বিশেষ সাক্ষাৎকারে জাপা চেয়ারম্যান
ঐক্যে ফাটল ও ইসলামপন্থিদের উত্থান দুশ্চিন্তার বিষয়

বাংলাদেশে গত প্রায় দেড় দশকের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে এড়িয়ে চলছে অন্তর্বর্তী সরকার। ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ বা ‘ফ্যাসিবাদের সহযোগী’ হিসেবে রাজনৈতিক আলোচনায় ঘুরেফিরে আসছে দলটির নাম। তবে জাতীয় পার্টির মূল্যায়ন— অন্তর্বতী সরকারের সময়ে দেশ ভালো চলছে না। দেশকে বিভক্ত করার জন্য দলটির নীতিনির্ধারকরা দায়ী করছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে।
প্রশ্ন উঠেছে— আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী ১৪ দলের নেতারা যদি ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিয়ে ফ্যাসিবাদের দোসর হয়, তাহলে জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি নয় কেন?
এসব নিয়ে বনানীতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে রাজনীতি ডটকমের তিন সংবাদ কর্মীর সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন সাবেক মন্ত্রী ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি, অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি এবং খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা প্রসঙ্গ ছাড়াও নানা বিষয়। রাজনীতি ডটকমের পাঠকদের জন্য থাকছে সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ।
রাজনীতি ডটকম: আপনি বলছেন, ঐক্যে ফাটল ধরেছে। কীসের ঐক্য, ফাটলই বা ধরালো কে?
জি এম কাদের: জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। বেশির ভাগ মানুষ শেখ হাসিনার পতনে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিল। তারা আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে গেছেন। প্রায় সবাই চেয়েছিল তার (শেখ হাসিনা) পতন হোক। সেই একতা ধরে রেখেই সামনে এগোনো দরকার ছিল। জাতীয় পাটিও সেই আন্দোলনে যুক্ত ছিল। দলের দুজন কর্মী মারা গেছেন, অনেকেই আহত হয়েছেন। হুলিয়া মাথায় নিয়ে শত শত নেতাকর্মী পালিয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছে অসংখ্য। এসব তথ্যপ্রমাণ সংবাদ সম্মেলন করে আমি প্রকাশ করেছি।
এই ঐক্যের মূল সুর ছিল একটি ভালো নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া। সংবিধানের মাধ্যমে দেশ চালাতে গিয়ে কেউ যেন দানব না হয়ে ওঠে, বিশেষ করে একজনের হাতে ক্ষমতা যেন না যায়। শেখ হাসিনা যা করেছেন, তার পুনরাবৃত্তি এ দেশে যেন না হয়।

বনানী কার্যালয়ে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের। ছবি: রাজনীতি ডটকম
রাজনীতি ডটকম: শেখ হাসিনার পতন তো হলো, তারপর?
জি এম কাদের: গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, জয়ের পর কিছু মানুষ জয়টাকে ব্যক্তিগত অর্জন হিসেবে দেখানোর চেষ্টা শুরু করল। একটি পক্ষ মনে করল, তাদের অবদান সবচেয়ে বেশি। অতএব তারা যেটা চাচ্ছেন, সেটাই হবে। তারা এখন অনেক কিছু বলছেন, যেগুলো আমরা আগে জানতাম না। এসব করায় সাজানো-গোছানো সুন্দর একটি বিষয়, যা নিয়ে ঐক্য তৈরি হয়েছিল, তা নানা কারণ দেখিয়ে বিভক্ত (ডিভাইডেড) করা হয়েছে। তাদের হিসাবে এই বিভক্তি হচ্ছে— একদিকে ফ্যাসিবাদবিরোধী, আরেক দিকের সবাই ফ্যাসিবাদের পক্ষে।
আসলে এটা ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে করা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যারা কোনো না কোনোভাবে গত সরকারের সময়ে বিভিন্ন কাজে যুক্ত ছিল, তারা এর শিকার। অনেকে পুরস্কার নিতে গেছেন, কোনো অনুষ্ঠানে মন্ত্রীর সঙ্গে ছবি তুলেছেন, বিয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ছবি তুলেছেন— এরাও এখন ফ্যাসিবাদের সমর্থক!
দেশে ফ্যাসিবাদের দোসর ও ফ্যাসিবাদবিরোধী ধারা তৈরির এই চেষ্টার অংশ হিসেবে ঘৃণা ও প্রতিহিংসাকে প্রমোট বা এনকারেজ করা হয়েছে বলে আমার মনে হয়।
রাজনীতি ডটকম: জাতীয় পার্টি কি ফ্যাসিবাদের সহযোগী নয়?
জি এম কাদের: দেখুন, মূল্যায়ন যদি করতেই হয় তাহলে ঐতিহাসিক ব্যাকগ্রাউন্ড দেখতে হবে। নব্বইয়ের আগে ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি-আওয়ামী লীগ একসঙ্গে জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। পরবর্তী সময়ে জাতীয় পার্টি ক্ষমতা ছেড়ে চলে এলো। জাতীয় পার্টিকে তখন নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু জনগণের চাপে নির্বাচন করতে দেওয়া হলো। জনগণ তাদের নামিয়েছে বলা হলো, কিন্তু জনগণই আবার জাতীয় পার্টিকে ভোট দিলো বারবার।

