অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ
অন্তর্বর্তী সরকার : প্রশ্ন না তোলা নিয়ে কিছু প্রশ্ন
কোনো আদালতে অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না- এমন এক অধ্যাদেশ চূড়ান্ত অনুমোদন পেলেও আইন বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিবিদরা জানতে চান, ‘কেন প্রশ্ন তোলা যাবে না?’
গণমাধ্যমের খবর, ‘অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ, ২০২৪'-এর খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ, যেখানে বলা হয়েছে, ‘অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে আদালতে গিয়ে অবৈধ ঘোষণা বা বাতিল করা যাবে না, কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নেওয়ার দিন পর্যন্ত হবে সরকারের মেয়াদ।’
মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশিদ বলেছেন, ‘উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন দেওয়ার পর অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। চূড়ান্ত হলে নিয়মানুযায়ী অধ্যাদেশ আকারে আদেশ জারি করা হবে।’
আইন বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিবিদরা বলছেন, যে কোনো কিছু নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে, তবে সেটা আলোচনা বা সকলের মতামতের ভিত্তিতে সমাধান করতে হবে। কেউ বলছেন, এমন অধ্যাদেশের প্রয়োজন ছিল না। আবার কেউ বলছেন, ‘এটা এক ধরনের ইনডেমনিটি। আগের কোনো ইনডেমনিটি টেকেনি, ভবিষ্যতে এটাও টিকবে না।’
কী আছে অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ?
অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে এবং সংবিধান বা অন্য কোনো আইন দিয়ে নির্ধারিত দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে সাহায্য ও সহায়তা দেবে অন্তর্বর্তী সরকার। বিলুপ্ত হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতোই থাকছে প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টাদের পদমর্যাদা। উপদেষ্টা পরিষদে নিয়োগ পাবেন না ২৫ বছরের কম বয়সিরা। সরকারি কর্মচারীদের সহায়তায় অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করবে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তী সরকার গঠন করা হয়। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত হওয়ায় বর্তমানে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা এবং প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টার পদ বলে কিছু নেই। এ কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের আইনি ভিত্তি নিয়ে যাতে প্রশ্ন না ওঠে, সে জন্য অধ্যাদেশ জারি করা হচ্ছে। গত ১৯ সেপ্টেম্বর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ।
এতে বিলুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টাদের মতোই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং উপদেষ্টাদের পদমর্যাদা, সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় উপদেষ্টাদের সর্বোচ্চ সংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া থাকলেও এখন উপদেষ্টাদের সর্বোচ্চ সংখ্যা বেঁধে দেওয়া হচ্ছে না। খসড়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ-সংক্রান্ত ধারায় বলা হয়েছে, যে তারিখে প্রধান উপদেষ্টা দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, সেই তারিখ থেকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন প্রধানমন্ত্রী কার্যভার গ্রহণ করার তারিখ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার বহাল থাকবে। এর আগে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মেয়াদ ছিল ৯০ দিন। অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ কী হবে, তা-ও ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে অধ্যাদেশে।
সংবিধান এবং আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়া এবং নতুন সংসদ গঠিত হইবার পর প্রধানমন্ত্রী যে তারিখে তাহার পদের কার্যভার গ্রহণ করিবেন, সেই তারিখের মধ্যবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক প্রয়োগকৃত সকল ক্ষমতা, প্রণীত সকল অধ্যাদেশ, বিধিমালা, প্রবিধানমালা, জারীকৃত প্রজ্ঞাপন, প্রদত্ত আদেশ, কৃতকার্য, গৃহীত ব্যবস্থা আইন অনুযায়ী যথাযথভাবে প্রয়োগকৃত, প্রণীত, জারীকৃত, প্রদত্ত, কৃত এবং গৃহীত হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে এবং বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টসহ অন্য কোনো আদালত বা কর্তৃপক্ষ ইহাদের বৈধতা সম্পর্কে কোনোভাবেই কোনো প্রশ্ন উত্থাপন কিংবা ইহাদেরকে অবৈধ বা বাতিল করিতে পারিবে না। প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টাদের নিয়োগ নিয়ে ত্রুটি থাকলে সে জন্য কোনো কাজ অবৈধ হবে না। বিদ্যমান অন্যান্য আইনে যা কিছুই বলা থাকুক না কেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময় প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শ নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে কাজ করতে হবে। জরুরি অবস্থা ঘোষণার বৈধতার জন্য প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শ নিতে হবে রাষ্ট্রপতিকে।
‘যেখানে বলা হয় প্রশ্ন তোলা যাবে না, সেখানেই সন্দেহ...’
