দুই পুত্রবধূকে নিয়ে দেশে ফিরলেন খালেদা জিয়া\n
জুলাই অভ্যুত্থানের গর্ভে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে গণতান্ত্রিক চর্চায় খালেদা জিয়ার ভূমিকা নিয়ে প্রত্যাশার কথা জানিয়েছে।
এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠন সারজিস আলম নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘আমরা বিশ্বাস করতে চাই— জুলাই অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের আপামর ছাত্র-জনতা যে আকাঙ্ক্ষাগুলোকে বুকে ধারণ করে অকাতরে রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে, সেই আকাঙ্ক্ষাগুলোকে সামনে রেখে তিনি (খালেদা জিয়া) ও তার দল বিএনপি আপসহীনভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষায় দেশের স্বার্থকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করে যাবেন।’
দীর্ঘদিন ধরে জটিল বিভিন্ন রোগে ভুগতে থাকা খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনের পথে রওনা হন গত ৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায়। লন্ডনের বিশেষায়িত বেসরকারি হাসপাতাল দ্য লন্ডন ক্লিনিকের চিকিৎসক জন প্যাট্রিক কেনেডির নেতৃত্বে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকদের কাছে চিকিৎসা নেন তিনি।
চিকিৎসা শেষে খালেদা জিয়া গিয়ে ওঠেন লন্ডনে তার ছেলে তারেক রহমানের বাড়িতে। সেখানে দীর্ঘ সাত বছর পর পরিবারের সঙ্গে ঈদও উদ্যাপন করেন। লন্ডনে হাসপাতাল ও ছেলের বাড়িতে চার মাস কাটিয়ে দুই পুত্রবধূকে নিয়ে মঙ্গলবার সকালে দেশে অবতরণ করেন তিনি।
বিমানবন্দর থেকে নিজ বাসভবনে ফেরার পথে গাড়িতে খালেদা জিয়া। পেছনের আসনে তার ছেলে তারেক রহমানের স্ত্রী জুবাইদা রহমান। ছবি: ফোকাস বাংলা
খালেদা জিয়া এখনো বিএনপির জন্য অপরিহার্য বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ। তিনি বলছেন, দেশের রাজনীতির জন্য তিনি ভূমিকা রাখতে পারেন।
অধ্যাপক সাব্বির রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিকে খালেদা জিয়ার এখনো অনেক কিছু দেওয়ার আছে। জাতীয় ঐক্য তিনি যদি মিন করেন (সত্যিই চান), সেটি দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। খালেদা জিয়া বিএনপিকে নতুন করে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের উপযোগী করে সাজাতে চাইলে সেটিও সম্ভব। আমার ধারণা, তারেক রহমানও সেভাবেই চিন্তা করেন।’
তবে খালেদা জিয়ার ন্যূনতম শারীরিক সক্ষমতা থাকা পর্যন্তও বিএনপি তাকে সক্রিয় রাজনীতিতে চাইবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক সাব্বির। তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়া এখনো বিএনপির জন্য অপরিহার্য। তাকে ছাড়া দল চলতে পারবে কি না, সেটি অন্য আলোচনা। তবে তিনি দলের মধ্যে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি করতে পেরেছেন (তারেক রহমান)। তারপরও আপাতত এই মুহূর্তে মনে হয় না তাকে ছাড়া দল এগোতে চাইবে।’
কেবল রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা নয়, রাজনৈতিক দলগুলোও দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে খালেদা জিয়ার বড় ভূমিকা প্রত্যাশা করছে। খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানিয়ে রাজনীতিবিদরা বলছেন, দীর্ঘ রাজনৈতিক পরিক্রমায় অভিজ্ঞ খালেদা জিয়া রাজনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেন।
খালেদা জিয়া প্রচণ্ড মানসিক শক্তির অধিকারী মন্তব্য করে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘খালেদা জিয়ার দেশে ফেরার খবর শুধু বিএনপি নয়, দেশের মানুষের জন্যও স্বস্তির খবর। তিনি এমন একটি সময়ে ফিরলেন, যখন আমরা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। এমন একটি সময়ে তার ইতিবাচক ভূমিকা সামগ্রিকভাবে দেশের রাজনীতিতে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে পারে।’
খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা বিএনপির রাজনীতিতে নতুন গতি দেবে বলে মনে করেন সাইফুল হক। পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্যও তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে মনে করেন তিনি।