পরে একানব্বই থেকে ছিয়ানব্বই সাল পর্যন্ত প্রথমে বিএনপি স্টিম রোলার চালাল। ছিয়ানব্বই সালে বিএনপি যে একতরফা নির্বাচন আয়োজন করে, সেখানে জাতীয় পার্টি অংশ নেয়নি। আওয়ামী লীগও অংশ নেয়নি। সে জন্য আওয়ামী লীগ ও আমরা এক হলাম। একানব্বই থেকে ছিয়ানব্বই পর্যন্ত যেহেতু বিএনপি নানাভাবে জাতীয় পার্টিকে হয়রানি করেছে, সেহেতু আমরা আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় আনলাম। তখন কিন্তু ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হয়েছিল। কিন্তু এরপর শেখ হাসিনা এসে আমাদের দলটাকে ভাগ করতে শুরু করলেন।
রাজনীতি ডটকম: তাহলে ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে অংশ নিলেন কেন?
জি এম কাদের: ২০১৪ সালে শেখ হাসিনা বললেন, আমরা মহাজোটে আছি। আমরা একটা উদাহরণ তৈরি করতে চাই। কী উদাহরণ? আমরাই নির্বাচন করব, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দরকার হবে না। আমাদের সরকারের অধীনেই ভালো নির্বাচন হবে। আমরা ভাবলাম, সব দেশে সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়। আমাদের এখানে হবে না কেন? তবে আমরা শর্ত দিলাম, সব দল না এলে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাবে না।
শেষ পর্যন্ত সব দল নির্বাচনে আসেনি। আমরা চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিলাম, নির্বাচন করব না। তখনকার পরিস্থিতি আপনার সবাই জানেন। এরশাদ সাহেবকে জোর করে ধরে নিয়ে, আটকে রেখে নির্বাচন করানো হলো। আমি কিন্তু নির্বাচন করিনি। আমার সঙ্গে ২৭০ জন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন। (মনোনয়নপত্র) প্রত্যাহার করলেও আমাকে পাস করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। আমি তাতে রাজি হইনি। কাজেই সবসময় আমরা যে নীতিহীনভাবে গেছি, তা নয়। জোর করেও নেওয়া হয়েছে। এরশাদ সাহেবকে মিথ্যা মামলাসহ নানা ইস্যুতে চাপে রেখে তাদের সঙ্গে চলতে বাধ্য করা হয়েছে।

রাজনীতি ডটকম: তাহলে ২০১৮ সালের নির্বাচনে?
জি এম কাদের: ২০১৪ সালের পরে আমাকে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আমি প্রত্যাখান করেছি। আমি এমপি-মন্ত্রী হইনি। আমরা সবাই একমত ছিলাম, আমরা এই সরকারের সঙ্গে নেই। কিন্তু ওই সরকারে জাতীয় পার্টির যারা ছিল তাদের সঙ্গে আমাদের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল। এ পরিস্থিতিও আওয়ামী লীগ তৈরি করেছিল।
২০১৮ সালে এরশাদ সাহেব বললেন, এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে না থেকে উপায় নেই। তাই আমরা ছিলাম, থাকতে বাধ্য হলাম। কিন্তু আমরা বিরোধী দলে থেকে এমন কোনো বিষয় নেই, যেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলিনি। আমাকে বিরোধী দলের ডেপুটি লিডার থেকে পর্যন্ত সরিয়ে দিলেন শেখ হাসিনা। কারণ আমি সমালোচনা করতাম, এটা তার পছন্দ ছিল না। ২০২৪ সালেও জোর করে নির্বাচনে নেওয়া হয়েছিল।
রাজনীতি ডটকম: এখন কেমন চলছে বাংলাদেশ?
জি এম কাদের: যেভাবে চলাটা স্বাভাবিক আমরা মনে করি, সেভাবে চলছে না। সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা থাকে, জানমাল বা ইজ্জতের নিরাপত্তা পাওয়ার। এটাই মানুষের বড় চাওয়া বা প্রত্যাশা। কিন্তু এটা আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না। জীবনের নিরাপত্তা নেই, সম্পদের নিরাপত্তা নেই। মানসম্মান নিয়ে ভয়। কে, কোথায় ধরে নিয়ে রাস্তাঘাটে মারধর করবে, জামাকাপড় ছিড়ে দেবে...

