সমঝোতার ২৬ আসন নিয়ে তৃপ্ত জাপা, বাকি প্রার্থীরা ক্ষুব্ধ বা নিষ্ক্রিয়
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের কাছ থেকে সহযোগিতা না পাওয়ায় অভিযোগ তুলে নির্বাচন থেকে একে একে সরে দাঁড়াচ্ছেন সংসদের সম্ভাব্য বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা।
তাদের ভাষ্য, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ছাড় পাওয়া ২৬টি আসনেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে জাতীয় পার্টি। অন্য আসনের প্রার্থীরা অবহেলা শিকার হচ্ছেন। দলের তহবিল থেকে পাচ্ছেন না আর্থিক সহযোগিতাও।
৭ জানুয়ারীর নির্বাচনে ‘সমঝোতার’ ২৬টি আসনের বাইরে ২৫৭ আসনে প্রার্থী দেয় জাতীয় পার্টি। তাদের মধ্যে এ পর্যন্ত অন্তত ১৩ জন প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।
নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো প্রার্থীদের নিজস্ব ব্যাপার বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব জহিরুল ইসলাম জহির।
তিনি বলেন, “আমাদের বলে কেউ নির্বাচন থেকে সরে যাচ্ছেন না, যার যার মতো করে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিচ্ছেন।”
জহির বলেন, “দলের পক্ষ থেকে প্রার্থীদের কোনো সহযোগিতা করা যায়নি। তাঁদের টাকা-পয়সা নেই। দলের পক্ষ থেকে একটা আশ্বাস ছিল, প্রার্থীদের ধারণা ছিল—তারা হয়তো কিছু আর্থিক সহযোগিতা পাবে। কিন্তু তাঁরা তা পাচ্ছে না।”
প্রার্থীদের অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে তিনি আরও বলেন, “দলের প্রার্থীরা মনে করছেন, দল ২৬টি আসন নিয়েই আছে। প্রার্থীরা প্রশ্ন তুলছেন আমরা তাহলে কেন নির্বাচন করব, আমাদের কেন নির্বাচনে নামানো হলো?”
চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের প্রার্থী সোহরাব হোসেন জানিয়েছেন, দল (জাতীয় পার্টি) থেকে সহযোগিতার সুযোগ নেই জানিয়ে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব পদত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
সোহরাব বলেন, “দল থেকে একেবারেই কোনো যোগাযোগ নেই। চেয়ারম্যান ও মহাসচিব আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন না। সাধারণ একজন মানুষের কাছে কত টাকা থাকতে পারে?
“নির্বাচনের মাঠে নির্বাচন পর্যন্ত সর্বোচ্চ খরচ হবে ২৫ লাখ টাকা। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা প্রতিদিন এক কোটি টাকা খরচ করছেন। আমরা এত টাকা পাব কোথায়? কীভাবে আমরা নির্বাচনী বৈতরণী পার করব? এটা কি আদৌ সম্ভব,” প্রশ্ন রাখেন তিনি।
আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ২৬টি আসন নিয়ে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা ‘বুকড’ হয়ে গেছেন বলেও অভিযোগ করেন সোহরাব।
দলের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “নেতারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের কথা বলছেন। এতে দলের নেতা-কর্মীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আমরা যখন মাঠে যাচ্ছি তখন মাঠের লোকজন আমাদের নিয়ে টিটকারি করছে। বাজে মন্তব্য করছে, বেঈমান বলে ডাকছে। যার কারণে বাধ্য হয়েই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালাম।”
সোহরাব ছাড়াও টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর) আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী জহিরুল ইসলাম, দিনাজপুর-২ আসনের মাহবুব আলম, সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের জাকির হোসেন, চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের রবিউল ইসলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ এর মোহাম্মদ শাহানুল করিম, গাজীপুর-৪ এর মো. সামসুদ্দিন খান, বরগুনা-১ এর মো. খলিলুর রহমান, সুনামগঞ্জ-১ এর আবদুল মান্নান তালুকদার, হবিগঞ্জ-২ এর শংকর পাল, হবিগঞ্জ-৪ এর আহাদউদ্দিন চৌধুরী শাহীন, গাজীপুর-১ ও ৫ আসনের প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন, এবং বরিশাল-২ ও ৫ আসনের প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।
গত ২১ ডিসেম্বর দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে আহ্বায়ক করে ১৫ সদস্যের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করে জাতীয় পার্টি।
কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার কাজলা গ্রামে নিজ বাড়িতে গতকাল মঙ্গলবার গণমাধ্যমকর্মীদের জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, “আওয়ামী লীগ ও তাদের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সারা দেশে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করছে। আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে জাতীয় পার্টির কিছু কিছু প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা কেন্দ্র থেকে আমাদের প্রার্থীদের কোনো আর্থিক সাপোর্ট দিতে পারছি না। এ জন্যই হয়তো তাদের অনেকটা হতাশা আছে এবং হতাশা থেকেই অনেকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। আমরা সার্বিক অবস্থা এখনো পর্যবেক্ষণ করছি। আমি নির্বাচন নিয়ে এলাকায় ব্যস্ত আছি, দলের চেয়ারম্যান নিজের এলাকায়। তাই বিষয়টি সমন্বয় করতে পারছি না।”
বরিশাল-২ ও বরিশাল-৫ আসনের প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস বলেন, “ফলাফল যদি আগেই নির্ধারিত হয়ে যায়, তাহলে সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কোনো মানে আছে বলে আমি মনে করি না।”
তিনি আরও বলেন, “এই নির্বাচনে ১৪ দলকে আসন বরাদ্দ দেওয়া হলো এবং সেখানে নৌকার প্রার্থী থাকবে না। জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসন বণ্টন করা হলো, সেখানেও নৌকার প্রার্থী থাকবে না। তার অর্থ হচ্ছে ফলাফল নির্ধারিত।”
তাপস বলেন, “জাতীয় পার্টির যেসব নেতা ২৬টি আসনে নির্বাচন করছেন, তারা মহাজোট এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করছেন। নির্বাচনের ফলাফল আসার আগেই ফলাফল নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে।”
“উনারা ২৬টি আসন নিয়ে তৃপ্ত। উনারা দেশ এবং দলের প্রার্থীদের কথা বিবেচনায় নিয়েছেন বলে মনে হয় না,” বলেন তিনি।
কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে তাপসের অভিযোগ, “রাজনৈতিকভাবে সহযোগিতা করার কথা ছিল কিন্তু উনারা শুরুই করেছেন অসহযোগিতা দিয়ে। এই প্রহসনের নির্বাচনে থাকতে আমার বিবেক সায় দেয়নি। তাই আমি আমার এলাকার জনগণের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”