top ad image
top ad image
home iconarrow iconফিচার

বিজ্ঞান

জেনার, গোয়ালীনি ও টিকার ইতিহাস

জেনার, গোয়ালীনি ও টিকার ইতিহাস
রোগীর শরীরে ইতিহাসের প্রথম টিকা পুশ করছেন এডওয়ার্ড জেনার

১৭৯৬ সাল। ব্রিটেনে তখন গুটিবসন্ত মহামারি আকার ধারণ করেছে। তখন গুটিবসন্তে আক্রান্ত প্রতি দশজনের তিনজনই মারা যেত। তাই গুটিবসন্ত নিয়ে মানুষের ভয় অমূলক ছিল না। চারদিকে যখন গুটিবসন্তের ভয়ে থরহরিকম্প, তখন জেনার পেলেন আলোর সন্ধান। তাঁর বাড়িতে একজন গোয়ালিনী রোজ দুধ দিয়ে যেত। তার নাম সারা নেলমস। জেনার লক্ষ্য করলেন মেয়েটির কখনো গুটিবসন্ত হয়নি। অনেক দিন ধরে মেয়েটির ওপরে নজর রাখলেন। কয়েক মাস কেটে গেল। তবু সারার শরীরে গুটিবসন্ত হওয়ার কোনো লক্ষণই নেই! অথচ এই গোয়ালিনীরই ছিল গুটিবসন্তে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা সবচেয়ে বেশি। কারণ শহরের অলিতে-গলিতে ছিল তার অবাধ বিচরণ। গুটিবসন্তে আক্রান্ত মানুষের বাড়িতে যাতায়াতও তার কম ছিল না।

তাহলে?

জেনার ব্যাপারটা খতিয়ে দেখার জন্যে একদিন সশরীরে হাজার হলেন সেই গোয়ালিনির বাড়ি। দেখলেন তাদের গরুগুলো কাউপক্স বা গোবসন্তে আক্রান্ত। গোবসন্ত শুধু গরুকে নয়, মানুষকেও আক্রান্ত করে স্বল্প মাত্রায়। তবে মানুষের শরীরে খুব বেশি প্রভাব ফেলে না।

তখন একটা ধারণা বেশ প্রচলিত ছিল সমাজে। যারা গোবসন্তে আক্রান্ত হন, তারা ভাগ্যবান। গোবসন্তে আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তি সাধারণত গুটিবসন্তে আক্রন্ত হয় না। হলেও গুটিবসন্ত তাদের মেরে ফেলতে পারে না। জেনার সেদিন গোয়ালিনীর বাড়িতে গিয়ে যেন সেই ধারণার প্রমাণ পেলেন। জেনার ভাবলেন, নিশ্চয়ই গরুর দেহ থেকে সারার দেহে গোবসন্তের সংক্রমণ ঘটেছিল। তারই প্রভাবে গুটি বসন্তের হাত থেকে বেঁচে গেছে সে। যে কোনো ধরনের বসন্ত একবার হলে, সাধারণত একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয় না। কারণ তাঁর দেহে বসন্তের প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয়ে যায়। জেনার ধারণা করলেন, গোবসন্ত আক্রান্ত রোগী দেহে গো বসন্তের পাশাপাশি গুটিবসন্তের প্রতিরোধক্ষমতাও তৈরি হয়ে যায়।

বিজ্ঞানে যৌক্তিক ধারণারও কোনো মূল্য নেই। একমাত্র পরীক্ষামূলক প্রমাণই পারে ধারণাকে বিজ্ঞানে রূপ দিতে। গোয়ালিনীর গরুগুলোর শরীরের ক্ষতস্থান থেকে তরল সংগ্রহ করলেন। তারপর সেই তরল নিয়ে গিয়ে ডলে দিলেন জেনার ফিপস নামের এক শিশুর গায়ে। আট বছর বয়সী সেই শিশু ছিল জেনারের বাগানের মালির ছেলে। ফিফস কখনো গোবসন্ত বা গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়নি। এ ব্যাপারটা জানতেন জেনার। তাই সেই ছেলেটাকেই বেছে নিয়েছিলেন।

শরীরে গোবসন্তের জীবাণু প্রয়োগের পর ফিফস কয়েকদিনের মধ্যেই গোবসন্তে আক্রান্ত হয়। হালকা উপসর্গ দেখা যায়। কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য সুস্থও হয়ে ওঠে। তখন ফিফসের শরীরে একইভাবে গুটিবসন্তের জীবাণুও প্রয়োগ করেন জেনার। ছেলেটা এবার গুটিবসন্তেও আক্রান্ত হয়। কিন্তু তার এই রোগ অত মারাত্মক হয়ে ওঠেনি। দ্রুতই ছেলেটা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে। অর্থাৎ জেনারের ধারণাই ঠিক।

এরপর জেনার এক মহান ভাবনা ভেবে বসেন। গোটা মানবজাতিকে তিনি বসন্তের হাত থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করবেন। জেনার বুঝেছিলেন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাই রোগমুক্ত করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। যখন বাইরে থেকে কোনো জীবাণু প্রবেশ করে, তখন যদি রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা শুরুতেই চিনতে পারে জীবাণুটাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে শুরু করে। জীবাণু আর রোগ তৈরি করতে পারে না।

ভ্যারিওয়ালা ভাইরাস বসন্ত রোগের জন্য দায়ী। এর চারটি ভ্যারিয়েন্ট আছে। এর একটি গোবসন্তের জন্য দায়ী। আরেকটি গুটিবসন্ত ছড়ায়। গোবসন্তের ভাইরাসটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করা মাত্র রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা সেটাকে পাকড়াও করে। ফলে গোবসন্ত মানবদেহকে ঠিকঠাক মতো আক্রান্ত করতে পারে না। অন্যদিকে গুটিবসন্তের ভাইরাসটিকে অত সহজে চিনতে পারে না রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা। তাই গুটিবসন্ত শরীরে জাঁকিয়ে বসতে পারে। কিন্তু যাদের শরীরে গোবসন্তের জীবাণু আগেই প্রবেশ করেছে, নতুন করে তাদের দেহে গুটিবসন্তের ভাইরাস এলেও রোগপ্রতিরোধব্যবস্থা দ্রুত সেটাকে শনাক্ত করতে পারে। দ্রুত তার বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেয়। এজন্য গুটিবসন্ত আর সেই রোগিকে আক্রান্ত করতে পারে না।

এই তত্ত্ব কাজে লাগিয়েই জেনার গোবসন্তের জীবাণুর সাহায্যে তৈরি করলেন গুটিবসন্তের টিকা। শুধু তা-ই নয়, মানব ইতিহাসের প্রথম টিকাই ছিল সেটা।
সূত্র: ব্রিটানিকা

r1 ad
r1 ad