মহাকাশ
চাঁদের বয়স আসলে কত?

রাতের আকাশে তাকালেই সবচেয়ে চোখে পড়ে যে বস্তুটি, তা হলো চাঁদ। দিনের আলো ফুরালেই যখন নেমে আসে অন্ধকার, তখন চাঁদের স্নিগ্ধ আলো আমাদের মন ছুঁয়ে যায়। যুগে যুগে মানুষ চাঁদকে ঘিরে গড়েছে কবিতা, গল্প, প্রেম আর কল্পনার জগৎ। কিন্তু এই চাঁদের জন্ম কিভাবে হলো? এর বয়সই বা কত? এই প্রশ্নগুলো বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছে বহু বছর ধরে।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আজ থেকে প্রায় ৪৫৩ কোটি বছর আগে চাঁদের জন্ম হয়। তবে চাঁদ একদিন হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি। এর পেছনে আছে এক মহাকাব্যিক সংঘর্ষ। এই তত্ত্বকে বলা হয় থিয়া থিওরি। থিয়া নামে একটি মঙ্গল গ্রহের মতো বিশাল বস্তু এক সময় পৃথিবীর সঙ্গে ধাক্কা খায়। এই সংঘর্ষ এতটাই ভয়াবহ ছিল যে পৃথিবীর কিছু অংশ ভেঙে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। পরে সেই ছিন্নভিন্ন অংশ একত্রিত হয়ে গড়ে তোলে আজকের চাঁদ।
এই তত্ত্ব শুধু অনুমান নয়, বরং বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তৈরি। চাঁদের গঠন এবং পৃথিবীর গঠনের মধ্যে বিস্ময়কর মিল পাওয়া যায়। সেই থেকেই এই তত্ত্বটি সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত।
চাঁদের বয়স কীভাবে জানা গেল?
চাঁদের বয়স নির্ধারণ করার জন্য বিজ্ঞানীরা নানা পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে নাসার অ্যাপোলো মিশন। এই মিশনের সময় নভোচারীরা চাঁদ থেকে যেসব শিলার নমুনা সংগ্রহ করে আনেন, সেগুলো বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা চাঁদের বয়স নির্ধারণ করেন।
চাঁদের সেই শিলায় পাওয়া যায় ইউরেনিয়াম এবং থোরিয়ামের মতো রেডিওঅ্যাকটিভ উপাদান, যেগুলো সময়ের সঙ্গে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এই ক্ষয়ের হার বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, শিলাগুলোর বয়স কত। আর সেখান থেকেই নিশ্চিত হওয়া যায়, চাঁদের বয়স প্রায় ৪৫৩ কোটি বছর।
এছাড়া চাঁদের পৃষ্ঠে যেসব ক্রেটার বা গর্ত রয়েছে, সেগুলোর সংখ্যা ও গভীরতা বিশ্লেষণ করেও চাঁদের বয়স সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। অনেক ক্রেটার কোটি কোটি বছর আগে বিশাল উল্কাপিণ্ডের আঘাতে তৈরি হয়েছে।
নতুন পদ্ধতি: অ্যাস্ট্রোক্রোনোলজি
২০২১ সালে বিজ্ঞানীরা চাঁদের বয়স নির্ধারণে আরেকটি নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করেন, যার নাম অ্যাস্ট্রোক্রোনোলজি। এই পদ্ধতিতে মহাবিশ্বের শুরু থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে গ্রহ-উপগ্রহের গঠন ও বয়স সম্পর্কে আরও নিখুঁত ধারণা পাওয়া যায়।
অ্যাস্ট্রোক্রোনোলজি শুধু চাঁদেরই নয়, পুরো সৌরজগতের ইতিহাস জানার দরজা খুলে দেয়। চাঁদের জন্ম, বয়স এবং গঠনের ধারা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন কীভাবে পৃথিবী, মঙ্গল কিংবা অন্যান্য গ্রহেরা সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে।
কেন চাঁদের বয়স জানা গুরুত্বপূর্ণ?
চাঁদের বয়স জানার বিষয়টি শুধু একটি সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়। এটি আমাদের সাহায্য করে মহাবিশ্বের ইতিহাস জানতে। চাঁদ ও পৃথিবীর বয়স কাছাকাছি—এই তথ্য আমাদের বলে দেয়, পৃথিবীর শুরুতে কী ধরনের ঘটনা ঘটেছিল, কীভাবে পরিবেশ গড়ে উঠল, কিংবা জীবন গঠনের সম্ভাবনা কীভাবে তৈরি হলো।
এছাড়া, চাঁদের গঠন বুঝে ভবিষ্যতে সেখানে ঘাঁটি গড়ে তোলা, গবেষণাগার বসানো কিংবা দূর মহাকাশ অভিযানের যাত্রা শুরু করার পরিকল্পনাও চলছে। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, চাঁদ ভবিষ্যতের “মহাকাশ বন্দর” হয়ে উঠতে পারে।
চাঁদকে আমরা শুধু রাতের আলোর উৎস হিসেবে দেখি, কিন্তু এর ভেতরে লুকিয়ে আছে পৃথিবীর ইতিহাস, সৌরজগতের বিবর্তন, আর মহাজাগতিক রহস্যের চাবিকাঠি। বিজ্ঞানীরা আজও চাঁদ নিয়ে গবেষণা করছেন, আর ভবিষ্যতে হয়তো চাঁদ আমাদের মহাবিশ্বের নতুন কিছু দরজা খুলে দেবে।
সূত্র: স্পেস ডট কম