মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত ছিল সরকার-নিরাপত্তা বাহিনী-গোয়েন্দা সংস্থা\n
ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া দুই সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে আসছে। সবশেষ গাজীপুরে সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলা, পালটা হামলা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যের মৃত্যু ঘিরে ফের সেই দাবিতে উচ্চকিত সংগঠন দুটি। বুধবার সন্ধ্যাতেও ঢাকায় আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতেও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
সংগঠনটির মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, জাতিসংঘের প্রতিবেদনের পর শেখ হাসিনা এখন আন্তর্জাতিভাবে স্বীকৃত সন্ত্রাসী। তার দল আওয়ামী লীগও সন্ত্রাসী দল। গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড শেখ হাসিনা সরকারের পুলিশ, প্রশাসন ও তার দলকে ব্যবহার করে মানুষ হত্যা করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছে। শেখ হাসিনা এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়। আর বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ রাখতে হবে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন বলেন, আয়নাঘরের ভয়ংকর চিত্র তো আমরা দেখলাম৷ একই দিনে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে এটা স্পষ্ট যে, শেখ হাসিনা এবং তার দল গণহত্যায় জড়িত৷ আমরা শুধু আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ নয়, আওয়ামী লীগের বিচারও চাই। সেজন্য যদি আইনের কোনো সংশোধন দরকার হয়, সকারকে তা করতে হবে। আর শুধু শেখ হাসিনা নয়, যারা যারা গণহতায় জড়িত, তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
আওয়ামী লীগ দল হিসেবে বৈধতা হারিয়েছে বলে মনে করেন মনিরা শারমিন। তিনি বলেন, পুরো গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড ওই দলটির প্রধান শেখ হাসিনা। ফলে, দল কিংবা শেখ হাসিনা কারওই আর রাজনীতিতিতে পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্সও অবশ্য মনে করেন, আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনার সম্পর্কে শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি।
প্রিন্স বলেন, বলেন, গত ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের পর যেভাবে আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে তাতে এখন যদি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চর্চা ঠিকমতো চলে, তাহলে আওয়ামী লীগের দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো সম্ভবনা দেখছি না। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে যারা অন্যদের হারিয়ে ক্ষমতায় আসে বা সরকারে আসে, তারা যদি আবার অপকর্মের সঙ্গী হয়, তখন কিন্তু পুরনোরা আবার সুযোগ পেয়ে যায়। সুতরাং, সব কথা বলার সময় বোধহয় এখনো আসেনি।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, শেখ হাসিনা গণহত্যার অপরাধ করেছেন। তিনি ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তার পুলিশ, প্রশাসন, দলীয় নেতাকর্মীদের ব্যবহার করে মানুষ হত্যা করেছেন। তার বিচার প্রক্রিয়া চলছে। যদি সুষ্ঠু বিচার হয়, তাহলে তিনি দোষী সাব্যস্ত হবেন। সেটা হলে তার আর রাজনীতিতে ফিরে আসার সুযোগ নেই।
বিএনপিও মনে করে, আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই। দলটির ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফিরে আসার চেয়েও জাতিসংঘের প্রতিবেদনের পর আমি ভাবছি, কোন মুখে আওয়ামী লীগ বা তাদের নেত্রী রাজনীতিতে ফিরে আসার চিন্তা করতে পারে! তাদের তো এখন লজ্জায় মুখ ঢেকে রাখার কথা।
তিনি আরও বলেন, জাতিসংঘের প্রতিবেদনের পর তাদের অপরাধ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এরপর তাদের আর রাজনীতি করার অধিকার আছে বলে আমি মনে করি না। এখানে শেখ হাসিনা একাই নন, তাদের দলের নেতারা সব পর্যায়ের রাজনীতি করার অধিকার হারিয়েছেন। হত্যা, গুমের সঙ্গে তারা জড়িত৷ তাদের রাজনীতির কোনো ভবিষ্যৎ আমি দেখি না।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে শেখ হাসিনা, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও তার দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের কথা থাকলেও সুপারিশে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হোক তা তারা চায় না।
সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাসুদ কামাল বলেন, জাতিসংঘের প্রতিবেদন যদি আওয়ামী লীগ ঠিকভাবে হ্যান্ডেল করতে পারে তাহলে এটা তাদের জন্য ইতিবাচক। আর যদি ঠিকভাবে হ্যান্ডেল করতে না পারে তাহলে এটা তাদের জন্য নেতিবাচক। জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন কিন্তু তারা উড়িয়ে দিতে পারবে না। কারণ এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আছে। এই প্রতিবেদনে ব্যক্তি শেখ হাসিনার অনুকূলে যায় এমন একটি তথ্যও নেই। এটি প্রমাণ হয়েছে, শেখ হাসিনা একজন অপরাধী। ফলে আমার বিবেচনায় শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের জন্য বোঝায় পরিণ হয়েছেন।
সিনিয়র এই সাংবাদিক বলেন, আওয়ামী লীগ যদি শেখ হাসিনাকে নিয়ে অগ্রসর হতে চায়, তাহলে সেটা হবে হ্যান্ডেল ভাঙা স্যুটকেসের মতো। আর যদি আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনাকে ত্যাগ করে নতুন করে দল পুনর্গঠন করে, অপরাধীদের বাদ দিয়ে নতুন নেতৃত্ব ঠিক করে, তাহলে আগামীতে খুবই ভালো অবস্থানে যেতে পারবে। আর শেখ হাসিনাকেসহ এগোতে চাইলে আগামীতে আওয়ামী লীগ তার ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় যাবে।
কিন্তু ঘটনাক্রমে আওয়ামী লীগকে এই ‘বোঝা’ টানতে হবে বলেও মনে করেন মাসুদ কামাল। তিনি বলেন, গত ৪০ বছরে শেখ হাসিনা দলটিকে এমনভাবে চালিয়েছেন যেন শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ এক হয়ে গেছে, সমার্থক হয়ে গেছে। ফলে নেতাকর্মীদের বড় একটি অংশ শেখ হাসিনা ছাড়া কিছু ভাবতে পারছে না। এটাই এখন তাদের সমস্যা।
তবে আওয়ামী লীগ সম্ভবত নিষিদ্ধ হবে না বলে জানান মাসুদ কামাল। তিনি বলেন, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ, জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তারা কোনো দল নিষিদ্ধের পক্ষে নয়।
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, জাতিসংঘের প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়নি। তারা কোনো দলকে নিষিদ্ধ চায় না। কিন্তু সমস্যা হলো, দলটির নেতা ও তাদের অনুসারীরা হত্যা, গণহত্যাসহ এত বেশি অপকর্ম করেছেন যে এখন তারা মানুষের কাছে যেতেই পারবে না।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনের পর তাদের জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে গেল বলে মনে করছেন ব্যারিস্টার ওমর ফারুক। তিনি বলেন, এই প্রতিবেদন এই সরকার করেনি, করেছে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। আর শেখ হাসিনা ও তার সহাযোগীদের বিচার হচ্ছে। তারা যদি দণ্ডপ্রাপ্ত হন, তাহলে রাজনীতি করার আর কোনো সুযোগই থাকবে না।
এই আইনজীবী মনে করেন, শেখ হাসিনা দেশের বাইরে বসে নানা কথা বলে পরিস্থিতি আরও খারাপ করে চলেছেন। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করছেন। এতে তার প্রতি, তার দলের প্রতি মানুষের ঘৃণা আরও বাড়ছে। তার চুপ থাকাই ভালো।