top ad image
top ad image
home iconarrow iconঘরের রাজনীতি

পতনের ৬ মাস, কার্যক্রমে ফেরার প্রয়াসে আ. লীগ

পতনের ৬ মাস, কার্যক্রমে ফেরার প্রয়াসে আ. লীগ
৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে অবস্থিত আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়, দেওয়া হয় আগুন। ভবনটি এখনো এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় রয়েছে। আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের ছবিটি সম্প্রতি তোলা। রাজনীতি ডটকম ফাইল ছবি

দীর্ঘ ১৬ বছর। স্বাধীনতার পর একটানা সর্বোচ্চ সময় ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড। দেড় দশকে একের এক পর মেগা প্রকল্পে দেশের অবকাঠামো খাতে নজিরবিহীন উন্নয়ন। জিডিপি প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয়ে নতুন মাইলফলক। আর্থিক দুর্নীতি, বাকস্বাধীনতা রোধ, ভোটাধিকার হরণসহ নানা অভিযোগ থাকলেও ততদিনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ‘বিকল্পহীনতা’র বয়ান প্রায় প্রতিষ্ঠিত। দেড় দশক ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর লাগাতার আন্দোলন-সংগ্রামেও সেই বয়ান ভাঙা সম্ভব হয়নি।

শেষ পর্যন্ত ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে পতন সেই ‘বিকল্পহীন’ শেখ হাসিনা এবং তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের। আজ বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) পূর্ণ হলো গণআন্দোলনের বিজয় আর আওয়ামী লীগের পতনের ছয় মাস।

ক্ষমতার মসনদে দেড় দশকের পরিক্রমায় ক্রমেই ফ্যাসিবাদের সব বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকা শাসনের অবসানের ছয় মাস পূর্তির দিন আজ। ক্ষমতাসীন ও তাদের ছত্রছায়ায় ঘনিষ্ঠদের লুটপাট আর অর্থপাচারের পাশাপাশি গুম-খুন-বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে ছেদ টানার ছয় মাস পূর্তির দিন।

Celebration Of 5th August 05-08-2025 (2)

৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন বিকেলে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে ছাত্র-জনতার উল্লাস। রাজনীতি ডটকম ফাইল ছবি

সরকার পতনের সূচনা

ছয় বছর আগে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনে উত্তাল হয়েছিল দেশ। আওয়ামী লীগ তখন টানা দ্বিতীয় মেয়াদ পূর্তির সম্মুখে দাঁড়িয়ে। শেষ পর্যন্ত তৎকালীন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে ‘কোটাই বাতিল’ ঘোষণা দিয়ে আন্দোলন সামাল দেন। আট মাসের মাথায় ফের আরেক নির্বাচনে জিতে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।

গত বছরের জানুয়ারিতে টানা চতুর্থ নির্বাচনে জয় আর টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আরোহনের নতুন রেকর্ড গড়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। এবার সরকার গঠনের পরপরই শেখ হাসিনা এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, সরকারের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্রকারী’রা সক্রিয়। মাস ছয়েকের মধ্যেই বড় ধরনের ঝড় তুলে সরকারকে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করবে তারা।

টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় আসার পথে প্রথম ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর থেকেই অবশ্য শেখ হাসিনা একই ষড়যন্ত্রের কথা বলে আসছিলেন। ফলে ২০২৪ সালের শুরুর দিকে সেই একই ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ নিয়ে কেউ হয়তো খুব একটা মাথা ঘামাননি। শেখ হাসিনা নিজেও অভ্যাসবশতই সে কথা বলেছিলেন কি না, তেমন ধারণাও করে থাকেন অনেকেই। কিন্তু সত্যি সত্যিই সরকার গঠনের ছয় মাসের মাথায় ছয় বছর আগের থমকে যাওয়া আন্দোলন রাজপথে ফিরে এলে তা নাড়িয়ে দেয় সরকারকে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আগেরবারের অভিজ্ঞতা ও টানা ক্ষমতায় থাকার অতি আত্মবিশ্বাসে এবারের কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে সরকার কিছুটা হালকাভাবেই নিয়েছিল। যে কারণে ছয় বছর আগে কোনো না কোনোভাবে মীমাংসিত ইস্যুটি আদালতে গড়ালে এবং তাকে ঘিরে ফের রাজপথে আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করলেও সরকার তেমন বিচলিত হয়নি।

বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, এমনকি আন্দোলনকারীরা যখন প্রায় টানা দুই সপ্তাহ ধরে রাজপথে, সে অবস্থাতেও দলকে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা না দিয়েই শেখ হাসিনা চলে যান চীন সফরে। সফরকালে শেখ হাসিনার অবর্তমানে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা তাদের বক্তব্য বিবৃতির মাধ্যমে আন্দোলনকে আরও উসকে দেন। সেই আন্দোলনের ‘আগুনে’ চূড়ান্ত ‘ঘি’ ঢালেন শেখ হাসিনা নিজেই, চীন থেকে দেশে ফেরার পর সংবাদ সম্মেলনে।

Celebration Of 5th August 05-08-2025 (1)

৫ আগস্ট সরকার পতনের পর গণভবনে ঢুকে পড়ে ছাত্র-জনতা। গণভবনের প্রায় সবকিছুই সেদিন যে যার মতো নিয়ে যান। রাজনীতি ডটকম ফাইল ছবি

রক্তের পথ বেয়ে ক্ষমতার পতন

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত ঢাকায় হলেও ধীরে ধীরে তা সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে। ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরাও (চাকরি) পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা (চাকরি) পাবে?’

শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যে আন্দোলনকারীদের ক্ষোভ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। সেদিন মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা স্লোগান তোলেন, ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার’। শিক্ষার্থীদের এই স্লোগান নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়।

পরদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আন্দোলনকারীদের সামলাতে ছাত্রলীগই (বর্তমানে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন) যথেষ্ট। ছাত্রলীগও সেই ঘোষণাকে আক্ষরিক অর্থেই ধারণ করে। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ। পরদিন দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। সেদিন রংপুরে দুপক্ষের সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। একই দিন ঢাকায় দুজন ও চট্টগ্রামে তিনজন প্রাণ হারান।

১৬ জুলাই পুলিশের সামনে বুক পেতে দাঁড়ানো অবস্থায় আবু সাঈদের গুলিতে মৃত্যুর ঘটনার ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়লে তা আন্দোলনকে দাবানলের মতো ছড়িয়ে দেয় সারা দেশে। ১৮ জুলাই থেকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ বাড়তে থাকে। পরবর্তী এক সপ্তাহের মধ্যে দুই শতাধিক প্রাণহানির সাক্ষী হয় দেশ।

এর মধ্যে সরকার ইন্টারনেট শাটডাউন করে। সারা দেশে ব্যাপক ধরপাকড় হয়। জারি করা হয় কারফিউ পর্যন্ত। কিন্তু আন্দোলনের গতি দিন দিন বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে রাজপথে রক্তের পরিমাণও বাড়তে থাকে। আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে তুলে নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে তাদের দিয়ে আন্দোলন বন্ধের ঘোষণাও দেওয়ানো হয়। কিন্তু বাইরে থাকা সমন্বয়করা স্পষ্ট ঘোষণা দেন, চাপের মুখে আন্দোলন স্থগিতের সেই ঘোষণা ছাত্রসমাজ মানবে না।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে নানা শ্রেণিপেশার মানুষের সম্পৃক্ততাও আন্দোলনে বাড়তে থাকে। রাজনৈতিক দলসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন জানান। ক্রমেই আন্দোলনের দাবিও সরকার পতনের দিকে ধাবিত হতে থাকে। ছাত্রদের মধ্যে সরকার পতনের দাবি তোলার ২ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে দ্রোহযাত্রা নিয়ে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। সেখানে দেওয়া বক্তব্যে তিনি সরকারের পদত্যাগের দাবি জানান।

পরদিন ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি থেকে সরকার পতনের এক দফা দাবি ঘোষণা করা হয়। পরদিন থেকে এক দফা দাবিতেই অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। ৫ আগস্ট ঘোষণা করেন মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি।

এর মধ্যেই ১৬ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় আট শ মানুষ প্রাণ হারান। যুদ্ধবিগ্রহ বা সশস্ত্র আন্দোলন বাদ দিলে কোনো আন্দোলন ঘিরে এত অল্প সময়ে এত বেশি প্রাণহানির ঘটনা কেবল বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই বিরল। সেই রক্তের পথ বেয়েই সরকার পতনের পথ তৈরি হয়।

Celebration Of 5th August 05-08-2025 (3)