আমরা আশা করি, খেয়ে-পরে পরিবার নিয়ে সুখে-শান্তিতে থাকব। এই খাওয়া-পরার সংশয় দেখা দিয়েছে। আয় বাড়ছে না। সবচেয়ে বড় সমস্যা এখন বেকারত্ব, এটা নাম্বার ওয়ান সমস্যা। এ জন্য বাকি সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে। যেটা করলে বেকারত্ব কমত, সরকার সেটি করছে না। আমার বিশ্বাস, সরকার ইচ্ছা করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারত। কিন্তু এখন এটি একটি ‘মিসম্যানেজড কান্ট্রি’।
রাজনীতি ডটকম: সরকার কেন কাজ করতে পারছে না বলে আপনার ধারণা?
জি এম কাদের: একটি গাড়িতে যেমন দুজন চালক থাকতে পারে না, তেমনি দ্বৈত প্রশাসন বা ডুয়েল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থাকতে পারে না। আমি মনে করি, সরকারে একটি প্যারালাল ব্যবস্থা চলছে। একপক্ষ একদিকে যেতে চাইলে আরেক পক্ষ আরেক দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টারা যারা আছেন তারা অনেক কিছু বলছেন, করতে চাচ্ছেন, আলাপ-আলোচনা করছেন বা পরিস্থিতি বুঝতে পারছেন। কিন্তু যখন তারা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন, তখন উলটো কাজটি করছেন। প্রাইভেটলি এটা স্বীকারও করেছেন যে তাদের কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। নানা রকম চাপ দেওয়া হচ্ছে।

আনঅফিশিয়ালি শুনতে পেলাম, সব উপদেষ্টার সঙ্গে আরও কেউ আছেন, যাদের ওপর থেকে ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। উনি (ড. ইউনূস) নিজেই বলেছেন, তারা আমার চাকরিদাতা, আমার অভিভাবক। তাদের কথামতো চলতে হবে। সবচেয়ে বড় সংকট এটাই দেখি। এ কারণে সরকার বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়েছে, দেশকেও বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা মনে করছি, যারা গাইড করছেন তারা রাজনীতিতে অত্যন্ত অনভিজ্ঞ, দেশ পরিচালনায় একেবারেই আনাড়ি।
রাজনীতি ডটকম: এখন বলা হচ্ছে, ওটা ছিল ইসলামি রাষ্ট্রের আন্দোলন, আসলে কি তাই?
জি এম কাদের: অনেকে যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে দুয়েকজন এমনটি বলছেন। নানাভাবে ডিক্লেয়ার করছেন। আমরা বারবার বলছি, ওটা ছিল অহিংস আন্দোলন। বরং শেখ হাসিনা সহিংসতা দেখিয়েছেন, অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করেছেন। কিন্তু ওনারা বলতে চান, তারা তো সহিংসতা করেছেন, হত্যা করেছেন, নাশকতা করেছেন। এর কারণ তারা ইসলামি রাষ্ট্র চেয়েছিলেন।
আগের সরকার একটা জুজুর ভয় দেখাত, তা হলো— ইসলামপন্থি ও মৌলবাদীরা দেশ দখল করে ফেলবে। আমরা মনে করতাম, এটা হয়তো সাজানো কথা। এরপর আন্দোলনকারীদের একটি অংশ যখন একই কথা বললেন, তখন বিষয়টি কনফিউজিং হয়ে গেল।

রাজনীতি ডটকম: তাহলে কি ইসলামি শক্তির উত্থান দেখতে পাচ্ছেন?
জি এম কাদের: ইসলামি শক্তির উত্থান কেবল আমি না, সবাই দেখতে পাচ্ছেন। আমার কাছে অনেকেই বলছেন, অনেকেই বেশ উদ্বিগ্ন (ওরিড), বিশেষ করে নারীরা, যারা চাকরি-বাকরি করেন। এমনকি গ্রামের নারীদের যারা ক্ষেত-খামারে কাজ করেন, তারাও। তাদের ধারণা, এমন অবস্থা হবে যে ঘর থেকে বের হতে পারবেন না, লেখাপড়া করতে পারবেন না, গানবাজনা করতে পারবেন না। দেশে যেকোনো কারণেই হোক, এমন এক ভীতির সঞ্চার হয়েছে।
এটা যে একেবারে অমূলক, তাও আমি মনে করি না। যখন মিলিট্যান্সির কথা আসবে, তখন আমেরিকা, ভারত, ইউরোপ আবার অন্য দৃষ্টিতে বাংলাদেশকে দেখবে, যা আমাদের জন্য সুখকর হবে না। সামনের দিনের রাজনীতিতে ইসলামি শক্তি বড় অবদান রাখবে। এতদিন সবাই একটা তালে ছিল যে শেখ হাসিনা চলে গেলে সব সমাধান হয়ে যাবে। তাই শেখ হাসিনাকে যেকোনোভাবে নামাতে হবে। শেখ হাসিনা তো নেমে গেছে, এখন আমরা কোথায় যাব বা যাচ্ছি?
রাজনীতি ডটকম: জাতীয় পার্টি এ পরিস্থিতিতে চুপ কেন?
জি এম কাদের: জাতীয় পার্টি কখনো কোনো ইস্যুতে চুপ থাকেনি। কিন্তু আমাদের মিডিয়া কভারেজ দেওয়া হচ্ছে না। আগের মতো আমাদের কথা মিডিয়াতে দেওয়া হচ্ছে না বা খুবই কম দেওয়া হচ্ছে। দুয়েক লাইন দেওয়া হচ্ছে। সাংবাদিকরা পরিষ্কারভাবে আমাদের বলছেন, আমাদের খবর তারা প্রকাশ করতে পারছেন না, তারা ভীত-সন্ত্রস্ত। এ জন্য জনগণের কাছে আমরা সঠিকভাবে পৌঁছাতে পারছি না। এটাও কিন্তু সরকার করছে।