‘খালেদা জিয়ার আলাদা একটা মর্যাদা, সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতা আছে। বিএনপির জন্ম ক্যান্টনমেন্টে হলেও এরশাদ সরকারের ৯ বছরে তার নেতৃত্বেই স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপি সত্যিকারের রাজনৈতিক দল হয়ে উঠেছিল। এরপর নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের প্রশ্নে, মানুষের ভোটের অধিকারের প্রশ্নে তার অনমনীয় মনোভাব ক্রমশই স্পষ্ট হয়েছে,’— বলেন সাইফুল হক।
খালেদা জিয়ার গাড়িতে তার দুই পুত্রবধূ জুবাইদা রহমান ও সৈয়দা শামিলা রহমান। ছবি: ফোকাস বাংলা
তিনি আরও বলেন, ‘শাসক শ্রেণির রাজনীতি যারা করেন, তাদের মধ্যে খালেদা জিয়া নিজেকে ব্যতিক্রমী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার জন্য একটি আলাদা মর্যাদার জায়গা তৈরি হয়েছে, তিনি নিজেই একটি আলাদা উচ্চতা তৈরি করেছেন।’
‘তার এই অবস্থানকে রাজনৈতিক দলগুলো ইতিবাচক হিসেবেই দেখবে বলে আমার বিশ্বাস। শারীরিকভাবে তিনি যতটুকুই সক্রিয় থাকুন না কেন, আমার মনে হয় সেটুকু সক্রিয়তা দিয়েই দেশের রাজনীতির একটি আইকনিক চরিত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। ভোটের অধিকারের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, অবাধ নির্বাচনের জন্য যারা আন্দোলন-সংগ্রাম করছেন, খালেদা জিয়া তাদেরও অনুপ্রাণিত করবেন,’— বলেন সাইফুল হক।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফেরায় আনন্দিত বলে জানিয়েছেন জুলাই অভ্যুত্থানের আগের তিন সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জি এম কাদের)। তিনিও দেশের ‘ক্রান্তিকালে’ গণতান্ত্রিক চর্চায় খালেদা জিয়ার ইতিবাচক ভূমিকা প্রত্যাশা করছেন।
জি এম কাদের এক বিবৃতিতে বলেন, পরস্পরের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ এবং রাজনৈতিক দল ও জনগণের মধ্যে বিভক্তি ও প্রতিহিংসার রাজনীতির প্রসার ঘটছে। দেশ প্রতিদিন এক সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় খালেদা জিয়ার মতো অভিজ্ঞ ও জনপ্রিয় একজন রাজনীতিবিদ জণগনের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহনশীলতা, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য তৈরির মাধ্যমে দৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলবেন এবং দেশের সংকটময় পরিস্থিতির অবসানে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবেন— এমনটিই প্রত্যাশা করি।
খালেদা জিয়াকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দর থেকে শুরু করে গুলশানের বাসভবন পর্যন্ত সড়ক বিএনপির নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে জনসমুদ্রে পরিণত হয়।
দলের নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়াকে ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রতীক’ বলে অভিহিত করে বলেছেন, তার শারীরিক উপস্থিতি দলটির রাজনীতিকে সুসংহত করবে।
খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানাতে পাবনা থেকে ঢাকায় ছুটে এসেছিলেন সেখানকার এক উপজেলা বিএনপির কমিটির সদস্য আলমগীর হোসেন। দল ও দেশের জন্য খালেদা জিয়ার নেতৃত্বই প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দর থেকে গুলশানের পথে সড়কে নামে বিএনপির নেতাকর্মীদের ঢল। ছবি: ফোকাস বাংলা
আলমগীর রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার উন্নত চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ না দিয়ে খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু খালেদা জিয়া আপসহীন ও লড়াকু নেত্রী। আমাদের মাঝে ফিরে আসায় বিএনপির নেতাকর্মীরা নতুন উদ্যমে রাজনীতি করার প্রেরণা পেয়েছি। তার নেতৃত্বেই দেশ গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাবে।’
দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক অঙ্গনে খালেদা জিয়ার ভূমিকা ইতিবাচক হবে বলেও দল হিসেবেও মনে করছে বিএনপি।
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ওনার দেশে ফেরা দেশ ও জাতির জন্য অনেক খুশির খবর। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা সহায়ক হবে, গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা আরও সহজ করবে।