সরকার পতনের দিন যে যার মতো নিয়ে যাচ্ছেন গণভনের জিনিসপত্র। রাজনীতি ডটকম ফাইল ছবি

পতনের দিন

৫ আগস্ট সকাল থেকেই ঢাকামুখী ছাত্র-জনতার ঢল নামে। দুপুরের আগেই রাজধানীর সবগুলো প্রবেশ পথ ঘিরে তৈরি হয় জনস্রোত। সারা দেশ থেকে মানুষ ছুটে আসতে থাকে সরকার পতনের এক দফা দাবি আদায় করে নিতে। কেবল যাত্রাবাড়ী ও আব্দুল্লাহপুর ঘিরে একেকটি স্থানেই পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটে।

আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ছাত্র-জনতার সেই স্রোতকে মোকাবিলা করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। শেষ পর্যন্ত সামরিক বাহিনী দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকা শেখ হাসিনা একা হয়ে পড়েন। গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেওয়া আন্দোলনের মুখে আর ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে পারেননি তিনি।

৫ আগস্ট দুপুর আড়াইটার দিকে জানা যায়, গণভবন কেবল নয়, হেলিকপ্টারে চড়ে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। পরে জানা যায়, আকাশপথে ভারতের পথে রওয়ানা দেন তিনি। ক্ষমতা ছেড়ে সেখানেই আশ্রয় নেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। সারা দেশে দলের নেতাকর্মীরাও গা ঢাকা দিতে বাধ্য হন। এর মধ্য দিয়েই অবসান ঘটে শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের টানা ১৬ বছরের শাসনের।

Celebration Of 5th August 05-08-2025 (4)

গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন ঢাকার রাজপথে মানুষের উল্লাস। রাজনীতি ডটকম ফাইল ছবি

গ্রেপ্তার-পলায়ন-আত্মগোপন, সাংগঠনিক কার্যক্রমে অদৃশ্য

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের তিন দিনের মাথায় ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব গ্রহণ করে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে পতনের পর থেকেই গণআন্দোলনে চালানো হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রায় নেতার নামেই মামলা হতে থাকে। আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাদের মধ্যেও যারা আন্দোলনে হত্যা-নির্যাতনে জড়িত ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হতে থাকে। একই সঙ্গে চলতে থাকে গ্রেপ্তার।

একে একে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা গ্রেপ্তার হন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের মন্ত্রী, এমপিরা কারাবরণ করতে থাকেন। বিভিন্ন মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের রিমান্ডও মঞ্জুর করা হয়। এখনো বিভিন্ন মামলায় পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দফায় দফায় তাদের রিমান্ড মঞ্জুর করছেন আদালত।

এদিকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ নেতাদের একটি অংশ আশ্রয় নেন দেশের বাইরে। অনেক নেতা পালিয়ে ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে আশ্রয় নিয়েছেন বলে খবর এসেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। এর বাইরে আওয়ামী লীগের বাকি নেতাদের সবাই রয়েছেন আত্মগোপনে।

দলের নেতাদের এমন দশায় সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগ পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। বলতে গেলে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে অদৃশ্য হয়ে যায়। শুরুর দিকে শেখ হাসিনার সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিয়মিত উপস্থিত হতে থাকেন। বিভিন্ন সময়ে অবশ্য তিনি পরস্পরবিরোধী বিভিন্ন তথ্য দেন। পতনের পর শুরুর দিনগুলোতে আওয়ামী লীগ একমাত্র দৃশ্যমান ছিল কেবল তার মিডিয়া উপস্থিতিতেই।

মাসখানেক যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দুয়েকজন নেতা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভার্চুয়াল বার্তা দিতে শুরু করেন। এর মধ্যে বেশকিছু কথপোকথনের অডিও ক্লিপও ভার্চুয়াল জগতে ছড়িয়ে পড়ে। ওইসব কথপোকথনে আওয়ামী লীগ সভাপতিকে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করতে শোনা যায়।

দুই-তিন মাস পর আওয়ামী লীগ নেতাদের পতনের ‘ট্রমা’ কিছুটা কাটলে তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব হয়ে উঠতে থাকেন। ধীরে ধীরে তারা দলের নেতাকর্মীদের ‘আশ্বস্ত’ করতে নানা বার্তা দিতে শুরু করেন। সেই সঙ্গে চলতে থাকে অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা। তবে ক্ষমতায় থাকা ১৬ বছরের দুর্নীতি-অনিয়ম, গুম-খুনসহ জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময়কার হত্যা-নির্যাতন নিয়ে দলটির নেতাদের মধ্যে কোনো ধরনের অনুতাপ দেখা যায়নি।

