top ad image
top ad image
home iconarrow iconফিচার

বিজ্ঞান

যেভাবে গোনা হলো পৃথিবীর বয়স?

যেভাবে গোনা হলো পৃথিবীর বয়স?
পৃথিবীর বয়স বের করতে কাজে লাগানো হয় পদার্থের তেজস্ক্রিয় ধর্ম

পৃথিবী ঠিক কত পুরোনো? এমন প্রশ্ন মানুষের মনে বহুদিন ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। বিজ্ঞানের হাত ধরে আজ আমরা এই প্রশ্নের একটা নির্ভরযোগ্য উত্তর দিতে পারি—পৃথিবীর বয়স প্রায় ৪৫০ কোটি বছর। কিন্তু এই হিসাবটা কীভাবে করা হলো? বিজ্ঞানীরা এমন এক বিশাল সময়ের হিসাব কীভাবে বের করলেন?

এই জটিল প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে তেজস্ক্রিয় পদার্থের এক আশ্চর্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে—তেজস্ক্রিয় ক্ষয়।

তেজস্ক্রিয় পদার্থ এমন এক ধরনের মৌল, যাদের পরমাণু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পড়ে এবং একধরনের শক্তি বা রশ্মি বের করে। এই প্রক্রিয়াকেই বলে তেজস্ক্রিয় ক্ষয় (Radioactive decay)। এই ক্ষয়ের ফলে এক তেজস্ক্রিয় মৌল ধীরে ধীরে রূপ নেয় অন্য এক মৌলে।

ধরা যাক ইউরেনিয়ামের কথা। ইউরেনিয়াম একটি প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয় পদার্থ, যা ক্ষয় হয়ে ধীরে ধীরে সিসা (lead)-তে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু এই রূপান্তর একেবারে হঠাৎ করে ঘটে না। এটা হয় ধীরে ধীরে, একটা নির্দিষ্ট হারে। এই হারকে বোঝাতে বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেন এক বিশেষ পরিভাষা—অর্ধায়ু।

অর্ধায়ু মানে কী?

অর্ধায়ু (Half-life) হলো সময়ের সেই পরিমাণ, যত দিনে কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থের অর্ধেক পরিমাণ ক্ষয় হয়ে অন্য মৌলে পরিণত হয়। ইউরেনিয়ামের অর্ধায়ু হলো ৪৫০ কোটি বছর। অর্থাৎ যদি তোমার হাতে ১০০টি ইউরেনিয়াম পরমাণু থাকে, তাহলে ৪৫০ কোটি বছর পর এর ৫০টি ক্ষয় হয়ে যাবে এবং সিসাতে পরিণত হবে, বাকি ৫০টি থাকবে ইউরেনিয়াম অবস্থায়।

মজার বিষয় হলো, এই সংখ্যাটা কত বড় বা ছোট সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ১০০টি হোক কিংবা ১ কোটি পরমাণু—অর্ধেক ক্ষয় হতে সময় লাগবেই ৪৫০ কোটি বছর।

এত বিশাল সময়ের হিসাবন করা হলো কীভাবে?

এখানেই আসে বিজ্ঞানের অবদান। মানুষ যদিও ৪৫০ কোটি বছর বাঁচে না, তবু বিজ্ঞানের নির্ভরযোগ্য গাণিতিক সমীকরণ আছে, যা তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের হার মেপে একটি পদার্থের অর্ধায়ু নির্ণয় করতে পারে।

বিজ্ঞানীরা প্রতি সেকেন্ডে কতটি পরমাণু ক্ষয় হচ্ছে তা মেপে একটি নির্দিষ্ট সমীকরণে বসান। এই সমীকরণ সেই পরমাণুর অর্ধায়ু জানিয়ে দেয়। এই পদ্ধতিটি অনেক কম অর্ধায়ু বিশিষ্ট পদার্থে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এবং ফলাফল একেবারে সঠিক।

ধরা যাক, কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থের অর্ধায়ু ৫ ঘণ্টা। তাহলে দেখা যাবে ৫ ঘণ্টা পর তার অর্ধেক পরমাণু ক্ষয় হয়ে গেছে। ১০ ঘণ্টা পর বাকি অর্ধেকের অর্ধেক। এইভাবে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন, এই সমীকরণ বড় সময়ের অর্ধায়ুর ক্ষেত্রেও নির্ভরযোগ্য।

এই তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করেন পৃথিবীর প্রাচীন শিলাখণ্ডগুলো। এই শিলাগুলোতে রয়েছে ইউরেনিয়াম এবং তার ক্ষয়ে তৈরি হওয়া সিসা। যখনই কোনো শিলাখণ্ড তৈরি হয়, তখন তাতে থাকে শুধু ইউরেনিয়াম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইউরেনিয়াম ক্ষয় হয়ে সিসায় পরিণত হয়।

তারা দেখেছেন, পৃথিবীর নানা প্রান্তে পাওয়া প্রাচীন শিলাগুলোর মধ্যে অর্ধেক ইউরেনিয়াম রয়ে গেছে, বাকি অর্ধেক পরিণত হয়েছে সিসায়। এর মানে, ওই শিলাখণ্ডগুলো তাদের অর্ধায়ু পেরিয়েছে। আর ইউরেনিয়ামের অর্ধায়ু যেহেতু ৪৫০ কোটি বছর, তাই সেই শিলার বয়সও তাই।

এইসব শিলাখণ্ড পৃথিবীর ভূত্বকের গভীরে তৈরি হয়েছিল। ধরে নেওয়া হয়, যখন এই শিলাগুলো তৈরি হয়েছিল, তখনই পৃথিবী পুরোপুরি ঠান্ডা হয়ে জমাট বাঁধা শুরু করে। অর্থাৎ ওই শিলাগুলোর বয়সই পৃথিবীর বয়সের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ।

তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের এই গাণিতিক ভিত্তির উপর ভর করেই বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বয়স নির্ণয় করতে পেরেছেন। ইউরেনিয়াম এবং সিসার অনুপাত মেপে তারা নিশ্চিত হয়েছেন—পৃথিবীর বয়স প্রায় ৪৫০ কোটি বছর।

এই বিশাল সময়ের হিসাবের পেছনে লুকিয়ে আছে পরমাণুর ক্ষয়, কঠিন গাণিতিক বিশ্লেষণ আর প্রকৃতির এক অপূর্ব নিয়মিততা। ভাবলে অবাক লাগতে পারে, এত সূক্ষ্ম এক প্রক্রিয়া আমাদের জানিয়ে দেয়, আমরা কতটা পুরোনো এই মহাবিশ্বে।

r1 ad
top ad image