রাজনীতি ডটকম: অনেকেই তো মনে করেন, এই সময়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বেড়েছে।
জি এম কাদের: আসলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে। সেলফ সেন্সশিপ বেড়েছে। সাংবাদিকেরা আগের তুলনায় ঝুঁকির মুখে। আগেও কিন্তু ঝুঁকি ছিল। তারাই তো এখন বলছেন, যা দেখছেন বা শুনছেন তা লিখতে পারছেন না।
রাজনীতি ডটকম: এই সরকারের সময়ে মামলা নিয়ে এত সমালোচনা কেন?
জি এম কাদের: মামলাগুলো হয়রানিমূলক, ভুয়া মামলা। লাখ লাখ লোক আসামি। রাজনৈতিক লোকজনের বিরুদ্ধে তো হচ্ছে, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধেও হচ্ছে। এমনকি বস্তির এক মাকে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। তার দুটি বাচ্চা, তাকেও কিছু মানুষ হয়রানির জন্য খুনের মামলা দিয়ে জেলে নিয়েছে। বাচ্চাগুলো অসহায় হয়ে পড়েছে। শেখ হাসিনার সময়ও এমন হয়েছিল। তখন পুলিশ করেছে বেশির ভাগ মামলা। এখন ব্যক্তি করছে, তাকে দিয়ে করানো হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। এখানে পার্থক্য খুব একটা দেখি না।

রাজনীতি ডটকম: জাতীয় পার্টি কি ড. ইউনূসকে সমর্থন দিয়েছিল?
জি এম কাদের: ৫ আগস্ট ড. ইউনূসের নাম যখন আমাদের জানানো হলো, আমরা খুশি হলাম। বললাম, আমাদের আপত্তি নেই। কারণ উনি নিরপেক্ষ মানুষ। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। কারও পক্ষে-বিপক্ষে নন বলেই মনে করেছিলাম। কিন্তু পরে দেখলাম, উনি রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ। যেকোনেভাবে উনি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে গেছেন। নিজের ইচ্ছায় হোক বা অন্য কোনো কারণে হোক, কর্মকাণ্ডে তা দেখতে পাচ্ছি।
দেশ তো এখন দুই ভাগ হয়ে গেছে। যেই করুক, উনি তো হলেন মূল ব্যক্তি, সর্বোচ্চ ব্যক্তি। উনার নামেই এটা যাবে। সবসময় বিচারের মাধ্যমে সব হচ্ছে না। মব জাস্টিস হচ্ছে, যার ইচ্ছা যা কিছু করছে। বাড়িঘরে গিয়ে হামলা করছে। দায়দায়িত্ব তো উনার ওপরই পড়ে।
রাজনীতি ডটকম: ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে কী প্রত্যাশা করেছিলেন?
জি এম কাদের: আমাদের প্রত্যাশা ছিল— একতাবদ্ধ দেশ নিয়ে তিনি সামনে এগিয়ে যাবেন। আমি দক্ষিণ আফ্রিকার উদাহরণ বলেছি। একটি বিভক্ত দেশ ছিল, আইনিভাবে শত বছরের বিভক্তি। নেলসন ম্যান্ডেলাকে ২৭ বছর জেলে রাখা হয়েছিল, অত্যাচার করা হয়েছিল। উনার আত্মীয়-স্বজনকে হত্যা করা হয়। বন্ধু-বান্ধবকে গুলি করে মারা হয়। তারপরও তিনি কিন্তু শ্বেতাঙ্গদের নিয়ে এক হয়েছিলেন। তাদের নিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়েছিলেন। এর কারণ দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত দেশের স্বপ্ন ছিল তার সামনে। আমাদের এখানেও এমনটি করা দরকার ছিল। আল্লাহ উনাকে সেই কাজ করার সুযোগ দিয়েছে।

