top ad image
top ad image
home iconarrow iconঘরের রাজনীতি

নির্বাচন পেছানোর ‘ষড়যন্ত্র’ দেখছে বিএনপি, সরকারের ‘পক্ষে’ এনসিপি-জামায়াত

নির্বাচন পেছানোর ‘ষড়যন্ত্র’ দেখছে বিএনপি, সরকারের ‘পক্ষে’ এনসিপি-জামায়াত
নির্বাচন নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি। গ্রাফিক্স: রাজনীতি ডটকম

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা থেমে নেই। রাজনৈতিক নেতারা প্রতিদিনই নির্বাচন নিয়ে নানা বক্তব্য দিচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিভিন্ন দলের কর্মী-সমর্থক তো বটেই, অন্য সবাইও ঘুরেফিরে নির্বাচন নিয়ে নিজেদের অভিমত তুলে ধরছেন। সবারই প্রশ্ন— নির্বাচন শেষ পর্যন্ত হবে তো? হলেও কবে হবে?

নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসসহ অন্য উপদেষ্টারাও বারবার বলে আসছেন, এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। সুনির্দিষ্টভাবে এই সময় নির্ধারণ করা হবে সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে। সব দল মিলে কম সংস্কার চাইলে ডিসেম্বরে এবং বেশি সংস্কার চাইলে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে।

সরকার বারবার এ কথা বললেও বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চাইছে। তারা সরকারসহ বিভিন্ন মহলের কার্যক্রমে সংস্কারের নামে নির্বাচন পেছানোর ‘ষড়যন্ত্র’ও দেখছে। তবে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও ইসলামী আন্দোলনসহ বেশকিছু দলই নির্বাচন প্রশ্নে সরকারকেই সমর্থন করছে। তাদের অবস্থান সরকারের ‘পক্ষে’ বলে অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

রোডম্যাপ পেলে ভোটের প্রস্তুতি নেবে বিএনপি, না পেলে আন্দোলন

নির্বাচন নিয়ে সরকার ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যেকার সময়ের কথা বললেও বিএনপি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চাইছে। এমনকি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে প্রয়োজনে রাজপথের কর্মসূচি দেওয়া হবে বলেও ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল দলটি।

এর মধ্যে গত সোমবার (৭ এপ্রিল) দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে তারা ডিসেম্বরে নির্বাচন আয়োজনের জন্য ‘রোডম্যাপ দেওয়ার আহ্বান’ জানাবে। আগামী বুধবার (১৬ এপ্রিল) প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করবে দলটি।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা জানিয়েছেন, ওই বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা কী বলেন, তার ওপর ভিত্তি করেই বিএনপি তাদের পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণ করবে। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনে প্রধান উপদেষ্টা সম্মতি দিলে তারা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করবেন। অন্যথা হলে যাবেন রাজপথের কর্মসূচির দিকে।

সংস্কারের জন্য নির্বাচন পেছানোর বিরোধিতা করছে বিএনপি। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দিতে সরকারের পক্ষ থেকে বাধা কোথায়, এ প্রশ্নও রয়েছে দলটির। সংস্কারকে চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে মেনে নিয়ে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দেওয়ার দাবি রয়েছে দলটির পক্ষ থেকে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বিবিসিকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বড় সংস্কার আর ছোট সংস্কার বলতে কী বোঝান, আমরা তো বুঝি না! কোনো সংস্কারই ছোট বা বড় নয়। আমরা বলেছিলাম, নির্বাচনমুখী যেসব সংস্কার, সেগুলো শেষ করে নির্বাচন দিয়ে দিন। কিন্তু এখন বড় সংস্কার বলতে উনি কী বোঝাচ্ছেন, সেটা পরিষ্কার করতে হবে। যদি উনি সংবিধান সংস্কারকে বড় সংস্কার মনে করেন, সেটাও আমাদের বলতে হবে। সংবিধান সংস্কার তো জাতীয় সংসদ ছাড়া হবে না।

সংস্কারের জন্য নির্বাচন আয়োজনে দেরি করার যৌক্তিকতা নেই উল্লেখ করে এই বিএনপি নেতা বলেন, সংবিধান সংস্কার ছাড়া এর বাইরে এমন আর কোনো সংস্কার প্রস্তাব নেই যা জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত হলে এক থেকে দেড় মাসের বেশি সময় লাগবে। আর সংবিধান সংশোধনীর যেসব বিষয়ে জাতীয় একমত্য তৈরি হবে সেগুলো চিহ্নিত করে চার্টার তৈরি করা যায়। নির্বাচিত সংসদ সেটি বাস্তবায়ন করবে। এর জন্য নির্বাচন পেছানোর দরকার নেই।

এগুলো নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য একটা পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু তার জন্য নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করতে বাধা কোথায়?— প্রশ্ন রাখেন বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ।

নির্বাচন বিলম্বিত করার ‘পাঁয়তারা’ও দেখছে বিএনপি

বিএনপি দাবি করলেও সরকারের নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা না করাকে সন্দেহের চোখে দেখছে বিএনপি। সরকার বারবার ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বললেও তাতে আশ্বস্ত হতে পারছে না দলটি।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত যেসব সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা পড়েছে সেগুলো নিয়ে সব রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন অংশীজনের মতামত পর্যালোচনা করা হবে। সব দল এসব প্রতিবেদনের যেসব সুপারিশে একমত হবে, সেগুলো নিয়ে তৈরি হবে জুলাই সনদ। এর ওপর ভিত্তি করে সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করবে।