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এই অধ্যদেশের কোনো প্রয়োজন ছিল না। কারণ, আপিল বিভাগের অনুমতি নিয়েই রাষ্ট্রপতি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছেন। আর যে কথাটি বলা হচ্ছে, প্রশ্ন তোলা যাবে না, কেন প্রশ্ন তোলা যাবে না? সব কিছু নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে। সেটাও সকলের মতামতের ভিত্তিতে সমাধান হতে পারে।’
তবে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এটা যেন নিজের চরিত্র নিয়ে নিজেই সার্টিফিকেট দেওয়ার মতো অবস্থা। আমি কতদিন ক্ষমতায় থাকবো, সেটি নিয়ে অধ্যাদেশ জারি করা হলে প্রশ্ন তো উঠতেই পারে। আমি এটাকে ইনডেমনিটি মনে করি। এর আগেও কোনো ইনডেমনিটি টেকেনি, এটাও টিকবে না। আর যেখানে বলা হয়, প্রশ্ন তোলা যাবে না, সেখানেই মানুষের মনে সন্দেহ থাকে।’
জাতীয় পার্টির অতিরিক্ত মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এই অধ্যাদেশটা দিয়েছে তাতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কারণ, আমাদের সংবিধানের কোথাও অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যবস্থা নেই। আবার আগে যেটা ছিল, সংসদ ভেঙে দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে, ইতিমধ্যে ৯০ দিন পার হয়ে গেছে। ফলে শুধু অধ্যাদেশে বিষয়গুলো কাভার করবে না। রাজনৈতিক সমঝোতা হলেই কেবল বিষয়টি সমাধান হতে পারে।’
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এই অধ্যাদেশে কোনো অসুবিধা নেই। আদালত তো তাদের বৈধতা দিয়েছে। সেটা হয়ত আরো একটু পরিস্কার করার জন্য অধ্যাদেশ জারি করা হচ্ছে। আবার মেয়াদের কথা যেটা বলা হয়েছে, ত্রয়োদশ সংসদের মাধ্যমে নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহনের আগ পর্যন্ত- সেটাও ঠিক আছে। কিন্তু এটা কতদিন হবে? সেই প্রশ্নে আমি বলবো, যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে। তা না হলে মানুষের মধ্যে ভুল বার্তা যেতে পারে, সেটা সরকারকে বুঝতে হবে।’
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মতামত চেয়েছিলেন। আমি আপিল বিভাগকে বলেছি, বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের স্বার্থে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বৈধতা দেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। পরে সুপ্রিম কোর্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বৈধতা দিয়ে মতামত দিয়েছেন।’
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সাইদ আহমেদ রাজা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম, এভাবে দায়মুক্তি না দিয়ে উচ্চ আদালতে এটা নিয়ে শুনানি হতে পারে। আমরা সবাই সেখানে শুনানি করলাম। সব পক্ষের শুনানি শেষে আদালত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিলেন। কিন্তু সেটা না করে এভাবে অধ্যাদেশে দায়মুক্তি নেওয়ায় প্রশ্ন তো থেকেই যাবে। আজ না হোক পরে তো কেউ এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারেন। কারণ, আমাদের সংবিধানে তো অন্তর্বর্তী সরকার নেই। এ কারণে উচ্চ আদালত থেকে শুনানির মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারতো।’
অন্তর্বর্তী সরকারের ৩ মাস
এই তিন মাসে মোটাদাগে পাঁচটি বড় কাজ হয়েছে বলে দাবি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের। তিনি বলেন, ‘একটি হলো স্মুথ একটি ট্রানজিশন (শান্তিপূর্ণভাবে পরিবর্তন) হয়েছে। দুই. একটি ভঙ্গুর অবস্থা থেকে অর্থনীতি উদ্ধার হয়েছে। তিন. ব্যাপক বৈশ্বিক সহায়তা পাওয়া গেছে। চার. সংস্কারের পথরেখা দেওয়া হয়েছে। সংস্কারের পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ হবে, তখন সংস্কার কতটুকু করা হবে এবং সেটার ওপর নির্ভর করবে নির্বাচনের তারিখ। পাঁচ. এই তিন মাসে বন্যা, গার্মেন্টে অস্থিরতাসহ অনেকগুলো সমস্যা ছিল। সেসব সমস্যা থেকে দেশকে উত্তরণের দিকে নেওয়া হয়েছে। আমরা চেষ্টা করেছি এই সমস্যাগুলো কতটা ভালোভাবে মোকাবিলা করা যায়।’
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘তিন মাসেও কোনো সংস্কার কাজ শুরু করেনি সরকার। যেটা হয়েছে, পুলিশের উর্ধ্বতন ৫ জন পালিয়ে গেছেন, সেখানে ৫ জন বসানো হয়েছে। এটা তো সংস্কার না। আবার অর্থনীতিতে নানা কথা বলা হচ্ছে, সেখানেও কোনো সংস্কার কাজ শুরু হয়নি। কিছু রেমিট্যান্স বেড়েছে। গতি হয়ত ভালোর দিকে, সেটা তো আর সংস্কার বলা যাবে না। ফলে সংস্কারটা শুরু করা দরকার। খাদ্যে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১২ শতাংশের বেশি। এটা তো বিরাট ব্যাপার। এখানে নজর দরকার।’
সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘তিন মাসে তো এমন বড় কোনো পরিবর্তন দেখা যাবে না। কিন্তু ইতিবাচক দিকে যাচ্ছে কিনা সেটা বলা যায়। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে বিশেষ মনোযোগ ও খাদ্যে মূল্যস্ফীতি টেনে ধরা দরকার। প্রতিদিনকার সবজি, চাল, ডাল, তেল এসব জিনিস কিনতে যে অর্থ মধ্যবিত্ত ও নি¤œ মধ্যবিত্তের হাতে আছে, তাতে সবাই খুব কষ্টে আছেন। সরকার যে কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে সেটা দেখা যাচ্ছে না। পাশাপাশি একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দিকে যেতে হবে, সেই কাজেও মনোযোগ দরকার।’