দেখুন, মানুষ অপরাধ করবেই। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রধান হলেন ফাদার ফিগার। তার কাছে প্রত্যেকে সমান নয়; কেউ ভালো, কেউ মন্দ বা পাপী। এখন কেউ পাপী হলে তাকে শাস্তি দেন। কিন্তু আপনার ছেলে হিসেবে বর্জন করবেন কেন?
রাজনীতি ডটকম: কেমন চলছে প্রশাসন?
জি এম কাদের: নির্বিচারে এখনো সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে। খুনের মামলা দেওয়া হচ্ছে। চাকরি থেকে অব্যহতি দেওয়া হচ্ছে, পদোবনতি করা হচ্ছে।
তারা তো চাকরি করে, চাকরি না করলে বউ, ছেলে-মেয়ে নিয়ে কীভাবে চলবে? তখনো তারা চাকরি করেছে। একটা মানুষ চাকরি হারালে আমাদের সমাজে কী অবস্থা হয়, বুঝতে হবে তো। তারা শেখ হাসিনার অবৈধ কাজ মানতে বাধ্য ছিলেন না। কিন্তু নির্দেশ না মানলে কী হবে, তার নিশ্চয়তা কী ছিল? সেই সময়ের কথা ভেবে দেখুন তো। কার সাধ্য ছিল যে তার বা তার লোকজনের নির্দেশ মানবে না।
এই লোকগুলো তো সরকারি কর্মকর্তা। আজ আপনি তাকে বলেন, তুমি আমার জন্য কাজ করো, আমি তোমার পেছনে আছি। আপনার জন্য তারা জীবন দেবে, শেখ হাসিনাকে ধরে আনবে। তার অপকীর্তি প্রচার করবে। কিন্তু আপনি যদি তাকে সরিয়ে দেন, তাহলে কীভাবে, কাকে দিয়ে কাজ করাবেন?
সবচেয়ে বড় ভুল যেটা তিনি (ড. ইউনুস) করেছেন, আওয়ামী লীগ বাদে বাকি লোকগুলোকে রেখেছেন। তাহলে আওয়ামী লীগ বাদে বাকি লোক কে আছে? দলীয়করণ কে করেছে? করেছে বিএনপি, না হয় জামায়াত। এভাবে প্রশাসন হয়ে গেল পলিটিসাইজড। বাকি লোকেরা চাকরির ভয়ে বা খুনের আসামি হওয়ার ভয়ে আছে। চাকরি চলে গেলে বা খুনের আসামি হলে কী হবে? তার চেয়ে চুপ থাকি।

এভাবে আপনার জন্য যারা ফাইট করবে, তাদের আপনি পঙ্গু করে দিলেন। কেউ বলবে আমাকে জামায়াত বসিয়েছে, তার কাজ করব। সামনে তো আর বলবে না, মনে মনে বলবে। আর যারা বিএনপির লোক তারা বলবে, আমরা বিএনপিকে দেখব। বিএনপি ক্ষমতায় এলে উন্নতি হবে। আর বাকি লোকগুলো বলবে, বাবা আমি আছি, কোথায় আছি জানি না, তার চেয়ে চুপচাপ থাকি। কাল কোথায় থাকব, তাও জানি না।
তাহলে এই প্রশাসন নিয়ে তিনি (ড. ইউনূস) কী করবেন? শুধু দেশকেই তিনি বিভক্ত করেননি, প্রশাসনকেও বিভক্ত করেছেন।
রাজনীতি ডটকম: সরকার পতনে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা ছিল কি?
জি এম কাদের: ৫ তারিখের পর ৬ আগস্ট মার্কিন দূতাবাস আমাকে ডেকেছিল। না, উনারা পরিষ্কার একটা কথা বলেছেন, তারা (গণঅভ্যুত্থানে) যুক্ত ছিলেন না। তবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হলে তার বিপক্ষে তাদের অবস্থান সবসময় ছিল, সামনেও থাকবে। এটাই তাদের কথা। তবে ভেতরে উনারা কিছু করেছেন কি না, তা আমি জানি না। তবে উনারা অস্বীকারও করেন। যতবার জিজ্ঞাসা করেছি, জবাব ‘নো’।
উনারা বলেন, তোমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করব না। তারা দেখতে চান, জনগনের প্রত্যাশা অনুযায়ী সরকার চলবে। এটাতে সমর্থন করতে চেয়েছেন। সরকারকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণের জন্য, ভালো নির্বাচনের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে চান।
রাজনীতি ডটকম: বাংলাদেশের কাছে ভারতের মূল চাওয়া কী বলে মনে হয়?
জি এম কাদের: বাংলাদেশের ভূমি যেন তাদের বিপক্ষে ব্যবহার না হয়— এটাই তাদের চাওয়া। অতীতে হয়েছে বলেই তারা এমন আশঙ্কায় থাকে। বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা হয়েছে। তারা নজর রাখতে চান, বাংলাদেশে যেন এমন কোনো সরকার না আসে, যারা সরাসরি ভারতের প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে ঝামেলা তৈরি করে।
উলফাদের আশ্রয় দেওয়া, অর্থায়ন করা, অস্ত্র দেওয়া— এসব বিষয় তারা বারবার আলোচনায় এনেছেন। এটা কেবল বিএনপির সময়ে নয়, আগের সরকারগুলোর সময়েও হয়েছে বলে তাদের ধারণা। এখন তা বন্ধ হয়েছে। পরবর্তী কোনো সরকার এটা করবে বলেও আমি মনে করি না।
রাজনীতি ডটকম: ভারতের সঙ্গে জাতীয় পার্টি, এরশাদ সাহেব বা আপনার সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা কতটা?
জি এম কাদের: এটা সত্য— ভারতীয় হাইকমিশনের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক। আসা-যাওয়া করতাম, সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতাম। আমি ওদের বলছিলাম, শেখ হাসিনা দেশ ভালো চালাচ্ছে না। দেশের মানুষ তোমাদের ওপর বীতশ্রদ্ধ হচ্ছে। কারণ তোমরা ওদের সমর্থন করছ। জনগনকে বাদ দিয়ে তাকে যদি তোমাদের সরকার দেখাশোনা করে, তাহলে বাংলাদেশের জনগন তোমাদের (ভারত) বিপক্ষে অবস্থান নেবে।

