জুলাই ঘোষণাপত্র: ‘সর্বদলীয় বৈঠকে’ ডাক পায়নি বিএনপিসহ অনেক দলই
‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রণয়নের দায়িত্ব ছাত্রদের বদলে নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। বলেছিল, সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতেই এই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হবে। তার জন্য সব রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের নিয়ে বৈঠক করা হবে।
সেই বৈঠক শুরু হতে বাকি আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা। কিন্তু বিএনপিসহ একাধিক রাজনৈতিক দল জানিয়েছে, এখনো সরকারের তরফ থেকে তারা এই বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পায়নি। এ পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ডাকা এই বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশ নেওয়া নিয়ে অনিশ্চিয়তা দেখা দিয়েছে।
জুলাই ঘোষণাপত্র ইস্যুতে বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) সব রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের নিয়ে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ দিন বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বৈঠকটি হওয়ার কথা রয়েছে।
রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বুধবার (১৫ জানুয়ারি) রাত ১০টা পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এই বৈঠকের আমন্ত্রণ পায়নি। সাম্প্রতিক সময়ের রাজনীতিতে বিএনপির কাছাকাছি থাকা গণতন্ত্র মঞ্চও আমন্ত্রণ পায়নি। আমন্ত্রণ পায়নি ঐতিহ্যবাহী বামপন্থি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ (সিপিবি) বাম গণতান্ত্রিক জোটও।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বুধবার রাতে রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘এ ধরনের বৈঠকে যাওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো আমন্ত্রণ বা চিঠি আমরা পাইনি। যদি আমরা কোনো আমন্ত্রণ পাই, তখন বৈঠকে যোগ দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হকও একই তথ্যই জানালেন। বুধবার রাতে রাজনীতি ডটকমকে তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আগামীকালের (বৃহস্পতিবার) বৈঠকের ব্যাপারে দল হিসেবে বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টি বা জোট হিসেবে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে এখন পর্যন্ত কোনো যোগাযোগ করা হয়নি।’
শুধু বৈঠকের আমন্ত্রণই নয়, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি বা গণতন্ত্র মঞ্চ ঘোষণাপত্রের খসড়াই হাতে পায়নি বলে জানালেন সাইফুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘কোনো চিঠি পেলেই যে আমরা এখন বৈঠকে যেতে পারব, তেমনও না। কারণ আমরা ঘোষণাপত্রের কোনো কপিই পাইনি। ওই কপি বা খসড়া পেলে তো প্রথমে আমরা দলগতভাবে বসব। গণতন্ত্র মঞ্চের মধ্যেও জোটগতভাবে কথা বলব। প্রয়োজন হলে অন্য শরিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করব। তারপর না মতামত দিতে পারব। ফলে এ রকম হুট করে এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতামত দেওয়া সম্ভব হবে না।’
জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে সরকারের কার্যক্রম গণমাধ্যমের বরাতে জানতে পেরেছেন বলে জানান সাইফুল হক। আর গণমাধ্যম সূত্রে যতটুকু জানতে পেরেছেন, তাতে বিষয়টি নিয়ে সরকারের তীব্র সমালোচনাই করছেন তিনি।
সাইফুল হক বলেন, ‘সাংবাদিক বা বন্ধুদের মাধ্যমে এ বৈঠক সম্পর্কে জানতে পেরেছি। কিন্তু সেটিকে তো আনুষ্ঠানিক হিসেবে বিবেচনায় ধরতে পারব না। ওনারা (সরকার) আমাদের বিষয়ে নন-সিরিয়াস, আনপ্রফেশনাল মনে হয়েছে। বিষয়টিকে তারা খুব সিরিয়াসলি নিয়েছেন, এমন মনে হয়নি। সিরিয়াস হলে সবার সঙ্গে কথা বলতেন, আলোচনা করতেন। সুযোগ দিতেন যেন দলগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে পারে, একটা প্রস্তুতিমূলক আলোচনায় তারা আসতে পারে।’
বৈঠক সম্পর্কে কিছু জানা নেই উল্লেখ করে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘সরকারের এ ধরনের উদ্যোগ আছে বলে আমরা এখনো জানি না। কোনো আমন্ত্রণও আমরা আজ পর্যন্ত পাইনি। শুধু সিপিবি নয়, বাম জোটের কাছেও এ বিষয়ে কোনো চিঠি আসেনি।’
জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র সহকারী প্রেস সচিব হলেন ফয়েজ আহম্মদ রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘যখন কথা বলেছেন তখন হয়তো তারা আমন্ত্রণ পায়নি। তবে সব দলকে দাওয়ত দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আশা করি বিভিন্ন সময়ে যেসব দল সরকারের সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়েছে, তারা সবাই বৈঠকে থাকবে।’
জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে সরকারের উদ্যোগ নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন উঠেছে আরও আগেই। বিএনপি মহাসচিব গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের কাছ থেকে আমরা ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া পেয়েছি। উনি আমাদের অনুরোধ করেছেন এ বিষয়ে মতামত জানাতে। বিষয়টি এত বেশি সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ যে একদিনের নোটিশে মতামত দেওয়া সম্ভব না। আমরা আলোচনা করেছি এবং আরও আলোচনা করছি। অন্যান্য দলগুলোর পাশাপাশি সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও কথা বলতে হবে। কারণ, এই ঘোষণাপত্রে সংবিধানের ব্যাপারেও কথাবার্তা আছে। সেগুলো আমাদের দেখতে হবে।’
এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি গত ৩১ ডিসেম্বর জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রকাশের কর্মসূচি দিয়েছিল। ওই সময় প্রধান উপদেষ্টা প্রেস সচিব শফিকুল আলম ব্রিফিংয়ে জানান, এর সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই।
দুদিন পরেই অবশ্য সরকারের অবস্থান বদলে যায়। সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়, সরকার নিজেই সব দল ও অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করবে। এ ঘোষণার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকারকে সমর্থন দিয়ে তাদের ঘোষণাপত্র প্রকাশের কর্মসূচি স্থগিত করে। ৩১ ডিসেম্বর তারা কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের সমাবেশে সরকারকে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে ঘোষণাপত্র প্রকাশের সময় বেঁধে দেয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ব্রিফিংয়ে জানিয়েছিলেন, ১৫ জানুয়ারির মধ্যে এই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন সম্ভব না। তবে এই সময়ের মধ্যে ঘোষণাপত্র নিয়ে সব দলের মতৈক্য তৈরির প্রক্রিয়া সরকার শুরু করবে। এর জন্য বৃহস্পতিবার সর্বদলীয় বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে বলে গত মঙ্গলবার জানান তিনি।
মাহফুজ বলেন, গত ১৫ দিন জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে আমরা কাজ করেছি। শিক্ষার্থীদের ঘোষণাপত্র অবলম্বনে উপদেষ্টা পরিষদের পক্ষ থেকে খসড়া প্রস্তুতের চেষ্টা করেছি। আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নারী, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা জানতে পেরেছি, সবাই জুলাই ঘোষণাপত্রের বিষয়ে একমত আছেন যে ঘোষণাপত্র দিতে হবে। কিন্তু কবে ঘোষণা হবে বা এর ভেতরে কী কনটেন্ট থাকবে, সে বিষয়ে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারিনি।
বৃহস্পতিবারের বৈঠকের কথা জানিয়ে উপদেষ্টা মাহফুজ বলেন, ঘোষণাপত্র নিয়ে বৃহস্পতিবার সর্বদলীয় বৈঠক হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও পক্ষকে আমরা বৈঠকের কথা বলেছি। তাদের কাছ থেকে মন্তব্য পেয়েছি যে কীভাবে এটা করা সম্ভব। আশা করি বৃহস্পতিবার বৈঠকের ভেতর দিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি দলিল প্রণীত হবে। কবে ঘোষণাপত্র জারি করা হবে এবং কীভাবে সরকার এতে ভূমিকা রাখবে, তা সেদিনই জানানো হবে।
তরুণ উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বৃহস্পতিবারের সর্বদলীয় বৈঠক নিয়ে যতটা আশাবাদী, বৈঠকের আগের রাতে বিএনপি-গণতন্ত্র মঞ্চ-বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতাদের বক্তব্যে অবশ্য ততটা আশাবাদী হওয়ার সুযোগ দেখছেন না বিশ্লেষকরাও।
জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে সরকারের অবস্থান প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মামুন আল মোস্তফা বলেন, ‘সরকার আসলে দায় নিতে চায় না। কারণ জুলাই আন্দোলেনে যারা সম্পৃক্ত ছিল, তারা একক কোনো দল নয়। এখানে নানা পথ ও মতের মানুষ ছিল। ফলে সবাই মিলে একক ঘোষণাপত্রে আসার যে চ্যালেঞ্জ, সেটা বুঝতে পেরেছে সরকার। এ কারণে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে সম্ভবত সরকার ঘোষণাপত্রের কাজে কম মনোযোগ দিতে চাইছে।’