিশ্চিত যাত্রা। বড় কোনো ভূমিকম্প যেমন করে অবিচল পাহাড়কেও টলিয়ে দেয়, বাউন্টির বিদ্রোহ তেমনি কাঁপিয়ে দেয় ব্লাইয়ের আত্ম–অহংকারের ভিত। সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষে পরিণত হন তিনি। সব দায়দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে ব্যক্তিত্ব দিয়ে আগলে রাখেন ১৮ জন নাবিকের জীবন। ভাঙা একটা কম্পাস আর একটা আতশকাচকে সম্বল করে দক্ষ ক্যাপ্টেনের মতোই তিনি এগিয়ে চলেন তোফায়া নামের ছোট্ট একটা দ্বীপের দিকে। ঝড় আর ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে ঠিক ঠিক পৌঁছেও গেলেন তোফায়ায়। সেখানকার আদিবাসীরা সাদর অভ্যর্থনাও জানাল। কিন্তু নিয়তির কুডাক ঠিকই শুনতে পেলেন ক্যাপ্টেন ব্লাই। বুঝলেন আদিবাসীদের দুরভিসন্ধি আছে। তাঁদের খুন করে জাহাজ আর সব মালামাল আত্মসাৎ করতে চায় ব্যাটারা! সময়মতো সেই ষড়যন্ত্রের জাল ছিঁড়ে ১৭ জন নাবিকের প্রাণ বাঁচালেন সপ্তাহখানেক আগের দুর্বিনীত ক্যাপ্টেন ব্লাই। নিজের ভুলে মারা পড়লেন এক নাবিক। তার আগে দ্বীপ থেকে কিছু রুটি ফল আর পানি সংগ্রহ করতে পারলেন। এরপর আবার শুরু হলো প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ।

মাঝেমধ্যে ফুঁসে ওঠে সাগর। তুমুল গর্জন করে ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে। মাঝেমধ্যে মুষলধারে বৃষ্টি ঠান্ডায় জমিয়ে দিতে চায় নাবিকদের শরীর। কখনো প্রচণ্ড রোদে ঝলসে যায় চামড়া। তার ওপর খাদ্য-পানীয়ের সংকট। দিনের পর দিন এভাবেই অথই সাগরে ভেসে চলে ব্লাইয়ের নৌকা। ক্ষুধা–পিপাসায় কাতর মানুষগুলো হাল ছেড়ে দেয়। নিজেদের সঁপে দেয় নিষ্ঠুর নিয়তির হাতে। বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। তবু ডাঙার দেখা নেই। অবশেষে একটা দ্বীপের দেখা পান ব্লাই। কিন্তু জনবসতহীন সেই দ্বীপে পর্যাপ্ত খাবার নেই। মাঝেমধ্যে শামুক-ঝিনুক ধরে চলে ক্ষুধা নিবৃত্তির চেষ্টা। একটা বড়সড় কচ্ছপ ধরারও চেষ্টা করেন নাবিকেরা। কিন্তু তাঁরা এতটাই দুর্বল যে কয়েকজন মিলেও একটা কচ্ছপের শক্তির সঙ্গে পেরে ওঠেন না। শেষমেশ দ্বীপ ছেড়ে আবার বিক্ষুব্ধ সাগরে ভেসে পড়া। টানা কয়েক দিন চরম ক্ষুধার মধ্যেই ধরা পড়ে একটা বড়সড় মাছ। কিন্তু ভাঙা নৌকায় রান্নার উপকরণ নেই, আগুন নেই। কাঁচাই খেতে হয় সেই মাছ। সেই মাছ খেয়ে শক্তি ফিরে পাওয়ার বদলে উল্টো বদহজমে পড়ে অসুস্থ হয়ে যান। কিন্তু ক্যাপ্টেন ব্লাইয়ের ইস্পাতকঠিন মনোবল, অপরিসীম ধৈর্য আর বুদ্ধিমত্তার কাছে শেষমেশ পরাজিত হয় সমুদ্র। ৬ হাজার ৭০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে হাড্ডিসার একদল নাবিক পৌঁছে যান ডাচশাসিত দ্বীপ টিমোরে, বর্তমানে সেটা ইন্দোনেশিয়ার একটা দ্বীপ। তারপর ডাচ নাবিকদের সাহায্য নিয়ে ব্লাই পৌঁছে যান বাতাভিয়ায়। বাতাভিয়া বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার আগের নাম। এখান থেকেই পরে ব্লাইসহ বেশির ভাগ নাবিক ইংল্যান্ডের জাহাজ ধরে দেশে ফেরেন। কিন্তু দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার ধকল কাটিয়ে বেঁচে ফিরলেও বাতাভিয়ায় অজানা এক রোগে মারা পড়েন ৪-৫ জন নাবিক।

অন্যদিকে বিদ্রোহীরা ছড়িয়ে পড়ে তাহিতিসহ আশপাশের দ্বীপে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ১৮৯০ সালে ইংল্যান্ডে পা রাখেন উইলিয়াম ব্লাই। তারপর ব্রিটিশ সরকার ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ডকে দায়িত্ব দেন বিদ্রোহীদের ধরে আনার। প্যান্ডোরা নামে ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির জাহাজ তুলে দেওয়া হয় তাঁর হাতে। তিনি দলবলসহ গোটা বিদ্রোহী দলটাকেই ধরে ফেলেন। কিন্তু পাওয়া যায়নি হোতা ক্রিশ্চিয়ানকেই। প্যান্ডোরা বিদ্রোহীদের গ্রেপ্তার করে নিরাপদে ফিরতে পারেনি। গ্রেট বেরিয়ার রিফে ডুবে যায় প্যান্ডোরা। নাবিক আর বিদ্রোহীসহ ৩১ জনের সলিলসমাধি ঘটে। বেঁচে ফেরেন ১০ জন। তাদের মধ্যে ছয়জনই বিদ্রোহী। কোর্ট মার্শালে তাদের তিনজনের ফাঁসি হয়, তিনজনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড।

১৭৮৯ সালের ২৮ এপ্রিল বিদ্রোহের মাধ্যমে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল ক্যাপ্টেন ব্লাই আর অনুগামীদের। ১৪ জুন টিমোরে পদার্পণের মাধ্যমে শেষ হয় বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম দুঃসাহসিক অভিযানের। এই অভিযানের গল্প এখন কিংবদন্তি কাহিনিতে পরিণত হয়েছে। এই কাহিনি নিয়ে লেখা হয়েছে তিন–তিনটি উপন্যাস—মিউটিনি অব বাউন্টি, ম্যান অ্যাগেনেস্ট দ্য সি ও পিটকেয়ার্নস আইল্যান্ড। প্রথমটিতে বাউন্টির যাত্রা আর বিদ্রোহের কাহিনি, দ্বিতীয়টিতে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সাগরে ক্যাপ্টেন ব্লাইয়ের দুঃসাহিক যাত্রা আর তৃতীয়টিতে উঠে এসেছে বিদ্রোহীদের নাটের গুরু ফ্লেচার ক্রিশ্চিয়ান আর তার বিদ্রোহীদের শেষ পরিণতি।

r1 ad
r1 ad