রাজনীতি ডটকম: অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতা কী?
জি এম কাদের: সফলতা বলব কি না, জানি না। মানুষের মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন এসেছে। হইচই মানুষ কম করে। রাস্তঘাটে বাধা দিলে থেমে যায়। যানজট খুব হচ্ছে। কিন্তু পুলিশের নির্দেশ মানছে অনেকেই। চোখে পড়ল— এদিকে দিয়ে যান, ওদিক দিয়ে যান, আবার ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে। কিন্তু মানুষ তা মেনে নিচ্ছে। অবশ্য এটি সরকারের সফলতা কিনা জানি না।
রাজনীতি ডটকম: দেশের প্রবৃদ্ধির অবস্থা কেমন?
জি এম কাদের: ড. ইউনূস বলেছেন, প্রবৃদ্ধি (গ্রোথ রেট) বাংলাদেশে যেটা প্রজেক্ট করা হয়েছে, তা সঠিক ছিল না। আমি যতটুকু জানি, সেটা মোটামুটি কারেক্ট ছিল। তবে বারবার বলেছি, গ্রোথ রেট অ্যালোন ইজ নট দ্য ক্রাইটেরিয়া অব ডেভেলপমেন্ট। গ্রোথ রেটের সঙ্গে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দেখতে হয়। চাকরির সুযোগ কতটা, তা দেখতে হয়। আসলে গ্রোথ হয়েছে, তবে ওয়ান সাইডেড। একদিকে হয়েছে, আরেক দিকে হয়নি। কিন্তু ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বেড়েছে। চাকরি-বাকরি কিছু বাড়েনি, বরং কমেছে। এ জন্য আমি বলেছিলাম, ইট ইজ নট আ গুড ডেভেলেপমেন্ট। বাট গ্রোথ হয়নি— এটি তথ্যনির্ভর নয়। গ্রোথগুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গ্রহণ করেছে। তবে টাকা অবমূল্যায়ন জোর করে আটকে রাখা হয়, মাথাপিছু আয় বাড়ানো হয়।
রাজনীতি ডটকম: দেশে সংখ্যালঘুরা কেমন আছে?
জি এম কাদের: সংখ্যালঘুরা ভালো আছে, বলা যাবে না। এখানে আমি সরকারের দোষ দেই না। আমাদের মতো গরীব দেশে তারা ভালনারেবল থাকে বিভিন্ন কারণে। আমাদের দেশে সংখ্যালঘু হওয়াটা একটা দুর্বলতা। সবাই মনে করে, আমার জমি দরকার, সংখ্যালঘুকে ধরো। এটা সব সরকারের সময়ে হয়েছে। এটা সবেচেয়ে বেশি হয় যখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়। এই সরকারের সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো যেহেতু মোটামুটি ফেল করেছে, সেহেতু সংখ্যালঘুর ওপর কোথাও কোথায় কিছু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
সংখ্যালঘুদের পারসেপশন হচ্ছে, তারা বিপদে আছে। এই পারসেপশন সংখ্যালঘু ছাড়াও সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যেও আছে। রাস্তাঘাটে বের হলে কেউ গাড়ি ভেঙে দেবে কি না, ধরবে-মারবে কি না— এসব নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন (ওরিড)। রাজনীতিবিদ ছাড়াও সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় আছে। সংখ্যালঘুদের মধ্যে তা আরও বেশি। কারণ আইনশৃঙ্খলার অবনতি যত হবে, ফিজিক্যালি না হলেও মানসিকভাবে তারা দুর্বল হবেন।