জামায়াতে ইসলামী, এনসিপির মতো দলগুলো সরকারের এ প্রক্রিয়া ও সরকারের পক্ষ থেকে জানানো নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমায় আস্থা রাকছে। কিন্তু বিএনপি সাত মাসের এই সম্ভাব্য সময়সীমাকে (ডিসেম্বর থেকে জুন) দেখছে নির্বাচন নিয়ে ‘এক ধরনের অনিশ্চয়তা’ হিসেবে। তারা নির্বাচনকে ডিসেম্বরের পরে দেখতে চায় না।

সরকার নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা দেওয়ার পরও বিএনপি কেন সন্দেহ করছে— এমন প্রশ্নে বিএনপি নেতারা বলছেন ‘নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্রে’র কথা। সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্তত পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পক্ষের প্রচার এবং দুয়েকজন উপদেষ্টার মুখেও একই কথা বিএনপির এই সন্দেহকে আরও প্রকট করেছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, যেখানে মানুষ গণতন্ত্রের জন্য, গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য রক্ত দিয়েছে, গণঅভ্যুত্থান করেছে, সেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণের জন্য যদি এত অনিশ্চয়তা থাকে, সেটাকে আমরা স্বাভাবিক নয় বলেই মনে করি। আমরা কো-রিলেট করতে চাই, কিছু কিছু নতুন রাজনৈতিক দল ও পুরনো রাজনৈতিক দলের বক্তব্যে নির্বাচন বিলম্বিত করার পাঁয়তারা লক্ষ করা যায়।

‘সে কারণে সরকারের বক্তব্য এবং তাদের কথা ও কর্মকাণ্ড— সবকিছু বিবেচনা করলে দেখা যায় নির্বাচন নিয়ে একটা অনিশ্চিত পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। সেটি গণতন্ত্রের জন্য কল্যাণকর নয়। কারণ নির্বাচন যত দেরি হবে, গণতন্ত্র উত্তরণের রাস্তা তত কঠিন হবে,’— বলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য।

নির্বাচন কবে হবে, সেটা জানতেই তারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন বলেও জানান সালাহউদ্দিন আহমদ।

অন্য দলগুলো কী বলছে?

বিএনপি যখন ডিসেম্বরে নির্বাচনের জন্য এখনই রোডম্যাপ চাইছে, তখন জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রদের নতুন দল এনসিপির আগামী বছরের জুন পর্যন্ত সরকারকে সময় দিতে কোনো কুণ্ঠা নেই। তাদের যুক্তি, এ সময়ের মধ্যেই সরকার যেন প্রয়োজনীয় সংস্কার ও গণহত্যার বিচারের কার্যক্রম শুরু করতে পারে।

জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র ও দলটির প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বিবিসি বাংলাকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা তো বলেই দিয়েছেন জুনের মধ্যে নির্বাচন। তিনি বলেছেন, বেশি সংস্কার চাইলে ইলেকশন হবে জুনে। উনি যেহেতু জুন পর্যন্ত চলে গিয়েছেন, সুতরাং বেশি সংস্কার নিয়েই নির্বাচন হবে। এরপর নির্বাচন কোন কারণে পেছাবে? এরপর নির্বাচন যাওয়ার তো কোনো কারণ দেখি না।

এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেনের অবস্থানও একই। তিনি বলেন, একটি গণঅভ্যুত্থানের পরে সংস্কার হওয়াটাই স্বাভাবিক। ডি‌সেম্বর থেকে জুন— আমরা মনে করি এ সময়ের মধ্যেই সরকার সংস্কার ও বিচারের দৃশ্যমানতার দিকে সরকার এগুতে পারে। এর মধ্যেই নির্বাচন আয়োজনের যে কার্যক্রম সেটা সম্পূর্ণ করা সম্ভব।

ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের রোডম্যাপ না পেলে বিএনপি যদি আন্দোলনে যায়, সে আন্দোলনে তাদের জামায়াতে ইসলামী বা এনসিপিকে পাশে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই জানাচ্ছেন দলগুলোর নেতারা।

জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, আন্দোলনটা কার বিরুদ্ধে হবে? আন্দোলনটা তো হবে দাবি আদায়ের জন্য। সেই দাবি নিয়ে আলোচনার জায়গা আছে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলা যায়, ঐকমত্য কমিশনে বক্তব্য তুলে ধরা যায়। আর যদি কোনো অবস্থাতেই যৌক্তিক দাবি আদায় করা না যায়, তখন আপনি জনগণকে জানাতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি।

দলগুলোর মধ্যে যখন এমন মতভেদ তখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঐকমত্য কমিশন ধারাবাহিকভাবে বৈঠক শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। এসব বৈঠক ও দলগুলোর আনুষ্ঠানিক মতামত পাওয়ার পরই সংস্কার এবং নির্বাচনের সময় নিয়ে ঐকমত্যের পথ স্পষ্ট করতে চায় সরকার। কিন্তু বড় দলগুলোর এখন পর্যন্ত যে মনোভাবে, তাতে ঐকমত্য গড়ে তোলাটাও হয়তো সহজ হবে না।

[বিবিসি বাংলা অবলম্বনে]

r1 ad
r1 ad
top ad image