Awami League Office At Bangabandhu Avenue File Photo 05-02-2025 (1)

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ভেতরের অংশ এভাবেই পুড়ে ছাই হয়েছে, এখনো ভবনটি রয়েছে পরিত্যক্ত অবস্থাতেই। রাজনীতি ডটকম ফাইল ছবি

ছয় মাস পর ফের সাংগঠনিক কার্যক্রমে ফেরার চেষ্টা

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ নেতারা অনলাইনে সরব হয়ে উঠলেও মাঠে আসতে পারেননি কেউই। ফলে কোনো ধরনের সাংগঠনিক কার্যক্রমেও ঢুকতে পারেনি আওয়ামী লীগ। দলের দুয়েকটি কর্মসূচির কথা এর মধ্যে জানালেও সেগুলো ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ ছিল।

ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এসে যখন দলটির পতনের ছয় মাস পূর্ণ হচ্ছে, সেই মাসে এসে শেষ পর্যন্ত সাংগঠনিক কার্যক্রমে ফেরার প্রয়াস নিয়েছে আওয়ামী লীগ। গত ২৮ জানুয়ারি দলের ফেসবুক পেজ থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য পাঁচ ধরনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। লিফলেট বা প্রচারপত্র বিলি থেকে শুরু করে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ, অবরোধ এবং এমনকি হরতাল পর্যন্ত রয়েছে এসব কর্মসূচির মধ্যে।

আওয়ামী লীগের এ মাসের কর্মসূচিগুলো হলো— ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লিফলেট বিতরণ, ১০ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ, ১৬ ফেব্রুয়ারি অবরোধ এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল-সন্ধ্যা দেশব্যাপী সর্বাত্মক হরতাল।

আরও পড়ুন-

লাইভ অনুষ্ঠানে আসছেন শেখ হাসিনা

এবারে কর্মসূচি ঘোষণা করে বসে থাকেনি আওয়ামী লীগ। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে লিফলেট বিতরণ করতে শুরু করেছে দলটি। সরকারও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রয়েছে কঠোর অবস্থানে। লিফলেট বিতরণ করার অভিযোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারপরও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন স্থানে লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি চলছে।

এদিকে আজ বুধবার রাত ৯টায় বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বক্তব্য রাখবেন। নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ফেসবুক থেকে অনুষ্ঠানটি প্রচারের কথা রয়েছে। অন্যদিকে আগামীকাল বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় ‘দায়মুক্তি’ শিরোনামের এক লাইভ অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে নেতাকর্মীদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনবেন শেখ হাসিনা। এই অনুষ্ঠান আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে সম্প্রচার করা হবে। সরকার পতনের পর শেখ হাসিনাকে এই প্রথম কোনো পাবলিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দেখা যাবে।

আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংগঠনিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানার জন্য কেন্দ্রীয় একাধিক নেতার হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে তৃণমূল পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা বলেন, এসব কর্মসূচিকে তারা ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই দলকে সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় করে তোলার চেষ্টা হিসেবে দেখছেন।

আরও পড়ুন-

১৮ ফেব্রুয়ারি হরতালসহ মাস জুড়ে যেসব কর্মসূচি আ.লীগের

আওয়ামী লীগের দুটি জেলা ও তিনটি উপজেলা কমিটির সম্পাদক পর্যায়ের কয়েকজন নেতা বলেন, ফেব্রুয়ারির কর্মসূচিসহ লাইভ অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার উপস্থিতি দলের নেতাকর্মীদের চাঙা করে তুলতে সহায়তা করবে। এতদিন পর্যন্ত দলের নেতাকর্মীরা সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা পাচ্ছিলেন না। এখন হয়তো তারা সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা পাবেন। দলের পুনর্গঠনে এসব কর্মসূচি ভূমিকা রাখবে।

আওয়ামী লীগের এসব নেতা নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তাদের বিশ্বাস, অন্তর্বর্তী সরকার চেষ্টা করলেও আওয়ামী লীগকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। আওয়ামী লীগের ফিরে আসার সূচনা হবে ফেব্রুয়ারি মাস। দলের এসব নেতার কাছে এখনো শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ‘বিকল্প নেই’। শেখ হাসিনাকে এখনো দেশের ‘সাংবিধানিক প্রধানমন্ত্রী’ও মনে করেন তারা

r1 ad
r1 ad
top ad image