রাজনীতি ডটকম: জাতীয় পার্টির অন্তর্কোন্দলের কী অবস্থা? রওশন এরশাদ কেমন আছেন?
জি এম কাদের: এখন আর বিভক্ত নেই। বিভক্তিটা তৈরি করেছিলেন শেখ হাসিনা। বেআইনিভাবে, অন্যায়ভাবে আমাকে কোনঠাসা করার সব চেষ্টা করেছেন। কিছু কিছু লোক, যারা শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিলেন, তারা আছেন। এখনো ডিস্টার্ব করার চেষ্টা করছেন।
অনেকদিন ওনার (রওশন) সঙ্গে কথা হয়নি। উনার সঙ্গে যারা থাকতেন, তারা বিশ্রিরকম নোংরামি করতেন। আমি ইচ্ছা করে উনার সঙ্গে দেখা করিনি। আমার ছোটভাই এসেছিল, উনার সঙ্গে দেখা করেছেন। আমিও শিগগির যাব দেখা করতে। ওখানে গেলে সিনক্রিয়েট করে কেউ কেউ আবার সংবাদমাধ্যমে প্রচার করবে। তবে আমি খবর রাখি। উনি ভালো আছেন। উনি আমার পরিবারের সদস্য। আমরা সবসময় উনাকে রেসপেক্ট করি। উনি যা কিছু করেছেন, হয়তো বাধ্য হয়ে করেছেন বা ভুল করেছেন। আমরা মনে করি, মুরুব্বি হিসেবে তার প্রতি কোনো রাগ বা ক্ষোভ নেই।
রাজনীতি ডটকম: জাতীয় পার্টি রাজনৈতিক দল হিসেবে এখন কী করছে?
জি এম কাদের: পুলিশ মাঠ পর্যায়ে নেতাকর্মীদের খুব দাবড়াচ্ছে। যেকোনো জায়গায় সভা-সমাবেশ করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। গ্রেপ্তার করে, না হয় গ্রেপ্তারের ভয় দেখায়। মামলা দেওয়া হয়। সেই হিসেবে মাঠের নেতাকর্মীরা ভালো নেই। তবে ফিজিক্যালি ভালো না থাকলেও এখন জাতীয় পার্টি সত্যিকার রাজনীতি করছে। জনগণের পক্ষের রাজনীতি করছে। বেশিরভাগ মানুষ, যারা নির্যাতিত বা নিষ্পেষিত, তারা কিন্তু জাতীয় পার্টির দিকে তাকিয়ে আছে। আমি মনে করি, অন্য অনেক সময়ের চেয়ে জাতীয় পার্টির দিকে তাকিয়ে থাকা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে।
রাজনীতি ডটকম: খালেদা জিয়া সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
জি এম কাদের: আমি মনে করি, বিএনপিকে গণমানুষের দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন খালেদা জিয়া। আগে এটি ছিল সরকারি দল, সুবিধাবাদী মানুষের দল। সাধারণ মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা কম ছিল। খালেদা জিয়া বিএনপিকে গণমানুষের দল করেছেন। এটি উনার বড় কৃতিত্ব। উনি অন্য যা কিছু করুন, উনার দেশ চালানো সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাই না, কিন্তু গণমানুষের প্রত্যাশা বা আকাঙ্ক্ষার শক্তিশালী দল হিসেবে বিএনপিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
রাজনীতি ডটকম: শেখ হাসিনা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
জি এম কাদের: আমার ধারণা যে শেখ হাসিনা স্বাভাবিকভাবে রাজনীতিতে সেভাবে কামব্যাক করতে পারবেন না। তবে উনি দলে একটি সম্মান পাবেন। উনি দলকে অনেক দূর টেনে নিয়ে গেছেন, যদিও শেষে গিয়ে বিপর্যয় হয়েছে। তবে দলটিকে অনেক দূর নেওয়ার কৃতিত্ব তার। উনার অবদান আওয়ামী লীগের জন্য একবারে কম নয়। তবে শেষ পর্যন্ত শাসনব্যবস্থায় ফেল করেছেন। ইতিহাসে উনাকে সেভাবেই মূল্যায়ন করবে।

ভবিষ্যতে উনি রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারবেন কি না, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। খুব সফলভাবে পারবেন বলে আমার মনে হয় না। ওনার সমস্যা হচ্ছে— উনি কোনো সেকেন্ড ম্যান আগে থেকে তৈরি করেননি। আমি মনে করি, এটা উনার সবচেয়ে বড় ভুল। উনার পরিবর্তে আরেকজন নেতা যদি থাকতেন, তাহলে এই সময়ে আওয়ামী লীগ এত বিপর্যয়ের মুখে পড়ত না।
রাজনীতি ডটকম: আপনার কী মনে হয়, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যত কী?
জি এম কাদের: অন্য দল সম্পর্কে বলা মুশকিল। আওয়ামী লীগ নেতাদের যুক্তি হচ্ছে, উনাকে তারা বোঝাতে পারতেন না। সব মিলিয়ে উনার একটি খারাপ ইমেজ হয়েছে। সে বিবেচনায় দলের দায়ও (লায়াবিলিটি) বলতে পারেন। তবে একটা কথা আমি অভিজ্ঞতা থেকে বলছি— নব্বই সালের পরে এরশাদ সাহেবের বিরুদ্ধে অনেক অপপ্রচার করা হলো। অনেক জিনিস মানুষ গ্রহণ করেছে। পরবর্তীকালে এগুলো কেটে গেছে। কারণ পরবর্তীতে যারা এসেছে, তারা ভালো কিছু করতে পারেনি।
এখনো একই ঘটনা ঘটছে। শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পর তার প্রতি মানুষের যে ঘৃণা ছিল, সেটি কেটে যাচ্ছে। কারণ এর চেয়ে ভালো কিছু চোখে পড়ছে না। এটাই হলো উনার পক্ষে পজিটিভ সাইন। তবে উনার এবং উনার যারা ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিল তাদের কারণে নির্বাচনে হয়তো প্রভাব পড়বে। তারা দোষী বা নির্দোষ যাই হোক, তাদের মানুষ দোষী হিসেবে এখনো দেখছে।
তবে ব্যক্তির ইমেজ এক জিনিস, নেতৃত্ব আলাদা জিনিস। চেঙ্গিস খান অনেক মানুষ মেরেছেন। কিন্তু কর্মীদের কাছে, সোলজারদের কাছে তিনি হিরো। দলের কাছে শেখ হাসিনার সেই ইমেজ কিন্তু এখনো আছে। উনি কাউকে অ্যাসাইন করতে পারেন। দলের অস্তিত্বের জন্য হয়তো সবাই তাকে মেনে নেবে।
রাজনীতি ডটকম: আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলে মাঠে জাতীয় পার্টি, নেপথ্যে আওয়ামী লীগ— এমন ঐক্য হতে পারে?
জি এম কাদের: আমি মনে করি না এখনো সে রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। একেবারে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নির্বাচন! গত নির্বাচনের সময়ও বলেছিলাম, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপি বা আওয়ামী লীগ— যেকোনো একটিকে বাদ দিয়ে অন্তর্ভুক্তিভূলক নির্বাচন হবে না। জনগণের প্রকৃত প্রত্যাশা ও ইচ্ছার প্রতিফলন তাতে ঘটবে না। তাই সবাইকে নিয়ে নির্বাচন হওয়া উচিত। জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে তারা কাকে দেখতে চায়।
রাজনীতি ডটকম: একানব্বইয়ের পর এই প্রথম চব্বিশে চ্যালেঞ্জে পড়েছে জাতীয় পার্টি। ভোটের হারও কমে ১৮ থেকে ৪ শতাংশে এসেছে। জনগণের সঙ্গে থাকলে এমন হলো কেন?
জি এম কাদের: সর্বশেষ নির্বাচনের হিসাব নিয়ে লাভ নেই। ২০০১ বা ২০০৮ সালের ভোটে জাতীয় পার্টির ভোট ছিল সাড়ে সাত শতাংশ। ১৯৯১ সাল থেকে শুনে আসছি, এবারই জাতীয় পার্টি শেষ। আগামী নির্বাচনে থাকবে না। পরের বছর থাকবে না। কিন্তু জাতীয় পার্টি আছে। আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে আমরা আছি। যারা জাতীয় পার্টিকে দেখতে পারে না, গালাগাল করে, তারাও জাতীয় পার্টির নাম নেয়। এর মানে, জাপা মানুষের দল, মানুষের মধ্যে আছে।

