শিল্প-সাহিত্য
বিচিত্র রঙের রিকশা
রিকশা জাপানী যান হলেও, এখন তা বাংলার সম্পত্তি। বাঙালির জন্য রিকশা স্পেশাল যান। তার চেয়েও স্পেশাল রিকশাচিত্র। ছোট্ট একটা যাবাহনকে রঙ করতে গিয়ে চিত্রশিল্পের নতুন একটা ধারা গড়ে উঠতে পারে, এমন ঘটনা ইতিহাসে বিরল।রিকশা জাপানী যান হলেও, এখন তা বাংলার সম্পত্তি। বাঙালির জন্য রিকশা স্পেশাল যান। তার চেয়েও স্পেশাল রিকশাচিত্র। ছোট্ট একটা যাবাহনকে রঙ করতে গিয়ে চিত্রশিল্পের নতুন একটা ধারা গড়ে উঠতে পারে, এমন ঘটনা ইতিহাসে বিরল।
রিকশাচিত্রকে বলা হয় লিভিং ট্রেডিশন বা জীবন্ত ঐতিহ্য। রিকশার বিভিন্ন অংশে নানা চিত্রকর্মে রিকশাকে সুসজ্জিত এবং আকর্ষণীয় করে তোলাই রিকশাচিত্রের মূল উদ্দেশ্য। ভারতসহ বাংলাদেশের বেশ কিছু জায়গায় বাহারি রিকশাচিত্র লক্ষ করা যায়। রিকশাচিত্র ঠিক কবে কোথায় কে শুরু করেছিলেন তা নিয়ে মতভেদ আছে।
একে ভারতীয় উপমহাদেশের একটি চিত্র বলে ধরা হলেও এটি আসলে কোন ঘরানার চিত্রকর্ম, মেলেনি সেটার উত্তর। 'বাংলাদেশি আর্টস অব দ্য রিকশা' প্রবন্ধে জনপ্রিয় মার্কিন নৃতত্ত্ববিদ জোয়ানা কির্কপ্যাট্রিক রিকশাচিত্রকে গণমানুষের চিত্র বলে দাবি করেছেন।
বাংলাদেশে রিকশাচিত্র জনপ্রিয় হতে শুরু করে ষাটের দশকে। রিকশার হুডে বিভিন্ন ল্যান্ডস্কেপ এবং পোট্রেট এঁকে দেয়া হতো নানা রূপ।
ফুল-ফল, গাছপালা, পশু-পাখি, মানুষ, নদীর দৃশ্য- কী নেই তাতে? গ্রামীণ জনজীবনের অদেখা রূপও উঠে আসত এসব চিত্রকর্মে। সন্তানকে মা খাওয়াচ্ছেন, শিশুরা খেলা করছে, ধান কাটছে চাষা, কিংবা মাছ ধরছে জেলে —এসবই ছিল গ্রামীণ রিকশাচিত্রের মূল উপজীব্য।
ষাটের দশক থেকে বাংলা সিনেমার বিজ্ঞাপনের কাজেও ব্যবহার হতো রিকশাচিত্র। শিল্পীর রং-তুলিতে ফুটে উঠত সে সময়ের জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকার ছবি।
যেন জীবন্ত গল্পেরা ছুটে চলছে রিকশার সঙ্গে। সিনেমার প্রচারে এ ছিল অভিনব এক প্রচার। আউল-বাউল-দেউলের দেশ বাংলাদেশ। এককালে রিকশাচিত্রে ফুটে উঠত বাউল গানের বিভিন্ন লাইন। মাঝেমধ্যে রিকশাওয়ালারাও টান দিত গানে।
তাদের দরদভরা গানে রিকশাচিত্র হয়ে উঠত আরও বেশি জীবন্ত। এ ছাড়া বিভিন্ন গ্রামীণ গানও জীবন্ত হয়ে উঠত শহুরে রিকশায়। জনপ্রিয় বাংলাদেশি গায়ক ফকির আলমগীরের কথা ও সুরে এই গানটি ছিল ভীষণ জনপ্রিয়- 'আমি অহন রিকশা চালাই ঢাহা শহরে/ও সকিনা গেছস কিনা ভুইল্লা আমারে।'
একেক সময়ে একেক বিষয় নিয়ে এঁকেছেন শিল্পীরা। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নানা ছবি আঁকার ট্রেন্ড ছিল লক্ষণীয়। অস্ত্র হাতে বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধার কপালে বাঁধা স্বাধীন বাংলার পতাকা কিংবা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছ থেকে সদ্য মুক্ত করা কোনো অঞ্চলে উড়ছে আমাদের গর্বের পতাকা। এ ছাড়া স্মৃতিসৌধ, সংসদ ভবন, শহীদ মিনার, তাজমহলও ফুটে উঠত নানা বাহারি রঙে। পরবর্তীতে লক্ষ করা গেছে ধর্মীয় ট্রেন্ড। কলকাতার অঞ্চলগুলোর রিকশাতে নানা দেবদেবী এবং বাংলাদেশের অঞ্চলগুলোতে মসজিদ, তসবিহ, ঈদের চাঁদসহ অসংখ্য দৃশ্য ফুটে উঠত। এসব ছাপিয়ে রিকশাচিত্রে লক্ষ করা গেছে আলিফ-লায়লার নানা দৃশ্য, পঙ্খিরাজ ঘোড়াসহ রূপকথার নানা গল্প।
রিকশার নানা চিত্রকর্ম রিকশাকে করে তুলেছে আকর্ষণীয় এবং বৈচিত্র্যময়। রিকশাচিত্র মূলত রিকশাওয়ালার কষ্ট, পরিশ্রম, আনন্দ-বেদনার সাক্ষী। সেই ষাটের দশক থেকে বর্তমানেও এটি সমানতালে জনপ্রিয়। ক্রমেই এই অঞ্চলের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠেছে এসব রিকশাচিত্র।