রাজনীতি ডটকম: আগামী নির্বাচনে কে ক্ষমতায় আসবে বলে মনে করেন?
জি এম কাদের: এটা বলা কঠিন। পারিপার্শ্বিকতা থেকে অনেকেই মনে করেন যে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে। তবে পারসেপশন সবসময় শতভাগ কারেক্ট হবে, এর নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। বিএনপির লোকেরা সে কারণে উদ্বিগ্ন (ওরিড)। কী হতে পারে, এটা তাদের কাছেও স্পষ্ট নয়!
সঠিক নির্বাচন যদি হয়, যেমন— ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ মোটামুটি নিশ্চিত ছিল যে তারা ক্ষমতায় যাবে, একটি মন্ত্রিসভাও গঠন করা হয়েছিল, কিন্তু দেখা গেল, তারা ব্যাপকভাবে পরাজিত হয়েছে। এবার যেভাবে যা কিছু ঘটছে, তাতে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা বলা মুশকিল।
রাজনীতি ডটকম: নতুন দল গঠনের কথা শোনা যাচ্ছে। কীভাবে দেখেন?
জি এম কাদের: এটা শুভ সংবাদ। দল যে কেউ গঠন হতে পারে, স্বাগত জানাই। কিন্তু সরকারে থেকে দল গঠন করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। কোনো রাজনৈতিক দল বা জনগণ এটা গ্রহণ করবে বলে মনে হয় না। দল গঠন করলে সরকারের বাইরে থেকে করতে হবে। সরকারের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দল গঠন গ্রহণযোগ্য হবে না।
রাজনীতি ডটকম: নির্বাচন কবে হওয়া উচিত?
জি এম কাদের: যত দ্রুত বা তাড়াতাড়ি সম্ভব, নির্বাচন করে ফেলা দরকার। কারণ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত দেশের এই নৈরাজ্য থামবে না।
সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। কিছু সংস্কার দরকার আছে। তবে আমাদের সংবিধান বা নির্বাচনব্যবস্থা এতটা খারাপ না যে এটা নিয়ে এগোনো যাবে না। আইনকানুন সবই আছে। কিন্তু সেগুলো নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কমানোর যে প্রস্তাব, সেটি ঠিকই আছে। কিন্তু আরও যেসব সংস্কারের কথা শুনি, তার বেশির ভাগই গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। তাছাড়া এত কষ্ট করে আপনারা সংস্কার করে গেলেন, এরপর নির্বাচিত সরকার সেগুলো অনুমোদন না করলে লাভ কী হলো? তাই ন্যূনতম ও জরুরি কিছু সংস্কার করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারলেই অন্তবর্তী সরকার কিছুটা হলেও সফল হবে বলে আমি মনে করি।
রাজনীতি ডটকম: রাজনীতি ডটকমকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
জি এম কাদের: আপনাদেরও ধন্যবাদ।